বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) মানসিক স্বাস্থ্যকে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছে – “মানসিক স্বাস্থ্য হল কুশলতার একটি স্তর যে স্তরে কোনো ব্যক্তি তার নিজস্ব ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারে, জীবনের স্বাভাবিক উদ্বেগের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, ফলদায়ক ও ফলপ্রসুভাবে কাজ করতে পারে এবং তার গোষ্ঠীতে অবদান রাখতে সক্ষম হয়।”
বিস্তারিত ভাবে বললে এটি অনুভূতি এবং ভাবনা সহ ব্যক্তির মানসিক অবস্থার কথা জানায়। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে, এবং যে সামাজিক অবস্থানে আমরা বিচরণ করছি, সেখানে আমরা কীভাবে আচরণ করছি তাকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে এগুলির ভূমিকা রয়েছে।
ভাবনা বলতে আমাদের বুদ্ধিগম্য ক্রিয়াকলাপগুলিকে বোঝায়, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মানসিক ক্ষমতা, যেমন, একটি নতুন ধারণাকে শেখা, বিচারশক্তি ব্যবহার করা, তথ্যাবলী স্মরণ করা এবং মনে ধরে রাখা, সমস্যা-সমাধান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা সহ মনোযোগের ক্ষমতা।
মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থান একটি বর্ণালী জুড়ে। শারীরিকভাবে ঠিক যেমনটি হয়ে থাকে তেমনি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যও কখনও ভালো আবার কখনও খারাপ হতে পারে। কোনো অবস্থাটাই নিশ্চল নয়। সময়ের নিরিখে আমরা কোন অবস্থার মধ্যে রয়েছি সেটি নির্ভর করে বিভিন্ন কারণের উপরে যা আমাদের ভাবনা চিন্তা এবং অনুভূতির উপরে প্রভাব বিস্তার করে এবং তার ফলে আমরা সেইভাবে আচরণ করে থাকি।
নিজের মানসিক স্বাস্থ্যকে যাচাই করে দেখা
কোন একটি সময়ে আপনি বর্ণালীর কোন বিন্দুতে রয়েছেন তা জানার জন্য আপনি নিজেকে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলি জিজ্ঞাসা করতে পারেনঃ
১. আমি জীবনের উদ্বেগগুলির সাথে ভালোভাবে মানিয়ে নিতে কতটা সক্ষম?
২. আমি আমার প্রত্যহিক কাজকর্মগুলিকে কতটা ভালোভাবে পালন করতে সক্ষম?
৩. আমি অন্যদের সাথে কত ভালোভাবে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে সক্ষম?
৪. টিকে থাকা এবং উন্নতি করার মধ্যে আমি কোন অবস্থাতে রয়েছি?
এই সমস্ত প্রশ্নগুলিকে বিবেচনা করার সময় মনে রাখবেন যে এগুলির প্রকৃতি বিষয়গত। যখন এই প্রশ্নগুলির মাধ্যমে আপনি আপনার মূল্যায়ন করছেন তখন মাথায় রাখতে হবে যে কোনো কাজ আপনি কতটা ভালোভাবে অথবা খারাপভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম সেটি অবশ্যই নির্ধারিত হবে আপনার ক্রিয়াশীলতার স্বাভাবিক স্তরের তুলনায়।
মানসিক অসুস্থতা বলতে বোঝায় এমন একটি স্বাস্থ্যের অবস্থা যেটি একটি ব্যক্তিকে অনুভূতিগত, শারীরিকভাবে এবং আচরণগতভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। শারীরিক অসুস্থতার মতোই এটিরও চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে।
সম্মিলিতভাবে জৈববৃত্তীয় (যেমন জিনগত প্রবণতা), শারীরবৃত্তীয় (উদাহরণ স্বরূপঃ আঘাতজনিত অসুস্থতা) এবং সামাজিক কারণসমূহ (যেমন, বৈষম্য)-এর জন্য সেগুলি হয়ে থাকে।
মানসিক অসুস্থতার বহুপ্রতিষ্ঠিত দুটি পদ্ধতির শ্রেণীবিভাগ হলঃ
- আইসিডি-১০: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(হু)-র ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজেস-এর পঞ্চম অধ্যায়।
- ডিএসএম-৫: আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশান-এর ডায়গনিস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিসঅর্ডার।
এই ম্যানুয়ালগুলিতে ২৫০-র ও বেশী ধরনের মানসিক অসুস্থতাকে চিহ্নিত এবং নামকরণ করা হয়েছে।
মানসিক অসুস্থতাকে সাতটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। সেগুলি হলঃ
মেজাজ সংক্রান্ত বিকার (মুড ডিসঅর্ডার)
মেজাজ সংক্রান্ত বিকার যদি দীর্ঘদিন ধরে চলে এবং মারাত্মক প্রকৃতির হয় তাহলে এটি কোনো ব্যক্তির জীবনে উল্লেখযোগ্য মানসিক যন্ত্রণার কারণ হতে পারে। মেজাজ সংক্রান্ত বিকারের অন্যান্য উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছ অবসাদ, বাইপোলার ডিসঅর্ডার ইত্যাদি।
উদ্বেগ বিকার (এংজাইটি ডিস্অর্ডার)
বিকারের একটি শ্রেণীবিভাগ যেখানে উদ্বেগ (অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা, আশঙ্কা) হল প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট। এটি একটি নির্দিষ্ট প্ররোচনার প্রতিক্রিয়া হতে পারে (যেমন ফোবিয়া বা আতঙ্ক থাকা) কিন্তু সেটা অপরিহার্য নয়। উদ্বেগ বিকারে কোনো প্রতীয়মান কারণ ছাড়াই উচ্চমাত্রার উদ্বেগ, উত্তেজনা এবং অতিরিক্ত আশঙ্কার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। এই লক্ষণগুলি একজন ব্যক্তির প্রাত্যহিক কাজকর্মকে উল্লেখনীয় ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে।
ব্যক্তিত্বের বিকার (পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার)
ব্যক্তিত্ব হল একজন ব্যক্তি চিন্তা, অনুভূতি এবং আচরণের বৈশিষ্ট্য যার কারণে প্রত্যেক ব্যক্তি অনন্য। মানুষের অভিজ্ঞতা, পরিবেশ (শৈশব ও জীবনের ঘটনাবলী সহ) এবং জন্মগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি বিষয়গুলি একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে। ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলি সারা জীবন ধরে একই রকম থাকে।
যখন কোন একজন ব্যক্তির মধ্যে অস্বাস্থ্যকর চিন্তাভাবনা এবং ভাবাবেগের উদয় হয় ও সেগুলি তার আচরণের উপরে প্রভাব বিস্তার করে এবং কার্য সম্পাদন করা কষ্টকর হয়ে ওঠে তখন ব্যক্তিত্বের বিকার দেখা দেয়।
মনোব্যাধি (সাইকোটিক ডিসঅর্ডার)
মনোব্যাধি (যেমন সিজোফ্রেনিয়া)হল এমন একটি অসুস্থতা যেখানে সাইকোটিক লক্ষণগুলির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে ভ্রান্তি (ডিলিউশনস), অমূলপ্রত্যক্ষ (হ্যালুসিনেশনস), অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং আচরণ অথবা ক্যাটাটোনিক(নড়াচড়া না করা অথবা ঘন্টার পর ঘন্টা চুপচাপ বসে থাকা)অবস্থা। এই লক্ষণগুলি কিছুদিন ধরে চলতে পারে। কারো-কারো ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক অসুস্থতার মতো দীর্ঘদিন ব্যাপী চিকিৎসার প্রয়োজনও হতে পারে।
খাদ্য বিকার (ইটিং ডিসঅর্ডার)
খাবারের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস কোনও-কোনও ব্যক্তির পক্ষে শারীরিক অথবা ভাবাবেগের সমস্যার কারণ হতে পারে। সব থেকে বড় উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে অ্যানোরেক্সিয়া(অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা), বুলিমিয়া (বুলিমিয়া নার্ভোসা) এবং বিঞ্জ-ইটিং ডিসঅর্ডার (বিইডি)।
আঘাত (ট্রমা)-সম্পর্কিত বিকার
অত্যন্ত ক্লেশকর ঘটনা অথবা পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনার কারণে আবেগের তীব্র প্রতিক্রিয়াকে ট্রমা বলে হয়। ট্রমা-সম্পর্কিত বিকারগুলি, যেমন পোষ্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি)-এর মত অসুস্থতা, ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে আঘাতের প্রভাবের কারণে হতে পারে।
মাদক দ্রব্যের অপব্যবহার সম্পর্কিত বিকার (সাবস্টেন্স অ্যাবিউস ডিসঅর্ডার)
মদ, তামাক, প্রতিকারের জন্য ব্যবহৃত মাদক এবং বেআইনি মাদকের মত দ্রব্যগুলির অতিরিক্ত এবং ক্ষতিকারক ব্যবহারের থেকে সৃষ্ট বিকারগুলিকে মাদক দ্রব্য সম্পর্কিত বিকার বা সাবস্টেন্স অ্যাবিউস ডিসঅর্ডার বলা হয়।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে