একাদশ শ্রেণির ছাত্রী আশা বেশ কয়েক মাস ধরে মাঝে মাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিল এবং এই অবস্থায় অস্বাভাবিক আচরণও করছিল। তাকে নিয়ে বাড়ির লোকজন খুবই চিন্তায় পড়ে যায় এবং বিভিন্ন মন্দিরে গিয়ে পুজো দেওয়া থেকে শুরু করে প্রার্থনার দ্বারা যাঁরা অসুখ সারাতে পারে বলে দাবি করে, সেই সব মানুষের কাছে আশাকে নিয়ে যাতায়াত আরম্ভ করে। সেই সব অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ বলেছিল যে, আশার উপর কারও কুপ্রভাব পড়েছে। কিন্তু এইসব দৌলতে প্রচুর অর্থ খরচ করেও আশার অসুখ সারছিল না। তখন আশাকে একজন জেনারেল ফিজিশিয়ানের কাছে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি তৎক্ষণাৎ একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। এই সময় আশার বাবা, মা খুবই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের এই ভেবে ভয় হয় যে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হয়তো আশাকে শক থেরাপি বা ঘুমের ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা করবেন, বা তাকে সম্মোহিত করার চেষ্টা করা হবে, অথবা পাগল বলে চিহ্নিত করা হবে।
আশা যখন আমার কাছে এসেছিল, তখন তাকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত লাগছিল। ঠাকুর-দেবতা, মাদুলি-কবজের ভারে আশা তখন ক্লান্ত। সাধারণ ভাবে তখন আশাকে দেখে মনে হয়েছিল, অত্যধিক পড়াশোনোর চাপ এবং সন্তানকে নিয়ে মা-বাবার উচ্চাশা এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে, আশা ক্রমশ জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলছিল। প্রতিবার পরীক্ষার আগে আশা খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়ত এবং ফাইনাল পরীক্ষার সময় তার মধ্যে চরম মানসিক উদ্বিগ্নতা দেখা যেত। আর এই জন্যই আশার আচরণে অস্বাভাবিকতা এবং মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আশা তখন ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া বা ঘুম- কোনওটাই করতে পারত না।
আশার এহেন মানসিক উদ্বিগ্নতার সমস্যা নিরাময়ের জন্য ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়। এর সঙ্গে তার দক্ষতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণও শুরু করা হয়। শরীর ও মনের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে আশাকে ওয়াকিবহাল করার জন্য নানা আলোচনা এবং তার প্রতি পরিবারের অত্যধিক প্রত্যাশা যে তাকে কীভাবে স্বাভাবিক আচরণ করা থেকে বিরত করছে, তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়। এই পদ্ধতি গ্রহণ করার ফলে আশা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে।
মনোরোগের চিকিৎসা বিগত চার দশক ধরেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা হিসেবে পরিচিত। ১৯৩০-৪০ এর দশকে এই চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল পুরোপুরি মনস্বত্ত্বনির্ভর। সাইকোঅ্যানালিসিস নামক একটি মাধ্যম, যেখানে মূলত রোগীর কথা শুনে চিকিৎসা করা হত এবং এই ক্ষেত্রে তার শৈশবের সমস্যা, সেই সময় পাওয়া মানসিক আঘাতগুলি ব্যাখ্যা করে রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করা হত। কিন্তু এই চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল খুবই সময় সাপেক্ষ এবং রোগীর সুস্থ হওয়া ছিল অনেকটাই অনিশ্চিত।
১৯৫০ সালে মনোরোগের চিকিৎসার কিছু ওষুধ আবিষ্কার হয়। এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক ছিল। মনোরোগীদের আগে মানসিক হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করা হত। কিন্তু এই সময় বাড়িতেই চিকিৎসা করে রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস দেখা যায়।
সেই সময় থেকে মানসিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি দেখা যেতে শুরু করে। পরবর্তীকালে যখর মস্তিষ্কের কার্যকলাপ নিয়ে ব্যাপক ভাবে পড়াশোনো ও গবেষণা শুরু হয়, তখন মানসিক সমস্যাগুলির কারণ আরও স্পষ্ট হতে আরম্ভ করে। গবেষণা যত গভীর হতে থাকে, চিকিৎসার পদ্ধতিগুলিও উন্নত রূপ ধারণ করে। মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাকে এখন ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো অসুখ ও চারটি প্রধান নন-কমিউনিকেবল রোগের মতোই দেখা হয়।
কী দেখে একজনকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে গণ্য করা যাবে?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ একজন চিকিৎসক, যিনি মানসিক স্বাস্থ্যের অস্বাভাবিকতা, অব্যবস্থাগুলিকে চিহ্নিত করে উপযুক্ত চিকিৎসা করেন। যখন আপনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে প্রথম যাবেন, তখন তিনি আপনার বর্তমান সমস্যার ইতিহাস, ছোটবেলার কোনও অসুখ, আপনার পরিবার এবং আপনি এর আগে কোনও বিশেষ অসুখে আক্রান্ত হয়েছিলেন কি না, তা বিস্তারিত ভাবে খতিয়ে দেখবেন। তারপর তিনি নানারকম পরীক্ষা করে আপনার নির্দিষ্ট মানসিক সমস্যার সমাধানের জন্য চিকিৎসা শুরু করবেন। এরপর আপনার মনের বিভিন্ন অবস্থা, যেমন মুড, চিন্তা, বৌদ্ধিক দক্ষতা ইত্যাদি বিবেচনা করে সমস্যার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন এবং সমাধানের পথ খুঁজবেন।
একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতে, একজন মানুষের সঙ্গে তার নিজের এবং পরিবেশের যোগাযোগের উপর ভিত্তি করে সেই মানুষের মূল সমস্যা বা তার রোগের উপসর্গগুলিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। এর চিকিৎসা পদ্ধতি সাধারণত ওষুধ এবং মনস্তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণের উপর নির্ভরশীল। এই চিকিৎসা সফল হওয়ার পিছনে রোগীর পরিবারের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সার্বিক ভাবে দেখতে গেলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ একা নন, বরং এই চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকেন সাইকোলজিস্ট, নার্স, এমনকী সমাজকর্মীরাও। মাঝে মাঝে জেনারেল ফিজিশিয়ানেরও পরামর্শ নেওয়া হয়।
মানসিক সমস্যার চিকিৎসা নানা প্রকার। সমস্যা যদি অল্প হয় তাহলে শুধুমাত্র থেরাপির দ্বারাই ফল পাওয়া যায়। কিছু সমস্যা রয়েছে যেখানে ওষুধ এবং থেরাপি দুটোই প্রযোজ্য। আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে যেখানে ওষুধ প্রয়োগ একান্ত আবশ্যক। সাধারণত সামান্য মানসিক উদ্বেগ বা অল্প পরিমাণ অবসাদের শিকার হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া তত জরুরি নয়। এই সব ক্ষেত্রে জেনারেল ফিজিশিয়ান বা সাধারণ কোনও মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিলেই চলে। তবে সমস্যার স্বরূপ বুঝে এঁরা যদি মনে করেন তাহলে রোগীকে একজন ভাল মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানোর সবরকম ব্যবস্থা করেন।
মানসিক রোগের ধারণাটি কি কাল্পনিক
মনোরোগের বিষয়টি আজ চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি প্রতিষ্ঠিত শাখা হিসেবে গড়ে উঠলেও, এর পিছনে আজও বহু কাল্পনিক তত্ত্ব খাড়া করা হয়। এগুলি মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাকে জন্ম দেয়। মনোরোগ সংক্রান্ত কিছু ভুল ধারণা যেমন, মনোরোগের কারণ, এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের কাজ, মেডিকেশন সম্পর্কে অজ্ঞতা, হাসপাতালে থেকে সঠিক চিকিৎসা করানোর ক্ষেত্রে নানারকম ভয়, সর্বোপরি মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া মানেই নিজেকে ‘পাগল’ বলে ধরে নেওয়া ইত্যাদি বাধাগুলি আজও বর্তমান। আর এগুলি থেকেই নানারকম কল্পকথার জন্ম হয়েছে। মনোরোগের উপসর্গগুলি আজও মানুষের কাছে বোধগম্য হয় না বলে তারা মন্দিরে গিয়ে মাথা কুটে মরে বা অসুখ সারাতে অলৌকিক কাণ্ডকারখানার উপর নির্ভর করে।
যাইহোক, অসুখ সারাতে ভুল ধারণার বশবর্তী না হয়ে প্রথমেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। কারণ দেরি হলে সমস্যা বড় আকার ধারণ করতে পারে। এই ক্ষেত্রে রোগীর পরিবারকে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যোগাযোগ করতে হবে। সঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে একজন রোগীর পক্ষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাটা আদৌ কঠিন নয়। তবে এর ব্যতিক্রম ঘটলে সমগ্র পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে আশা ঠিক সময়ে বিশেষজ্ঞের সাহায্য পেয়েছিল বলেই সে মানসিক রোগের সমস্যার হাত থেকে তাড়াতাড়ি মুক্তি পেয়েছিল। এখন সে তার মানসিক উদ্বিগ্নতার সমস্যা নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং এর জন্য ওষুধের দরকার পড়ে না।
লেখক: ডাক্তার প্রভা এস চন্দ্রা, নিমহানস-এর মনোরোগ সংক্রান্ত বিভাগের অধ্যাপক।