সম্পর্কজনিত মানসিক নির্যাতন (আবেগ বা অনুভূতিতে আঘাত করা) কীভাবে জানা ও বোঝা যায়?
শারীরিক নির্যাতন সম্পর্কে আমাদের সবারই ধারণা রয়েছে এবং দৈহিকভাবে কাউকে আক্রমণ করা বা হিংসাত্মক মনোভাব আমরা চোখ দিয়ে সরাসরি দেখতে পাই। শারীরিক নির্যাতনের মতো আরও একটি নির্যাতন রয়েছে যা দৈহিক আঘাতের মতো সমানভাবে ক্ষতিকারক এবং আরও মারাত্মক। এর নাম মানসিক নির্যাতন।
মানসিক নির্যাতন বা অনুভূতিগত আঘাত বলতে কী বোঝায়?
এই ঘটনা সাধারণত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ক্ষেত্রেই ঘটতে দেখা যায়। এর মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একজন মানুষকে হীন চোখে দেখা, তাকে হেনস্থা করা বা তাকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়। এই মানসিক নির্যাতনের কারণে একজন মানুষের মধ্যে আত্মনির্ভরতার অভাব জন্মায় এবং এর কুপ্রভাব মানুষের পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ওপর পড়ে। সম্পর্কজনিত মানসিক নির্যাতনের ঘটনা পুরুষ এবং মহিলা দু’জনের ক্ষেত্রেই ঘটে।
শারীরিক নির্যাতন বা আক্রমণের মতোই মানসিক নির্যাতনও মানুষের পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে দুর্বল বা শক্তিহীন করে তোলে। অনেকসময় যাকে মানসিক নির্যাতন করা হয় সে বুঝতেই পারে না যে সে নির্যাতিত হচ্ছে। আবার নির্যাতনকারী যখন অন্যের উপরে নির্যাতন চালায় তখন তার সেই আচরণের প্রভাব অন্য মানুষটির উপরে কীভাবে পড়ে সে সম্পর্কে তার সচেতনতা থাকে না।
মানসিক নির্যাতনের বিভিন্ন ধরনগুলি কীরকম হয়ে থাকে?
নীচের আচরণগুলি মানসিক নির্যাতনের অন্যতম উদাহরণ-
- একটানা কাউকে সন্দেহ করা- অনেকসময়ে পারস্পরিক সম্পর্কে অহেতুক সন্দেহ এবং অযৌক্তিক দোষারোপ করার ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে নির্যাতনকারী তার সঙ্গীকে কোথায় যাচ্ছে বা কার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন করে। নির্যাতনকারী তার সঙ্গীকে পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে অসৎ বলে দোষারোপ করতে পারে এবং এই নিয়ে তার বিরুদ্ধে অন্যায় অভিযোগ তুলে তাকে হেনস্থাও করতে পারে।
- স্বাভাবিকভাবে সমালোচনা করা বা খোঁচা দিয়ে কথা বললেও মানুষকে মানসিকভাবে আঘাত করা হয়। মানুষের নিজস্ব খাওয়া-দাওয়া, দেখা বা পরিহিত কাপড়-জামা, তাদের দায়দায়িত্ব পালনের দক্ষতা বা ক্ষমতা নিয়ে সমালোচনা বা খোঁচা দেওয়া হয়। এভাবে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে সে অন্যদের চাইতে বেঠিক বা ভুল।
- মানুষকে একা বা বিচ্ছিন্ন করা- পাঁচজনের সামনে নির্দিষ্ট একজনকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা। এর পরে ব্যক্তিগতভাবে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাওয়ার পালাও হয়।
- শাস্তি দিয়ে বা অবহেলা দেখিয়ে অন্য কারও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা- এই ধরনের আচরণের মধ্য দিয়ে মানুষের পোশাক এবং টাকাপয়সা খরচের বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলে। এই কারণে মানুষ ছোটখাটো কিছু বিষয় সম্পর্কে তার সঙ্গীকে কিছু জানাতে বা তার অনুমতি নেওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করে।
- পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবেগজনিত আচরণের ঘাটতি- এই ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কোনও মানুষ তার সঙ্গীকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে সেই মানুষটি তার ভালোবাসার যোগ্য নয়। এর জন্য প্রায়শই শাস্তিস্বরূপ মানুষের ভুল-ত্রুটি ধরার প্রবণতা দেখা যায়।
- অন্যকে অবহেলা বা পাত্তা না দেওয়া- উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একজনের কথা বা কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার মতামতকে গুরত্ব না দেওয়া। এক্ষেত্রে নির্যাতনকারী অন্যের স্বপ্ন বা ইচ্ছাকে সম্মান জানায় না বা অন্যকে নিতান্তই তুচ্ছ করে দেখে।
- এমন মন্তব্য করা যাতে একজন সঙ্গী বিশ্বাস করতে শুরু করে যে সে তার মনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে বা গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে- এর মাধ্যমে নির্যাতনকারী এমন ভান করে যে যেন কোনও ঘটনাই ঘটেনি বা অতীতের কোনও স্মরণীয় ঘটনাকে অন্যরকমভাবে ব্যাখ্যা করা। কারণ নির্যাতনকারী জানে যে অন্য মানুষটির কাছে সেই পুরনো স্মৃতি খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয়।
- কিছু ক্ষেত্রে নির্যাতনকারীরা অন্যের কাজকর্ম এবং হাঁটাচলার উপরে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে বন্ধু এবং পরিবারের থেকে আলাদা করার চেষ্টা করে।
এভাবে একজন নির্যাতনকারী বেশ কৌশল করে মৌখিক এবং মানসিক নির্যাতন করে। আর নির্যাতিত ব্যক্তি নির্যাতনকারীর অত্যাচারে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, তার ঘেরাটোপে আটকে পড়ে, এবং কখনোই বুঝতে পারে না যে নির্যাতনকারী কী করবে এবং কী বলবে। নির্যাতিত নির্যাতনকারীর মন্তব্য বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং ভাবতে আরম্ভ করে যে সে বোকা, অক্ষম বা অপদার্থ। আর এর পিছনে থাকে নির্যাতনকারীর আচরণ।
চটুল মন্তব্য বা কথার খোঁচার মধ্য দিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে মানসিক নির্যাতন চালানো যায়। আর এই ঘটনা নির্যাতিত এবং নির্যাতনকারীর পারস্পরিক সম্পর্কে অতি ‘স্বাভাবিক’ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। নির্যাতনকারীর এহেন আচরণ যে স্বাভাবিক নয় তা একজন নির্যাতিত বুঝতেই পারে না এবং এই ঘটনায় নির্যাতিতের আত্মবিশ্বাস যে তলানিতে এসে ঠেকছে তাও নির্যাতিত ব্যক্তির বোধগম্য হয় না। নির্যাতনের প্রভাব কীভাবে একজন নির্যাতিতের উপর এসে পড়ে তা সাদা চোখে ধরাই পড়ে না।
ক্রমশ, এই ধরনের মানসিক নির্যাতন এবং অবহেলা বাড়তে বাড়তে নির্যাতিত একসময়ে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে সে সত্যিই একজন অপদার্থ এবং তাকে সাহায্য করার কেউ নেই। সে এটাও বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে যে সে ‘উদ্ভ্রান্ত’ এবং ভালোবাসা, স্নেহ এবং যত্ন পাওয়ার যোগ্য নয়।
অনেকসময়ে, নির্যাতনকারীও যে সুকৌশলে মানসিক নির্যাতন বা অত্যাচার করছে সে বিষয়ে তার সচেতনতা থাকে না। তারা এই ঘটনাকে ছোটবেলায় বাড়িতে ঘটা শাসনের মতো বিষয় বলে মনে করে এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একে খুব ‘স্বাভাবিক’ আচরণ বলে ভাবে।
মানসিক নির্যাতনের প্রভাব বা ফলাফল
মানসিক নির্যাতন শারীরিক নির্যাতনের মতোই একটা বিষয়। নির্যাতিতের উপর এই ঘটনার প্রভাব খুব গভীরভাবে পড়ে। মানসিক নির্যাতনের ফলে নির্যাতিতরা নিজেদের একা, অপদার্থ ও শক্তিহীন বলে ভাবে। এছাড়াও তাদের উপর আরও কিছু প্রভাব পড়ে-
- গুরুতর আত্মনির্ভরতার অভাব– নির্যাতনকারী সঙ্গীর দ্বারা সমালোচিত এবং বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে নির্যাতিতের মনে নিজের উপর সমস্ত বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। এই ঘটনা তাদের ক্ষেত্রেই বেশি করে দেখা যায় যাদের জীবনে বন্ধুবান্ধব, পরিবারের লোকজন বা সহকর্মীদের কোনও ভূমিকা থাকে না। ফলে নির্যাতিতেরা নিজেদের সম্পর্কে যে ভুল ধারণা করছে তা তাদের বুঝিয়ে দেওয়ার মতো কেউ থাকে না।
- নিজেদের অক্ষমতা এবং অযোগ্যতা সম্পর্কে মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায়– তারা কোনও মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না এবং কারোর সঙ্গেই থাকতে পারবে না বলে বিশ্বাস করে। তারা ভাবে যে তাদের সঙ্গীরা যেভাবে তাদের সঙ্গে আচরণ করছে সেই ব্যবহারের যোগ্যই তারা।
- এরা সবসময়ে ভয়ে ভয়ে বাঁচে– নির্যাতনকারীরা সবসময়ে এদের উপর নজর রাখছে বলে এরা ভয় পায়। তাদের কোন আচরণের সমালোচনা নির্যাতনকারীরা করবে এবং তাদের সঙ্গে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াবে সেই ভেবেই এরা মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।
বারবার মানসিকভাবে নির্যাতিত হতে হতে এরা অসহায় ও আশাহত হয়ে পড়ে। আর এর ফলে মানসিক অবসাদ ও উদ্বেগের জন্ম হতে পারে। কিন্তু যদি নির্যাতন থেমে যায় তাহলে অবসাদ বা উদ্বেগের লক্ষণও উধাও হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ থেকে নানারকম শারীরিক সমস্যা যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, গায়ে-হাতে ব্যথা, মাইগ্রেনের সমস্যা অথবা মেটাবলিক বা পরিপাকের সমস্যা সৃষ্টি হয়। মানসিক চাপ এবং নিজের মনে গুমরে থাকার কারণেও সাইকোসোমাটিক অসুখ হতে পারে। যারা মানসিকভাবে নির্যাতিত হয় তাদের মধ্যে উদ্বেগ ও অবসাদের সমস্যা খুব প্রকট হয়।
মানসিক নির্যাতন বন্ধের ক্ষেত্রে কার্যকরী সাহায্য
শারীরিক নির্যাতনের মতো মানসিক নির্যাতন সবসময়ে চোখে ধরা না পড়লেও এই দুটোই সমানভাবে ক্ষতিকারক এবং ধ্বংসাত্মক। মানসিক নির্যাতন মানুষকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। মনে রাখা জরুরি যে, নির্যাতিতের কোনও দোষই থাকে না। বরং অন্যদের সাহায্য পেলে নির্যাতিতের মনে সাহস জন্মাতে পারে।
যদি কেউ মনে করে যে সে মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাহলে তার তৎক্ষণাৎ প্রয়োজন অন্যের আন্তরিক সহযোগিতা। এক্ষেত্রে সে হেল্পলাইন বা কাউন্সেলরের সাহায্য নিতে পারে। একজন কাউন্সেলর নির্যাতিতের মনের নেতিবাচক ধারণা ভেঙে দিতে পারেন এবং নির্যাতনের ফলে তার হারিয়ে যাওয়া আত্মনির্ভরতা ফিরিয়ে আনতেও সাহায্য করেন। এছাড়া মানসিক জোর ফিরে পেতে বন্ধু ও পরিবারের সাহায্যও দরকার। যদি কেউ কাজকর্ম না করে তাহলে তার উচিত চাকরি করা। এভাবে তার সামাজিক পরিধি ও পরিচিতিও বাড়বে।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে