মাদকাসক্তি: নিরাময় পদ্ধতি বর্ণনা ২

0
55
একলোফোবিয়া: অন্ধকারের ভয়
একলোফোবিয়া: অন্ধকারের ভয়

১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ব্যক্তির অন্তর্নিহিত প্রেষণাকে জাগ্রত করা, অঙ্গীকার বন্ধ করার জন্য একটি সুন্দর সহযোগিতামূলক পরিবেশ এবং সম্পর্কের আবহ তৈরি করা হয়ে থাকে। একজন দক্ষ পরামর্শক (Knowledgeable consultant) সহজেই সেই পরিবেশ তৈরি করতে পারেন। প্রেষণামূলক সাক্ষাৎকারের ৫টি মৌলিক নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে সাবস্টেন্স (মাদক) বন্ধে উৎসাহিত করা হয়। নীতিগুলো নিম্নরূপ-
সমানুভূতি প্রকাশ (Express Empathy)  
সমানুভূতি অর্থাৎ রোগীর দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা বেদনা ইত্যাদির সাথে এক হয়ে যাওয়া, নিজের মধ্যে অনুভব করা, তার সমস্যার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, উষ্ণতা, শ্রদ্ধা, সমঝোতা এবং দক্ষতার সাথে যথাযথ সমানুভূতি প্রকাশ প্রেষণামূলক সাক্ষাৎকারের চালিকা শক্তি। এক্ষেত্রে রোগী এবং চিকিৎসক এর মধ্যে উঁচু-নীচু ভেদাভেদ থাকে না। তার ভূমিকা থাকে দক্ষ পরামর্শক ((Knowledgeable consultant) বা সাহায্যকারীর ভূমিকায়, কর্তৃপক্ষের ভূমিকায় নয়। মনোযোগের সাথে প্রতিফলিত শ্রবণ (Reflecting listening) রোগীর পরিবর্তনের প্রেষনাকে ত্বরান্বিত করে।
বৈষম্য তৈরি করা (Develop Discrepancy)
পরিবর্তনের প্রেষণা তখনই ঘটে যখন তিনি তার বর্তমান অবস্থান এবং ভবিষ্যতে কি হওয়ার কথা ছিল এই দুই জিনিসের মধ্যে বৈষম্য অনুধাবন করতে পারেন। ক্ষতির বিষয় নিয়ে আলোচনার ফলে তার মধ্যে সচেনতার সৃষ্টি হয়। সেই সাথে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব, অস্থিরতা, খারাপ লাগা। এগুলো থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পরিবর্তন বিষয়ক মুক্ত আলোচনার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। যার ফলে তার সাবস্টেন্স (মাদক) বন্ধের পথ সুগম হয়।
বিতর্ক এড়িয়ে চলা (Avoid Argumentation)
প্রেষণামূলক সাক্ষাৎকারে রোগীর সাথে সরাসরি কোনো তর্কে যাওয়া হয় না। তর্কের মাধ্যমে তার মধ্যে বৈষম্য, দ্বন্দ্ব তৈরি করা হলে সে প্রতিরক্ষা মূলক কৌশল (Defense) অবলম্বন করে এটা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইবে। তর্ক বা বিতর্ক করলে তার দিক থেকে মনে হতে পারে তাকে অযৌক্তিকভাবে আক্রমন করা হচ্ছে। আসলে প্রেষণামূলক সাক্ষাৎকারে তর্ক করলে রোগীই করে চিকিৎসক নয়।
প্রতিবন্ধকতার সাথে আবর্তন (Roll with Resistance)
প্রেষণামূলক সাক্ষাৎকারে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়া একটি সাধারণ বিষয়। মনোযোগ না দেয়া, তর্ক করা, আলোচনার মধ্যে বাধা সৃষ্টি করা, চিকিৎসকের উপর দিয়ে কথা বলা, চ্যালেঞ্জ করা, অস্বীকার করা ইত্যাদির সম্মুখীন হতে হয়। এই পরিস্থিতিতে রোগীর সাথে তর্ক না করে তার সমস্যা গুলোর ব্যাপারে নতুন আঙ্গিকে চিন্তা করার আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। কিন্তু একমত হওয়ার জন্য জোর করা যাবে না। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার কিছু কৌশল আছে ( মিলার এবং রোলনিক ১৯৯১)। যেমন-
সাধারণ প্রতিফলন (Simple reflection) 
রোগী যা বলে তার উপরই জোর দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করা। এই কৌশলটি তার ভিন্নমতের উপর প্রভাব বিস্তার করে ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা করতে সাহায্য করে।
Reflection with amplification:
এক্ষেত্রে রোগী যা বলে তা সামান্য পরিবর্তন করে বলা হয় এবং যে বিষয়গুলো সে অস্বীকার করে সেই বিষয়গুলোকেও ধরিয়ে দেয়া হয়। যেমন,
রোগী- আসলে আমি আসক্ত বা এই জাতীয় কিছু নই।
চিকিৎসক- আপনি নিজেকে কোন পর্যায়ে ফেলতে চাচ্ছেন?
রোগী- না, আমি মনে করিনা আমার সাবস্টেন্স (মাদক) এর কোনো সমস্যা আছে।
চিকিৎসক- অর্থাৎ যতদূর আমি বুঝেছি তাতে সত্যিকারভাবে সাবস্টেন্স (মাদক) নিয়ে আপনার কোনো সমস্যা বা ক্ষতি নেই।
রোগী- আমি আসলে ঠিক তা বলতে চাইনি।
চিকিৎসক- আচ্ছা, তার মানে সাবস্টেন্স (মাদক) এর কারণে আপনার কিছু সমস্যা হয়েছে এটা বলছেন কিন্তু আপনি নিজেকে “আসক্ত” এই জাতীয় কোনো পর্যায়ে ফেলা হোক সেটা চান না।
Double-sided Reflection:
রোগীর তথ্য থেকে যদি প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি আসে তখন এটাকে দ্বৈতভাবেও প্রতিফলন করা হয়। ইতোপূর্বে সেশন চলাকালীন সে যে তথ্য দিয়েছিল তার উপর ভিত্তি করেও দেয়া যেতে পারে। যেমন:
রোগী- কিন্তু আমি নেশা ছাড়তে চাইনা। কেননা আমার সব বন্ধুরাইতো নেয়।
চিকিৎসক- আসলে আপনি ভাবতে পারছেন না বন্ধুদের সাথে সাবস্টেন্স ব্যবহার না করে কিভাবে থাকবেন। একই সাথে আপনি চিন্তিত যে সাবস্টেন্স (মাদক) আপনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কতটা ক্ষতি করেছে।
Shifting Focus:
এ ধরনের পরিস্থিতিতেও রোগী বলতে পারে “আমি সাবস্টেন্স (মাদক) ছাড়বো না কারণ আমার সব বন্ধুরাই তো নেয়। এ ধরনের বক্তব্য থেকে তার মনোযোগ অন্যদিকে নেওয়ার জন্য বলা যেতে পারে-আপনি আপনার মত করে ভাবতেই পারেন, আমি আসলে আপনার বন্ধুদের কথা বলছি না। আমি শুধু এটুকুই বলছি বর্তমানে আপনি কি করছেন। এই সব কারণে যদি পরবর্তীতে আপনার জীবনে ক্ষতিকর কোনো কিছু ঘটে, সেই বিষয়ে আপনি কোনো পদক্ষেপ নিতে চান কিনা।
Roll with (অনুসরণ করে চলা)
রোগীর মতের বিপরীতে না গিয়ে তাকেই অনুসরণ করে যাওয়া। যে সব রোগী খুব বেশি মাত্রায় দ্বিমত পোষণ করে, সব ধরনের ধারণা এবং পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে, তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। যেমন,
রোগী- আমি সাবস্টেন্স (মাদক) ছাড়বো না, আমি বোঝাতে চাচ্ছি আমার সব বন্ধুরাই তো নেয়।
চিকিৎসক- যেহেতু আপনি ভাবছেন, আপনি ব্যবহার করতেই পারেন। আপনার এই ধরনের ভাবনার কারণে পরিবর্তন হওয়া খুবই কঠিন হবে। অবশ্য এটা আপনার ব্যাপার পরিবর্তন হবে কিনা।
Support Self-efficacy:
নিজের সক্ষমতা বা দক্ষতার উপর বিশ্বাস খুবই জরুরি। “আমি জানি আমি পরিবর্তন হতে পারবো।” এ ধরনের মনোভাব, আশা তার পথ চলাকে সহজ করে। ছোট ছোট সফলতাকেও উৎসাহ দিতে হবে অন্যথায় তার মধ্যে যে বৈষম্য তৈরি হলো তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতিরক্ষা মূলক (Defense) কৌশল হিসাবে মাদক নেয়ার পক্ষে যুক্তি দিতে পারে এবং ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করতে পারে। মনোবিজ্ঞানী বান্ডুরা বলেন, “একদিন বা প্রতিদিনের জন্য ভাল থাকা। এক বৎসর ভাল থাকবো কি থাকবো না সেটা পরের বিষয়”। এছাড়াও প্রেষণা মূলক সাক্ষাৎকার পদ্ধতিতে আরো কিছু থেরাপিউটিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়। এবং প্রেষণামূলক সাক্ষাৎকারের পারস্পারিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরো কিছু পদ্ধতিও রয়েছে।
পারস্পারিক যোগাযোগ (Interaction Style)
পারস্পারিক যোগাযোগের কিছু ধরণ,
Asking open-ended question (উন্মুক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা)
উন্মুক্ত প্রশ্ন করলে তার একটা দীর্ঘ উত্তর পাওয়া যায়। এজন্য শুধু হ্যাঁ বা না উত্তর আসে, এভাবে প্রশ্ন না করা। নিম্নে কতগুলো নমুনা দেয়া হলো,
মাদক (সাবস্টেন্স) ব্যবহার নিয়ে আপনার উদ্বিগ্নতা কি?
যদি আপনি কোন ভাবেই পরিবর্তন না হন তবে কি ঘটবে?
যদি আপনি ছেড়ে দেন তবে ভাল কি ঘটবে?
Affirming (সম্মতি-সূচক)
রোগীর শক্তি ও সামর্থ্যরে প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া করলে তার আত্মবিশ্বাস বাড়ে। সেই সাথে চিকিৎসক এর সাথে একটা আন্তরিকতার সম্পর্ক গড়ে উঠে। যেমন:
চিকিৎসকের কাছে আসার জন্য ধন্যবাদ জানানো।
আমি দেখছি আপনি পরিবর্তন হওয়ার জন্য সত্যিকারভাবেই একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ।
আপনার ধারণাটা আসলেই ভাল।
প্রতিফলিত শ্রবণ (Reflective Listening)
রোগী যা বলে সেটার অর্ন্তনিহিত অর্থটা বলা। রোগীর অনুভূতি চিকিৎসক নিজের মত করে বলে। এখানে রোগী তার অনুভূতিটা চিকিৎসকের ভাষায় জানতে পারে।
সারসংক্ষেপ (Summarizing)
রোগী যা বলে তার একটা সারসংক্ষেপ সেশনের মাঝে মাঝে এবং শেষে দেওয়া। এখানে পরিবর্তন বিষয়ে তার ইতিবাকে মনোভাব, উদ্বিগ্নতা, অনীহা ইত্যাদি বিষয়গুলোও আসবে। এর ফলে রোগী তার পরিবর্তন সম্পর্কে তার মনোভাব চিকিৎসকের ভাষায় আবারও জানতে পারে।
পরিবর্তনের পরিকল্পনার জন্য ওসার্কশীট তৈরি করা (Cpw-change plan worksheet)
কোন ধরনের পরিবর্তন চায়, কি কারণে চায়, এজন্য কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, কারা তাকে সাহায্য করতে পারে, কি ধরনের পদক্ষেপ নিলে সে তার পরিকল্পনা ধরে রাখতে পারবে এবং কি ধরনের পরিস্থিতিতে তার পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যেতে পারে ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় এর অর্ন্তভুক্ত থাকে।
প্রকৃতপক্ষে স্বল্প পরিসরে প্রেরণামূলক সাক্ষাৎকারের ভূমিকা ব্যাখ্যা করা কঠিন। পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি, নিজের সামর্থের উপর বিশ্বাস, পরিবর্তন বিষয়ক আলোচনায় তার আগ্রহ আছে কিনা, আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার বদ্ধ হওয়ার এই বিষয়গুলো পরিবর্তন সম্পর্কে তার ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করে। প্রেষণামূলক সাক্ষাৎকারে চিকিৎসক বিজ্ঞানসম্মত ভাবে সাক্ষাৎকার পরিচালনা করতে পারলে এক-চার সেশনের মধ্যেই রোগী মাদক (সাবস্টেন্স) ব্যবহার না করার অঙ্গীকার করবে।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleমাঝে মধ্যেই আমার হার্টবিট অনেক বেড়ে যায়, বুকে ধড়ফড় শুরু হয়
Next articleঅজানা মনের সুখ দুঃখ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here