বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানগত ধারণা থেকে যখন আমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হই, তখন সামাজিকতা সম্পূর্ণ করতে একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করি- ‘কেমন আছেন’ ? অথবা বলে থাকি ‘ভালো থাকবেন’ । অর্থাৎ যে কোনো মানুষের ‘সুস্থতা’ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় অথবা ‘সুস্থতা’ কামনা করা হয়। সুস্থতা বলতে আসলে আমরা কী বুঝি অথবা সুস্থতা বলতে কী বোঝায়। সুস্থতা বলতে কি বোঝায় যে কোন গড়নের একজন স্বাস্থ্য ভালো মানুষ কে ? আলোকপাত করা যাক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুস্থতাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেঃ- ‘Health is a state of complete Physical, Mental and Social Well-being, not merely an absence of diseases or infirmity’. অর্থাৎ শুধু শারীরিকভাবে একজন মানুষ সুস্থ হলেই হবে না, তাকে মানসিকভাবেও সুস্থ হতে হবে এবং সামাজিক ভাবে কর্মক্ষম হতে হবে।
সুতরাং শারীরিক স্বাস্থ্যের সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের এবং সামাজিকতার সম্পর্ক নিবিড়। কারণ এই বিশ্বে যত মানুষ আছে সকলেরই একটা ‘মন’ আছে। মন ছাড়া কোনো মানবজাতির অস্তিত্ব অকল্পনীয়, কারণ এর অবস্থান আমাদের মস্তিস্কে এবং যার প্রারম্ভিক বিকাশ শুরু হয় মাতৃগর্ভে, অর্থাৎ শুক্রাণু ও ডিম্বানু নিষেকের পর, ভ্রুণ অবস্থায় মাতৃগর্ভে আসার প্রথম তিন সপ্তাহের মধ্যে মস্তিস্ক তথা স্নায়ুতন্ত্র গঠন প্রক্রিয়ার সাথে সাথে। আর এ জন্যই গর্ভাবস্থায় পরিবারের সবাইকে মায়ের সাথে ভালো আচরণ, সঠিক যত্ন এবং বিনোদনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়, কারণ একটি স্বাভাবিক শিশু ৫ মাস বয়স থেকেই কানে শুনতে পায় এবং মনের স্বাস্থ্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশই হলো ‘আবেগ’। এই আবেগকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়- ‘ইতিবাচক আবেগ’ (আদর, ভালোবাসা, মায়া, মমতা, সুখ, আনন্দ ইত্যাদি) এবং ‘নেতিবাচক আবেগ’ ( রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, কষ্ট ইত্যাদি)। এই আবেগগুলো স্থান, কাল, পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, কেননা যে কোনো মানুষই তার চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করেন আবেগের মাধ্যমে। শুধু যে চিন্তারই বহিঃ প্রকাশ করছেন তা-ই নয়, সাথে সাথে সামাজিকতা সম্পন্ন করছেন। আর ভাষা হচ্ছে তার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। হোক তা বাচনিক অথবা অবাচনিক উপায়ে কিন্তু এই ভাষার বহিঃপ্রকাশ হতে হবে প্রতিবেশ এবং পরিবেশ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট, আর একেই বলে সামাজিকতা। মন যেহেতু থাকে মস্তিস্কে, সেহেতু মনের সাথে নিউরনের সম্পর্ক নিবিড়। যদিও এই নিউরনের গঠন শুরু হয় মাতৃগর্ভে কিন্তু নিউরনের সাথে নিউরনের আন্তঃ কোষীয় সংযোগ বা সাইনাপটিক কানেকশান শুরু হয় জন্মের পর এবং সম্পূর্ণ হয় তিন বছর পর্যন্ত, সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত নিউরনগুলো একে অপরের সাথে অবিরাম যুক্ত হতে থাকে। এই সংযোগগুলো একটি স্নায়ুবিক নেটওয়ার্ক’ তৈরি করে। এই স্নায়ুবিক নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হতে থাকে ‘জিন’ অর্থাৎ বংশগতির ধারক ও বাহকের সম্পৃক্ততা। কিন্তু মস্তিস্কের বিকাশ শুধুমাত্র জিনের কারসাজি নয়, বরং একটি শিশু পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে কী ধরনের উদ্দীপনা এবং অনুপ্রেরণা পেলো তার উপর হতে পারে এই উদ্দীপনা ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক, কারণ মন হচ্ছে মস্তিস্কের আন্তঃকোষীয় সংযোগের মাধ্যমে নিউরন থেকে নিউরনে ইলেকট্রনের অনুরন মাত্র, যার বহিঃপ্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো ভাষা। আর এ কারনেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয়, মন ও ভাষার সম্পৃক্ততা মস্তিস্কের আন্তঃকোষীয় সংযোগের সাথে। একটি শিশু ভবিষ্যতে কি হবে তা নির্র্ভর করে জন্মের প্রথম ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত শিশুটি তার নিজ পরিবার এবং পারিপাশ্বির্ক পরিবেশ থেকে কি ধরনের অনুপ্রেরণা পেল তার উপর। কারণ মস্তিস্কের আন্তঃকোষীয় সংযোগের মধ্যে যে সংযোগগুলো জন্মের পর বার বার ব্যবহৃত হয়, সেই সংযোগগুলো দীর্ঘকাল টিকে থাকে এবং যে সংযোগগুলো অব্যবহৃত হয়, সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং আমাদের সন্তানদের উদ্দীপনা দেওয়ার সময় আমাদের সর্বদাই মনে রাখতে হবে যে, ভাষার মাধ্যমে আমরা তাকে কী ধরনের উদ্দীপনা দিচ্ছি যা শিশুর মন অর্থাৎ মানসিক বিকাশের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে, কারণ আজকের শিশুই পরবর্তী প্রজন্মের জাতির ভবিষ্যত নির্ণায়ক।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।