ষাট বছর বয়সে উমা তাঁর স্বামীকে হারান। স্বামী ছিলেন তাঁর জীবনে এক শক্তিশালী আশা-ভরসার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। স্বামীর মৃত্যুর পরে উমা তাঁর সন্তানদের কাছে চলে যান। প্রথম প্রথম সন্তানরা মাকে ভালোভাবেই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই উমা দেখলেন যে তাঁকে বাড়িতে অধিকাংশ সময়ে একা থাকতে হচ্ছে। সেই সময় থেকেই সমস্যার সূত্রপাত হয়। সন্তানরা আশা করেছিল গুরুতর চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও তাদের মা নিজের দেখভাল নিজেই করতে পারবেন। সন্তানদের জীবনযাপন পদ্ধতি আলাদা হওয়ায় উমার খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রেও অনেক অসুবিধা হচ্ছিল। কিছুদিনের মধ্যে উমা দেখলেন যে খুব সামান্য ইচ্ছের কথা যেমন- বাড়ির কাছে অবস্থিত পার্কে যাওয়ার কথাও সন্তানদের কাছে জানাতে তাঁর বেশ দ্বিধা বোধ হচ্ছে। সন্তানরাও মায়ের উপরে খুব বিরক্ত হচ্ছে। তারা তাদের মায়ের সঙ্গে অত্যন্ত কম সময় কাটাচ্ছে; এমনকী পারিবারিকভাবে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও মাকে কদাচিৎ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এসব ঘটনায় উমার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব ও হতাশার বোধ জেগে উঠছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন না যে তাঁর কী করা উচিত।
এই কল্পিত আত্মকথাটি বাস্তব জীবনে বয়স্কদের উপর কীরূপ নির্যাতন নেমে আসে, তা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে।
বয়স্কদের নির্যাতনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বলেছে- বয়স্কদের উপরে নির্যাতন একবার বা একাধিকবার হতে পারে। অথবা যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য এই ঘটনা একজন বয়স্ক মানুষের বিশ্বাসভাজন সম্পর্কগুলোর দ্বারাই বেশি ঘটে। যার ফলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জীবনে ক্ষতি বা বিপর্যয় নেমে আসে। সম্প্রতি হেল্প-এজ ইন্ডিয়ার করা একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ৫০ শতাংশ বয়স্ক মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এরকম নির্যাতনের অনেক ঘটনার কথাই আমরা জানতে পারি না। কারণ সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে অনেক নির্যাতনের ঘটনাই অপ্রকাশিত থেকে যায়। নানা ধরনের নির্যাতন ঘটতে পারে, যেমন- মানসিক, মৌখিক বা যৌন এবং চরম পরিণতি হিসেবে দৈহিক বা শারীরিক নির্যাতন ঘটে। তবে নির্যাতন যেমন হয়, তেমন এই বিষয়ে মানুষের অবহেলাও রয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারী ব্যক্তি নির্যাতিতের সাবালক সন্তান বা তার পরিবারের অন্যান্য বিশ্বাসভাজন সদস্য হয়।
নির্যাতনের চিহ্ন এবং তার অবহেলার দিকগুলো কী কী?
- নির্যাতনের বাহ্যিক চিহ্ন- চোখে দেখা যায় এমন ক্ষত বা আঘাত, শরীরের কোনও অঙ্গ ভেঙে যাওয়া এবং স্থানচ্যুত হওয়া
- অপুষ্টির চিহ্ন- ঠিকঠাক খাবার খেতে না পাওয়ার জন্য হয়
- বয়স্কদের উদ্দেশ্যে নানারকম ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে কথাবার্তা বলা, যেমন- ”বুড়ো বয়সে বুদ্ধগয়ার মতো তীর্থস্থানে যাওয়াই দরকার, ধর্ম-কর্মে মন দেওয়াই জরুরি” প্রভৃতি
- বয়স্ক মানুষকে অন্যের বোঝা, মন্দের ভালো প্রভৃতি বলে নানাভাবে হেয় করার চেষ্টা করা হয়
- বয়স্কদের হাত থেকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় এবং তাদের ব্যবহৃত দরকারি জিনিসপত্র কিনতেও অস্বীকার করা হয়
- বড় ধরনের কোনও পারিবারিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও তাদের মতামত বা অংশগ্রহণকে অগ্রাহ্য করা হয়
- যথাযথ সময় না মেনে এমনসব খাবারদাবার বয়স্ক মানুষদের খেতে দেওয়া হয় যার সঙ্গে তাদের জন্য নির্ধারিত খাদ্যতালিকার কোনও মিল থাকে না
- বয়স্কদের এমন ছেঁড়া ও স্যাঁতসেঁতে জামাকাপড় পরতে দেওয়া হয় যার জন্য তাদের উশকোখুশকো দেখতে লাগে (যথাযথ দেখভাল করার গুরুতর অভাব)। এর জন্য তাদের ত্বকে সংক্রমণ হতেও দেখা যায়
বয়সজনিত কারণে একজন মানুষের মধ্যে শারীরিক ও বোধ-বুদ্ধিগত সক্ষমতার অভাব দেখা দিতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ নির্যাতন ও অবহেলার পিছনে পরিচর্যাকারীদের অসচেতনতা থাকে। সেই সঙ্গে বয়স্কদের পর্যাপ্ত নজরদারির ক্ষেত্রেও পরিচর্যাকারীদের যথাযথ জ্ঞান থাকে না। বয়স্কদের উপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে কীভাবে তার মোকাবিলা একজন পরিচর্যাকারী করবে তা নিয়েও কেউ সঠিক নিয়মের ধার ধারে না। যেসব ক্ষেত্রে বয়স্করা নিজেদের অবাঞ্ছিত এবং বোঝা বলে মনে করে, সেখানে পরিচর্যাকারীদের উচিত একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া।
অনেকসময়ে অর্থনৈতিক কারণেও নির্যাতন হতে পারে। এক্ষেত্রে বয়স্কদের কাছ থেকে সম্পত্তি বা টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের উপর নির্যাতন করা হয়। এই ঘটনার ফলে একজন বয়স্ক মানুষ নির্যাতনকারীর উপরে অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যার ফলে তারা মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয়। চরম পরিণতি হিসেবে বয়স্করা অন্যান্যদের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতে, যদিও তাদের সহায়তা করার মতো কেউই থাকে না।
আরেকটা কারণ হল, বয়স্করা যখন তাদের কাছের মানুষ এমন কোনও পরিচর্যাকারীর হাতে নির্যাতিত হয়, তখন তার পিছনে থাকে সেই পরিচর্যাকারীর প্রতিশোধ স্পৃহা। কারণ হয়তো এমন হতে পারে যে, আজকের বয়স্ক নির্যাতিত মানুষটির হাতেই ওই পরিচর্যাকারী তার ছোটবেলায় নানারকম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল।
বয়স্ক মানুষরা কেন তাদের নির্যাতনের কথা প্রকাশ্যে বলতে চায় না লজ্জা, অসহায়তার জন্য বয়স্করা তাদের উপর হওয়া নির্যাতনের কথা অন্য কাউকে বলতে চায় না। এমনকী, নির্যাতনের ঘটনায় তারা নিজেরাই নিজেদেরকে দোষ দেয়। তারা কীভাবে নিজেদের সমস্যার সমাধান করবে তা তারা বুঝতে পারে না। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং আত্মনির্ভরতার অভাব দেখা যায়। এর থেকেই তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, উদ্বেগের লক্ষণ ফুটে ওঠে। নির্যাতনের অন্য আরেকটা প্রভাব হল পাপবোধ জেগে ওঠা ও নিজেদের মৃত্যু কামনা করা। যে কোনও ধরনের নির্যাতনের ঘটনা একজন বয়স্ক মানুষের মানসিক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে থাকে। তাই সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধানের জন্য সমাজকর্মীদের সহায়তারও প্রয়োজন হয়।
যদি কোনও বয়স্ক মানুষ বোঝেন যে তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বা কারোর পরিচিত কোনও বয়স্ক মানুষ যদি নির্যাতনের শিকার হয় তাহলে আপনি বা আপনারা নাইটিংগেলস্ মেডিক্যাল ট্রাস্ট পরিচালিত এল্ডারস্ হেল্পলাইনের ১০৯০ নম্বরে সাহায্যের জন্য ফোন করতে পারেন।
সূত্র-
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4961478/
- http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/
S0140673604171444