মানুষ মাত্রই সুখের কাঙাল। আর সে সুখের মূল মন্ত্রই হচ্ছে একটি সুস্থ সুন্দর পারিবারিক জীবন। তাই পরিবারে স্বামী-স্ত্রী তথা অন্য সকল সদস্যের নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা খুব জরুরি। মূলত একটি পরিবার থেকেই সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। কারণ সমাজের প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনো পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
মানুষ তার পরিবার থেকেই সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়মকানুনের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে। পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় হলে সামাজিক সম্পর্কে এর প্রভাব পড়ে। পরিবারে শান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করলে সন্তানদের পরিবারবিমুখ হয়ে বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কাও কম থাকে।
পরিবার মূলত একটি শিক্ষাকেন্দ্র যার শিক্ষক হলেন বাবা-মা। সন্তানরা সর্বপ্রথম বাবামায়ের কাছ থেকেই পারিবারিক সংস্কৃতির আলোকে ভালোবাসা, আত্মত্যাগ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সাহসিকতা ইত্যাদি গুণ আত্মস্থ করার শিক্ষা পায়। যার ফলে সন্তানদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও সম্মান পেতে হলে নিজেদের পক্ষ থেকে অন্যকে সম্মান দেখানো শিখতে হবে যার চর্চা একটি দাম্পত্য জীবনের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শুরু করা দরকার।
‘উড়াব ঊর্ধ্বে প্রেমের নিশান দুর্গম পথ মাঝে’-চেতনে অবচেতনে এ মন্ত্র আগলেই সাধারণত শুরু হয় একটি দাম্পত্য জীবন। কিন্তু ইদানীংকালে আমাদের সমাজে বিয়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও পারিবারিক জীবন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। দাম্পত্য সম্পর্ক ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণ দিনে দিনে বাড়ছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দম্পতিদের অনেকেই বিয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনকারী অনেকের ভাষ্যমতে, বিয়ের আগে দীর্ঘদিনের পরিচয় থাকা স্বত্ত্বেও বিয়ের পরপরই তারা একে অন্যের অদ্ভুত রকমের আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ করেন। এক জনের প্রত্যাশার কাছে আরেকজন কৃতকার্য হতে ব্যর্থ হয়ে দুজনে আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আসলে বিয়ের আগে প্রতিটি ছেলে-মেয়েই বাবা-মায়ের অফুরন্ত স্নেহ-ভালবাসার ছায়ায় এক মমতাময় পরিবেশে বেড়ে ওঠে। বেশিরভাগ সময়ই বাবা-মা তাদের সন্তানদের দুঃখ, কষ্ট, ঝামেলা, যন্ত্রণা থেকে মুক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু বিয়ের পর শুরু হয় জীবনের নতুন এক অধ্যায়, যার প্রতিটি পৃষ্ঠাই অপরিচিত।
আমাদের সমাজে বিয়ে মানে দুই পরিবারের সম্পর্ক এবং সে ক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্যদের মানসিকতা, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ বিবাহিত দম্পতির সম্পর্ককে নানাভাবে প্রভাবিত করে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে একটি নতুন জীবন শুরু হয়। কিন্তু অনেকেই বিয়ে-পরবর্তী পরিবারের অযাচিত কর্তৃত্ব, আবদারের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খান। পরিণামে হয় স্বপ্নভঙ্গ। পরবর্তীতে বিচ্ছেদ অথবা অসুখী দাম্পত্যের ঘানি টানতে বাধ্য হয় জীবনভর। ফলস্বরূপ বাবা-মা উভয়ের স্নেহ-মমতায় বেড়ে ওঠার সৌভাগ্য হারিয়ে ফেলে অনেক ছেলে-মেয়ে যা তাদের সুস্থ মানসিক বিকাশের অন্তরায়। আমাদের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এখনো অধিকাংশ পুরুষ মননে কিংবা আদর্শে নিজের ইচ্ছাঅনিচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে স্ত্রীর ওপর কর্তৃত্ব করাকে অধিকার মনে করে। ভালোবাসার মানুষটির বিয়ের পর এ ধরনের পরিবর্তন অনেক স্ত্রীর পক্ষেই মেনে নেওয়া কষ্টকর হয়। তাছাড়া এই কর্তৃত্ববাদী আচরণ অনেক সময় নির্যাতন-নিপীড়নের জন্ম দেয়।
বিয়ে পূর্ববর্তী প্রত্যাশা আর বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধানের ফলেই শুরু হয় বিরোধ যা দাম্পত্য সম্পর্কেও অবনতি ঘটায়। দাম্পত্য সম্পর্কে অবনতি ঘটার বিভিন্ন কারণসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
- কর্তৃত্বপরায়ণতা
- অসংবেদনশীলতা
- অসহিষ্ণুুতা
- সন্দেহপ্রবণতা
- বিশ্বাসঘাতকতা
- কৃপণতা
- প্রতারণা
- ধৈর্যহীনতা
- শিষ্টাচারের অভাব
- অবহেলা
- নির্যাতন
- ক্রোধ
- অনৈতিকতা
- মিথ্যা বলা ইত্যাদি।
দম্পতি-বিষয়ক মনস্তাত্ত্বিক পিটার পিয়ার্সনের মতে, একই মূল্যবোধ ধারণ করে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া হচ্ছে সম্পর্কের মূল ভিত্তি এবং এটাই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখে। স্বামী-স্ত্রী হচ্ছে পরস্পরের অতি আপন। একে অপরের সব দোষ-ত্রুটি মেনে নেয়ার মানসিকতা নিয়েই দাম্পত্যের পথে হাঁটা উচিত। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার মধ্য দিয়েই দাম্পত্য জীবন সুখী ও সমৃদ্ধ হয়। দাম্পত্য জীবনে একজনের সাফল্য-ব্যর্থতা কিংবা উন্নতি-অবনতিকে অপরজনেরও নিজের হিসেবে মেনে নেয়া দরকার।
দাম্পত্য সম্পর্কে দুইজনের যেমন কিছু অধিকার রয়েছে, তেমনি কিছু দায়িত্বও আছে। অধিকার ও দায়িত্ববোধের সমন্বয় তৈরি করাই একটি সুখী দাম্পত্যের মূল শক্তি। ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে দুইজনের মিলিত ইচ্ছায় দাম্পত্যর চাকা ঘোরানোর ব্যবস্থা করতে পারলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। কাজেই একটি সুখী দাম্পত্য জীবনের মূলনীতি হচ্ছে :
- সমঝোতার মনোভাব
- সকল কাজে সহযোগিতার মনোভাব
- দায়িত্ববোধ
- পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ
- ভালোবাসা
- সহমর্মিতা
- ত্যাগ
- স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা
- যেকোনো সিদ্ধান্তে পরস্পরের মতামত ও পছন্দ অপছন্দের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া
- ধৈর্যশীলতা
- বিশ্বাসপরায়ণতা
- নমনীয়তা
- সহনশীলতা
- পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিরোধ এড়িয়ে চলা ইত্যাদি।
কিন্তু সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না। দুজনই একজন আরেকজনের ওপর থাকতে চায় সব ব্যাপারেই। কেউ কাউকে সম্মান করতে চায় না। একই ছাদের নিচে থেকেও সামান্য অসঙ্গতিতে একজন আরেক জনের ওপর চড়াও হয়। এসব ক্ষেত্রে সংঘাত এড়িয়ে নিজেদের মধ্যকার অনুভূতির আলোকে সমঝোতাটা করতে পারলেই দাম্পত্যের পালে জীবনভর সুখের ছোঁয়া লাগিয়ে রাখা সম্ভব।
পরিশেষে অন্য রকম একটি গবেষণার পর্যবেক্ষণ বলতে চাই। মার্কিন গবেষকেরা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখেছেন যে, স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে ইতিবাচক কথাবার্তায় হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। গবেষকেরা এই গবেষণার জন্য ২৮১ জন মধ্যবয়সী দম্পতির তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষকেরা দাবি করেছেন, আবেগের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে জড়িত থাকে ইতিবাচক কথাবার্তা যা স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তাই তাঁরা সব পরিস্থিতিতেই সময় বের করে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে নিজেদের মধ্যে ইতিবাচক আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন। স্বামীস্ত্রীর নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা ও একে অন্যের প্রতি ভরসা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করে। এজন্য আমরাও চাই পৃথিবীর সকল দম্পতির মনে ও মুখে প্রতিদিন উচ্চারিত হোক – ‘কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয় তুমি আছো, আমি আছি’।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে