গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত হাসপাতালে ভর্তি বেশ কিছু রোগীদের বলতে শুনেছি, “ডাক্তার সাহেব আপনার বিশ্বাসের সাথে আমার বিশ্বাস মিলে না বলেই আপনি আমাকে মানসিক রোগী বলবেন!” এটা নিয়ে মাঝে মাঝে ভেবেছি, আসলেই ব্যাপারটা কেমন। পরে পুস্তকের বিদ্যার সাথে মেলানোর চেষ্টা করেছি। এই সমস্যার সমাধানের জন্য পুস্তকে বিস্তারিত বলা আছে যদিও সেগুলা দিয়ে ওই রোগীদের বোঝানো যায় না। এটাকে বিশ্বাসের রোগ বা ভ্রান্ত বিশ্বাস বা Delusion বলে।
Delusion একটা গুরুত্বর মানসিক রোগের লক্ষণ। এটাকে ইদানিং ভুল বা ভ্রান্ত বিশ্বাস অনেকেই বলতে চান না। এটা এমন একটা শক্ত বিশ্বাস যা কেউ ধারণ করেন অসম্পূর্ণ ভিত্তির ওপর, তার বিপক্ষে তথ্য যুক্তি দেওয়া সত্ত্বেও নাড়ানো যায় না, যে বিশ্বাস ব্যক্তির শিক্ষাগত, সামাজিক, ধর্মীয় ও কালচারাল ভিত্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটা অনেক প্রকার আছে এবং অনেক ভাবে প্রকাশ পেতে পারে। একেক রোগে একেক রকমভাবে দেখা যেতে পারে এবং অসংখ্য প্রকার ব্যাতিক্রম দেখা যেতে পারে। যেমনঃ একজন মানুষ বিশ্বাস করেন তার বাবা মা তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করতেছেন। এটা কোনো ভিত্তি দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় না; এটা Delusion। আবার একজন মানুষ বিশ্বাস করেন জ্বীন তার ওপর ভর করেছে এটা আমেরিকা সমাজে Delusion কিন্তু আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট দিয়ে হয়তও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের জন্য এটা Delusion নাও হতে পারে। আবার একজন বেকার মানুষ হঠাৎ করে বিশ্বাস করা শুরু করলেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন বা হয়েছেন যেটা কিনা কোনো দিক বিচার করে সম্ভব বলে মনে হয় না; সুতরাং এটা Delusion। একজন লোক মনে করেন আশেপাশের প্রতিবেশীরা তার ক্ষতি করবেন বা মেরে ফেলবেন, কথা বলে দেখা গেলো আসলেই তাদের সঙ্গে উনার ঝগড়া হয়েছে এবং তারা হুমকি দিচ্ছেন। এটা Delusion নয়। কিন্তু যদি এগুলা না ঘটে থাকে এবং অমূলক ভাবে উনি বলতে থাকেন তাহলে সেটা Delusion হবে। সুতরাং কোনো একটা বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বলা বেশ কঠিন। ওই ব্যক্তির সার্বিক অবস্থা মিলিয়ে এই রোগ নির্ণয় ও পরিমাপ সম্ভব। এটা গেলো বিশ্বাসের রোগ।
রোগের বিশ্বাস
আমরা যখন কোনো রোগে আক্রান্ত হই তখন সেই রোগটা কি, কেমন সাংঘাতিক, আমাদের কি করা প্রয়োজন ইত্যাদি ভাবতে থাকি এবং সেটা অনুযায়ী রোগ সারানোর চেষ্টা করতে থাকি। সুতরাং রোগ সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস কেমন সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটা মূলত তৈরি হয় ওই রোগ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান, আমাদের পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা, আমাদের ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি মিলিয়ে।
বিশ্বাসের রোগ ও রোগের বিশ্বাস আমাদেরকে কেমনভাবে প্রভাবিত করতে পারে সেটা নিয়ে অতিসংক্ষেপে একটু বলি। যার বিশ্বাস যে তার কোনো রোগ নাই, তিনি বিশ্বাসগত কারণেই চিকিৎসা সেবা নিতে চাইবেন না। অন্যরা নেওয়াতে চাইলে তাদেরকে শত্রু মনে করবেন এবং যদিও জোর করে একবার দুইবার নেওয়ানো হয় এবং ওনার বিশ্বাসকে ফেরানো না গেলে লম্বা সময়ের জন্য চিকিৎসা চালানো কষ্টকরই বটে। সাথে সাথে ওনার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, পেশাগত, অর্থনৈতিক জীবনে ব্যাঘাত চলতেই থাকে। যাদের আক্রান্ত রোগ নিয়ে সঠিক বিশ্বাস বা ধারণা থাকে না তারাও বিভিন্ন ভাবে ভোগান্তির শিকার হতে থাকেন। যেমনঃ একজন মানুষের জ্বর হওয়াতে উনি মনে করতে থাকলেন উনার এইডস হয়েছে তাহলে নিশ্চয়ই ওই লোকের আচরণ ভিন্ন রকম হবে এবং সেটা উনি নিজে সহ আরও অনেককেই অকারণ ব্যস্ত করে তুলবে। আবার একজনের ক্যান্সার হয়েছে উনি মনে করতে থাকলেন ওনার তেমন কিছুই হয়নি যার জন্য চিকিৎসা নেয়ার দরকার আছে; যার পরিণতি কখনোই ভালো হতে পারে না। সুতরাং একটা রোগ সম্পর্কে রোগীর কি বিশ্বাস এবং রোগটা আসলেই সে রকম কিনা সেটা রোগীকে জানানো চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দুটোর সমন্বয় সাধন জরুরি। ডাক্তারের জন্য মানায় নেওয়া এবং রোগীর জন্য মানিয়ে নেওয়া দরকার। মানসিক রোগের সেবার সাথে জড়িত হয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত হিমশিম খাই রোগীর রোগ সম্পর্কে বিশ্বাস বদল করতে।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।