প্যানিক ডিজঅর্ডার এমন একটি মানসিক ব্যাধি, যা ইদানীং প্রচুর শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে বর্তমানে চলমান অতিমারির কারণে মানুষের মধ্যে নানা অনিশ্চয়তা এবং ভীতি জন্মাচ্ছে।
প্যানিক ডিজঅর্ডারের কারণে মানুষ নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এ সময় মানুষ তার মানসিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওষুধের ওপর আস্থা রাখার ভুল চেষ্টা করে থাকে, যা জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এমন এক পরিস্থিতিতে প্যানিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত না হতে চাইলে বা হলেও নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাইলে বড় উপায় হতে পারে আকুপ্রেশার।
প্যানিক ডিজঅর্ডার কী
প্রথমে যে নেতিবাচক চিন্তাটা মাথায় আসে তাহলো, শরীরে অস্বস্তি অনুভব করা, হাঁটতে মন চায় না, বসে থাকতে ইচ্ছে করে না, শুলে ঘুম আসে না, মনের ভেতর প্রচণ্ড চিন্তা আসে যে মৃত্যুভয় কাজ করে, আমার মারাত্মক অসুখ হয়েছে, ডাক্তাররা কিছুই ধরতে পারছেন না।
আমি আর সুস্থ হব না, মনে হয় প্রেশার বেড়ে গেছে কিন্তু মাপলে দেখা যায় প্রেশার ঠিকই আছে। মনে হতে থাকে বুকে ব্যথা, হয়তো হার্টফেল করবে। কেউ তার কষ্ট বুঝতে পারছে না। পৃথিবীটা অশান্তিময় স্থান মনে হয়। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা বন্ধ হয়ে যায়।
প্যানিক কেন হয়
প্যানিক ডিজঅর্ডার মূলত আমাদের স্নায়ুতন্ত্র অটোনমিক সিস্টেমের দুটি অংশ আছে। সিম্প্যাথেটিক ও প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম। আমরা যখন কোনো কারণে নিজেদের বিপদাপন্ন মনে করি, ভয় পাই বা নার্ভাস হয়ে পড়ি, তখন আমাদের শরীরের সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়ে যায়।
এই সময় অ্যাড্রেনালিন নামক একটি বিশেষ হরমন ক্ষরণ হতে থাকে, যা আমাদের দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি ও অঙ্গকে আসন্ন বিপদ মোকাবিলায় প্রস্তুত করে তোলে। শরীর চঞ্চল হয়ে ওঠে, অ্যাড্রেনালিন অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ এবং পরিপাক প্রক্রিয়ায় রক্ত সংবহন কমিয়ে দিয়ে স্নায়ু, মাংসপেশি এবং মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়, এটি হৃৎস্পন্দন কমায়। এভাবে আমাদের দেহে আক্রমণ থেকে অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চিত হয়।
কিন্তু এই অ্যাড্রেনালিন যদি সঠিক উপায়ে কাজ না করে, নেতিবাচক চিন্তায় আমরা নিজেকে আটকে রাখি, আমরা দীর্ঘদিন মানসিক উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে যাই, তখন আমাদের মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। যার কারণে আমরা তুচ্ছ বিষয়েরও অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা করে বিপজ্জনক হিসেবে ধরে নেই।
ফলে একে বিপদ হিসেবে ধরে নিয়ে সৃষ্ট তথাকথিত বিপদ আর শিগগিরই কাটে না (কারণ আসলে তো কোনো বিপদই নেই)। তবে দেহ এটিকে বিপদ হিসেবে ধরে নেয়, ফলে দীর্ঘ সময় ধরে সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম সক্রিয় থাকে এবং আমরা উৎকণ্ঠিত বোধ করি।
প্যানিক ডিজঅর্ডারের উপসর্গ
ক. বুক ধড়ফড় করা, হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা
খ. তীব্র আতঙ্ক
গ. বুকে ব্যথা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
ঘ. অবশ বা অজ্ঞান হওয়ার অনুভূতি সৃষ্টি
ঙ. দেহে কাঁপুনি সৃষ্টি হয় এবং প্রচুর ঘাম হওয়া
চ. দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাওয়া, হাত-পায়ে ঝিনঝিন করা
ছ. পেটে গন্ডগোল, ভুটভাট শব্দ হওয়া
জ. বিভিন্ন ধরনের ভয়ের চিন্তা মাথায় আসা। যেমন- এখনই মারা যাবো, কেউ বাঁচাতে পারবে না ইত্যাদি
এমন অবস্থা যাদের আছে, তারা নিয়মিত আকুপ্রেশার করে নিজেকে সুস্থ রাখতে পারবেন। আর যাঁরা অনুভব করছেন যে নিজের ভেতর এমন কিছু উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, নিয়মিত না হলেও মাঝেমধ্যে এমন হচ্ছে, তখন আকুপ্রেশার শুরু করে এই প্যানিক ডিজঅর্ডার শুরুতেই থামিয়ে দেওয়া সম্ভব।
কীভাবে আকুপ্রেশার করবেন
আকুপ্রেশার শুরুর প্রথমে দুই মিনিট দুই হাতের তালু ঘষে নিন। এমনভাবে ঘষবেন, যেন হাতের তালু দুটি গরম হয়ে যায়। হাত গরম হলে শরীরে এক ধরনের চাঙা ভাব চলে আসবে। এরপর ছবিতে দেওয়া প্রথম পয়েন্ট পিটুইটারি গ্লান্ডের পয়েন্ট, এই পয়েন্টে ১০০ বার ধীরে ধীরে চাপ দিন, চাপ হতে হবে মাঝারি ধরনের। খুব বেশি জোরেও না, খুব আস্তেও না। দুই হাতেই ১০০ বার করে চাপ দিন।
দ্বিতীয় পয়েন্ট অ্যাড্রিনাল পয়েন্ট। এটিও ১০০ বার ধীরে ধীরে চাপ দিন। এখানেও চাপ হতে হবে মাঝারি মানের। খুব বেশি জোরেও না, খুব আস্তেও না। দুই হাতেই ১০০ বার করে চাপ দিন। সাধারণত প্রতিটি প্যানিক অ্যাটাকের স্থায়িত্বকাল দশ থেকে পনেরো মিনিটের মতো হয়।
তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আধা ঘণ্টারও অধিক হতে পারে। সাধারণত পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এ ব্যাধির বিস্তারের হার অধিক। যেকোনো বয়সেই দেখা দিতে পারে, তবে কিশোরদের সর্বাধিক ঝুঁকি থাকে।
তৃতীয় পয়েন্ট হলো হার্ট পয়েন্ট। এটিও ১০০ বার ধীরে ধীরে চাপ দিন। চাপ হবে মাঝারি ধরনের, খুব বেশি জোরেও না খুব আস্তেও না। এতে হার্টে শক্তি সঞ্চিত হবে, বুকে ব্যথা থাকলে কিংবা চাপ অনুভূত হলে তা কমে আসবে, হার্টরেট কমে আসবে। এটি শুধু বাঁ হাতেই আছে, তাই এক হাতেই করতে হবে।
চতুর্থ পয়েন্ট, হাতের কজ্বির এক ইঞ্চি সামনে, সেখানেই দুই হাতে ১০০ বার ধীরে ধীরে চাপ দিন। একইভাবে চাপ মাঝারি ধরনের হবে, খুব বেশি জোরেও না খুব আস্তেও না। এই পয়েন্টে চাপ দিলেই পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বুক ধড়ফড় করলে তা থেমে যাবে।
প্যানিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সব সময় উৎকণ্ঠায় থাকেন, অসুখ বাড়ল কি না, তা খতিয়ে দেখতে সার্বক্ষণিক শরীরের ওপর কড়া নজরদারি চালিয়ে যান। কেউ কেউ মিনিটে কতবার শ্বাস নিচ্ছেন, সেটা পরিমাপ করতেও বাদ রাখেন না। কিন্তু এই খুঁতখুঁতে স্বভাব যাদের, তাদের রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ না করে বিপরীত কাজ করে। এই পয়েন্টে চাপ দিলে নেতিবাচক মনোভাব দূর হয়ে যাবে।
প্যানিক ডিজঅর্ডারের পেছনে বেশ কটি রিস্ক ফ্যাক্টর কাজ করলেও মূলত মস্তিষ্কে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ও হরমনের ভারসাম্যহীনতা এর জন্য দায়ী। এছাড়া হাইপারথাইরয়েডিজম, হাইপোগ্লাইসিমিয়া, মাইট্রাল ভালভ প্রলাপস ইত্যাদি রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্যানিক ডিজঅর্ডার হতে পারে।
রোগীর ভ্রান্ত ধারণা দূর করা এবং তাকে বোঝাতে হয় যে এ রোগের জন্য মৃত্যু হবে না এবং এ সমস্যা কয়েক মিনিটের মধ্যে এমনিতেই চলে যাবে। রোগীকে শেখাতে হবে যে প্যানিক অ্যাটাকের সময় কীভাবে আকুপ্রেশার করে এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ও রাতে শোয়ার আগে আকুপ্রেশার করতে হবে।
করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে