চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। রোবট বা মেশিনেরা মানুষের জীবন সহজ করে তুলছে। সেইসঙ্গে দখল করে নিচ্ছে মানুষের পেশা বা কর্মস্থল।
এটিএম মেশিন এসে নিয়ে নিয়েছে টেলার বা ক্যাশিয়ারের চাকরি। সামনে এমন আরো অনেক কাজই চলে যাবে মেশিনের হাতে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, থ্রি-ডি প্রিন্টার আর ন্যানো টেকনোলজির যুগে রোগ নির্ণয় কিংবা দালান নির্মাণ থেকে শুরু করে আইনি সহায়তার জন্যও আমরা রোবটের দ্বারস্থ হবো।
এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন মানুষের প্রযুক্তিগত দক্ষতানির্ভর কাজগুলো মেশিনই করে দিতে পারছে, তখন মানসিক দক্ষতার চাহিদা হু হু করে বাড়ছে। এই দক্ষতাগুলোকে বলা হচ্ছে সফ্ট স্কিল।
সামাজিক বা যোগাযোগ দক্ষতা, ব্যক্তিত্বের ধরন, আবেগীয় বা সামাজিক বুদ্ধিমত্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, উন্মুক্ত মানসিকতা, দায়িত্বজ্ঞান, সময়ানুবর্তিতা, নেতৃত্বগুণ, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, সৃজনশীলতা এবং কল্পনা ক্ষমতা এগুলো সবই সফ্ট স্কিল। যাদেরকে বলা হচ্ছে নতুন যুগের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী দুরন্ত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই এগিয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত নতুন কিছু না কিছু যোগ হচ্ছে।
জীবনধারণের ধরন থেকে কাজের ধরন সবকিছুতেই পরিবর্তন আসছে অনবরত। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা বা মানিয়ে নেয়ার জন্য ওপরোক্ত দক্ষতাগুলো ভীষণ জরুরি। কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত দক্ষতা আয়ত্ত করে জীবন কাটিয়ে দেয়ার মতো পরিস্থিতিতে আমরা এখন আর নেই।
আমাদেরকে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু না কিছু শিখতে হচ্ছে। করোনা প্যান্ডেমিকই তার উৎকষ্ট উদাহরণ। শেষ বয়সে গিয়েও অনেককেই টেকনোলজির নানা কিছু নতুন করে শিখতে হয়েছে। এই নতুন নতুন দক্ষতা আয়ত্ত করার ক্ষেত্রে তারাই এগিয়ে থাকবে যারা সফ্ট স্কিলগুলোয় ইতিমধ্যেই দক্ষ।
তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হলো কল্পনা-ক্ষমতা। মানুষ কল্পনা-ক্ষমতা প্রয়োগ করে যেমন অনেক কঠিন কঠিন সমস্যা সমাধান করতে পারে, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনাও করতে পারে। আসন্ন কোনো জটিল পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, কেবল কল্পনা-ক্ষমতা প্রয়োগ করেই মানুষ সে বিষয়ক প্রস্তুতি নিতে পারে।
নতুন কোনো আইডিয়া, সৃজনশীল কোনো চিন্তা সবই কল্পনা ক্ষমতার প্রয়োগ। বর্তমানে একটি অভিনব চিন্তাধারার মূল্য অনেক অনেক বেশি। গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব থেকে শুরু করে আধুনিক কালের সব বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই শুরুতে কেবল একটি আইডিয়া ছিল।
কর্মক্ষেত্রে বা পেশাগত জীবনে কল্পনা-ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর জন্য আরো দুইটি সফ্ট স্কিলের উল্লেখ করতে হয়, সৃজনশীলতা এবং সমস্যা সমাধান। কল্পনা-ক্ষমতার সঙ্গে এই দুটি দক্ষতার বেশ নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
পেশাগত জীবনে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, সমস্যা সমাধান করতে হয়। সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমে সমস্যাটা বুঝতে হয়। সমস্যা বুঝতে গিয়ে কল্পনাপ্রবণ মানুষেরা গতানুগতিকতার বাইরেও অনেক কিছু দেখতে পান। নানা রকম কানেকশন আর প্যাটার্ন তাদের চোখে-মনে ধরা পড়ে। যেখান থেকে তারা অভিনব উপায়ে সেই সমস্যার সমাধান করতে পারেন।
যেকোনো প্রজেক্ট বা কাজ মাঠে নামানোর আগে প্রয়োজন হয় পুঙ্খান পুঙ্খ পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজন কল্পনাক্ষম মানুষ। এই মানুষগুলোকে বলা হয় ”what if people”। তারা একটি পরিস্থিতিকে নানাভাবে দেখতে পারেন এবং প্রশ্ন করেন, যদি এটা হয়? যদি এভাবে না হয়ে ওভাবে হয়? যদি এটার পরিবর্তে ওটা হয়?
মাঠে নামার পরে সাম্ভাব্য কী কী ঘটতে পারে, তার সবই পরিকল্পনা-টেবিলে নিয়ে আসতে পারলে সেগুলোর জন্য প্রস্তুত থাকা যায় এবং অর্ধেক কাজ ওখানেই হয়ে যায়। আর সেজন্য প্রয়োজন কল্পনা ক্ষমতা।
কল্পনা-ক্ষমতা যে পেশাগত জীবনে বা কর্মক্ষেত্রে জরুরি, সেটা তো বোঝা গেল। কিন্তু কীভাবে এর প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব। পেশাগত জীবনে হোক আর ব্যক্তিগত জীবনে, কল্পনা ক্ষমতা চর্চা করার জন্য নিচে উল্লিখিত কাজগুলো করা যেতে পারে-
১. চারপাশে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করুন। শুধু দেখা বা সেটা নিয়ে চিন্তা করা না, তার ভেতর-বাহির সবকিছু যত সূক্ষ্মভাবে পারা যায় পর্যবেক্ষণ করুন।
২. প্রশ্ন করুন। নানা ধরনের প্রশ্ন করুন, সেটা যত উদ্ভটই লাগুক না কেন। নিজের কাছে নিজে এবং অন্য মানুষের কাছেও প্রশ্ন করুন।
৩. আপনার চিন্তা/পরিকল্পনাগুলো নিয়ে কথা বলুন। আড্ডা দিন। নানা ধরনের, নানা চিন্তার মানুষের কাছে আপনার চিন্তা-ভাবনাগুলো প্রকাশ করুন।
৪. মনকে যতটা সম্ভব উদার-উন্মুক্ত করুন। নতুন চিন্তা, নতুন ধারণার প্রতি ইতিবাচকতা প্রকাশ করুন। যতটা সম্ভব নমনীয়তা চর্চা করুন।
৫. গতানুগতিকতার বাইরের বিষয়-আশয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করুন।
৬. চিন্তা-ভাবনাগুলোকে চিত্রিত করার চেষ্টা করুন। গ্রাফ বা ছক বা টেবিল করুন। এতে নতুন নতুন প্যাটার্ন বা কানেকশন নজরে আসবে।
৭. নিয়মিত কিছু না কিছু পড়ুন।
৮. নিয়মিত নিজের চিন্তা-ভাবনাগুলো লেখার চর্চা করুন।
৯. চিন্তামুক্ত নির্ভার থাকা খুবই জরুরি। নিয়মিত রিল্যাক্সেশন করা, ব্যায়াম করা, স্ট্রেস ম্যানেজ করা ও ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স বজায় রাখার চেষ্টা করুন।
অফিসে কল্পনাক্ষম ও সৃজনশীল পরিবেশ আনার জন্য ডাইভার্সিটি বা বৈচিত্র্যের প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। কর্মীবাহিনীর মাঝে যত জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সামাজিক বৈচিত্র্য থাকবে; যত ভিন্ন মত, চিন্তা-ধারা, মনোভাব, ব্যক্তিত্ব থাকবে কর্ম পরিবেশ তত নমনীয় ও কল্পনাক্ষম হবে। সেইসঙ্গে মাঝে মধ্যেই কাজের ধরন ও পরিবেশে পরিবর্তন আনা উচিত-ব্যতিক্রমী কিছু করা উচিত।
সর্বোপরি, গতানুগতিক দৈনন্দিন পুনরাবৃত্তিমূলক শারীরিক পরিশ্রমের কাজগুলোÑযেগুলোয় খুব একটা মস্তিষ্ক খাটাতে হয় না এসব কাজগুলো ধীরে ধীরে সব মেশিন বা রোবটের হাতে চলে যাবে।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তাই আমাদেরকে বিশ্লেষণাত্মক মনোভাব গঠন করতে হবে। সৃজনশীল আর কল্পনাক্ষম হতে হবে। মস্তিষ্কগত ও মানবিক গুণগুলোকে বেশি বেশি চর্চা করতে হবে।
ফিরোজ শরীফ
মনোবিদ।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে