পারকিনসন্স কী?
পার্কিনসন্স-এ আক্রান্ত হলে আমাদের স্নায়ুকোষ ধ্বংস হয়ে যায়, যার ফলস্বরূপ শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনে সমস্যা দেখা দেয়। মস্তিষ্কে ডোপামিন নামে একটি রাসায়নিকের ঘাটতির জন্য এটা হয়ে থাকে। যদিও এই রোগটি সংক্রামক নয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি। এবং সময়ের সঙ্গে পার্কিনসন্স রোগীর অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। বলাই বাহুল্য, এই রোগের কোনও চিকিৎসা নেই।
পার্কিনসন্স কেন হয়?
চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের কাছে এই রোগের সঠিক কারণ আজও অজানা। তবে দেখা গেছে কিছু জিনগত বা পরিবেশগত কারণে পার্কিনসন্স-এর ঝুঁকি বেড়ে যায়। যদিও এর উপসর্গ ব্যক্তি বিশেষে আলাদা হতে পারে।
- জিনগত কারণঃ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, বিশেষ কিছু জিনগত পরিবর্তনের ফলে পার্কিনসন্স-এর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই ব্যাপারে আরও জানার জন্য গবেষণা চলছে।
- পরিবেশগত কারণঃ প্রচুর বিজ্ঞানী এই ব্যাপারে একমত যে, কয়েক ধরনের বিষের সংস্পর্শে আমাদের স্নায়ুকোষগুলি ডোপামিন নিঃসরণ বন্ধ করে দেয়।
- অন্যান্য কারণঃ
- বয়সঃ বয়স এই রোগের একটি মূল কারণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরা এই রোগের শিকার হন।
- লিঙ্গঃ মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের এই রোগ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- পারিবারিক ইতিহাসঃ পরিবারের ঘনিষ্ঠতম কারওর (যেমন বাবা-মা বা ভাই-বোন) যদি পার্কিনসন্স হয়ে থাকে তাহলে আপনার এই রোগে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা প্রবল।
- মাথায় আঘাতঃ দুর্ঘটনার কারণে মাথায় চোট পেলে বা সেই জন্য কোনও মানসিক আঘাত থেকেও পার্কিনসন্স হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।
পার্কিনসন্স-এর উপসর্গগুলি কী?
প্রথম দিকে পার্কিনসন্স-এর উপসর্গগুলি কম থাকার জন্য আলাদা করে চেনা যায় না। কিন্তু ধীরে ধীরে তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
নীচে কিছু উপসর্গের উদাহরণ দেওয়া হলঃ- হাত-পা কাঁপার জন্য কাজকর্ম করতে সমস্যা দেখা দেয়।
- মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়ার দরুন যন্ত্রণা।
- টানা বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে না পারা, এমনকী ঠিকমতো হাঁটা চলাও না করতে পারা।
- কথা বলতে বা ঢোঁক গিলতে অসুবিধা।
- লিখতে না পারা।
- স্নায়ুতন্ত্র ব্যপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হবার কারণে আমাদের ঘ্রাণশক্তি নষ্ট হবার পাশাপাশি ঘুমোতে বা মল-মূত্র ত্যাগ করতেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কোনটি পার্কিনসন্স নয়?
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। একজন বৃদ্ধ ব্যক্তিও হাঁটতে গিয়ে পড়ে যেতে পারেন, আবার ঠান্ডা লাগার কারণে কোনও কিছুর গন্ধ নাও পেতে পারেন। কোনও পুরানো চোট বা বাতের ব্যথার জন্যও হাত-পা নাড়াতে সমস্যা হতে পারে। এর সঙ্গে পার্কিনসন্স-এর কোনও সম্পর্ক নেই।রোগ নির্ণয় পদ্ধতি
এই ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট পদ্ধতি না থাকার দরুন ডাক্তারদের পক্ষে পার্কিনসন্স রোগকে চিহ্নিত করা খুব কঠিন। শেষ মতামত দেওয়া আগে বা অন্যান্য রোগের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া উদ্দেশ্যে ডাক্তাররা প্রথমে রোগীর মস্তিষ্ক ও স্নায়ু পরীক্ষা করে থাকেন।পার্কিনসন্স রোগের চিকিৎসা
পার্কিনসন্স সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে তোলা না গেলেও নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি ও সঠিক ওষুধের সাহায্যে এর উপসর্গগুলি কমানো সম্ভব। জীবনযাত্রায় সামান্য পরিবর্তন, যেমন নিয়মিত ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস, খাদ্যতালিকায় ভারসাম্য বজায় রাখা,পর্যাপ্ত ঘুম এবং মস্তিষ্ককে যতটা সম্ভব ক্রিয়াশীল রাখতে পারলে পার্কিনসন্সকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ফিজিওথেরাপি এবং স্পিচ থেরাপির সাহায্যে আক্রান্ত ব্যক্তির অঙ্গসঞ্চালন এবং কথা বলার সমস্যাও কমানো যায়।পার্কিনসন্স-এর সঙ্গে ডিপ্রেশন
দেখা গেছে যে, পার্কিনসন্স-এর সঙ্গে যুঝতে গিয়ে রোগী অনেক সময়েই ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটির মতো ক্লিনিক্যাল সিন্ড্রোমের শিকার হন। মস্তিষ্কের মধ্যে দ্রুত রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে মানসিকতারও পরিবর্তন হতে থাকে। এই ক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের সঠিক চিকিৎসা না হলে রোগীর জীবন আরও দুর্বিসহ হয়ে উঠতে পারে।আপনার প্রিয়জনের পরিচর্যা
প্রিয়জন যদি দুর্ভাগ্যবশত পার্কিনসন্স-এ আক্রান্ত হন, সেটা তাঁর পক্ষে তো বটেই, আপনি এবং আপনার পরিবারের পক্ষেও খুব কঠিন পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়াবে। এই অবস্থায় রোগীর পরিচারক হিসেবে আপনার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যেহেতু এই রোগের সম্পূর্ণ নিরাময় অসম্ভব, ফলে সারা জীবন রোগীর দায়িত্ব নেওয়াটা আপনার কাছে হতাশাজনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে এবং ক্লান্তিতে আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যপকহারে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। রোগীর স্বার্থেই আপনার নিজের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা অত্যন্ত প্রয়োজন। সেই ক্ষেত্রে আপনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞেরও পরামর্শ নিতে পারেন।পার্কিনসন্স সম্বন্ধে কয়েকটি ভুল ধারনা ও বাস্তব
ভুল ধারনাঃ পার্কিনসন্স-এ শুধুমাত্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়।
বাস্তবঃ আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে রোগীর মধ্যে বিভিন্ন নন-মোটর উপসর্গ, যেমন ঘ্রাণশক্তি হ্রাস পাওয়া, অনিয়মিত ঘুম, কোষ্ঠকাঠিন্য, যৌন-জীবনে সমস্যা, বোধশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শারীরিক যন্ত্রণা বা ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা এবং হতাশা দেখতে পাওয়া পার্কিনসন্স-এ যায়।
ভুল ধারনাঃ পার্কিনসন্স শুধু বৃদ্ধ বয়সেই হতে পারে।
বাস্তবঃ যদিও আনুমানিক ৯০% ক্ষেত্রেই ৫০ বা ৬০ বছর বয়সেই পার্কিনসন্স হবার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু বাকি ১০% ক্ষেত্রে ৪০ বছর বয়সেই এই রোগ দেখা দিতে পারে।
ভুল ধারনাঃ পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত সকলেরই হাত-পা কাঁপে।
বাস্তবঃ অনেক পার্কিনসন্স রোগী এই সমস্যার সম্মুখীন হন না।
ভুল ধারনাঃ পার্কিনসন্স হঠাৎ ভয়াল রূপ ধারণ করতে পারে।
বাস্তবঃ পার্কিনসন্স-এর মাত্রা যদিও ক্ষেত্রবিশেষে একদিনের মধ্যেই ওঠানামা করতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, এই রোগ খুব ধীরগতিতে অগ্রসর হয়। বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মস্তিষ্কে সংক্রমণ বা অন্যান্য কারণেও কয়েক দিনের বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রোগীর অবস্থার অবনতি হবার আশঙ্কা থাকে।
ভুল ধারনাঃ শুধু ওষুধপত্রের সাহায্যেই পার্কিনসন্স-এর চিকিৎসা সম্ভব।
বাস্তবঃ ওষুধের সাহায্যে শুধুমাত্র বিশেষ কিছু উপসর্গই কমানো সম্ভব। কিন্তু নিয়মিত ব্যায়াম, পুষ্টিকর আহার, মাংসপেশির পরিচর্যা অর্থাৎ মাসল স্ট্রেংদেনিং থেরাপি ও জীবনযাত্রায় সামান্য কিছু পরিবর্তন আনতে পারলে এই রোগের উপসর্গ ব্যাপক হারে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বহু ক্ষেত্রে সপ্তাহে মাত্র এক ঘন্টা ব্যায়াম করিয়ে রোগীর স্বাস্থ্যের আশাজনক উন্নতি লক্ষ করা গেছে।
ভুল ধারনাঃ পার্কিনসন্স রোগ জিনগত।
বাস্তবঃ মাত্র ৫-১০% ক্ষেত্রেই পার্কিনসন্স জিনগত কারণে হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবেশ ও জীবনযাত্রা এই রোগের মূল কারণ।
ভুল ধারনাঃ এই রোগের কারণে মৃত্যু অবধি হতে পারে।
বাস্তবঃ পার্কিনসন্স সরাসরি কখনই মৃত্যু ঘটায় না। বহু ক্ষেত্রেই রোগ ধরা পড়ার পর দীর্ঘ দিন ধরে রোগী বেঁচে থাকেন। পার্কিনসন্স-এর কারণে ঘটিত অন্যান্য সমস্যা, যেমন খাবার বা ঢোঁক গিলতে অসুবিধা হবার কারণে ফুসফুস ও শ্বাসনালীর সংক্রমণে নিউমোনিয়া দেখা দিলে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।