পরার্থপরতা: জয় হোক মানবতার

দাতা হাতেম তাঈ কিংবা হাজী মোহাম্মদ মোহসীনকে চেনেন না,এমন বোধ করি কেউ নেই।যুগে যুগে কিছু মানুষ যে শুধু অন্যের উপকারের জন্য দান করে বিখ্যাত ও স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন এটা কিছুটা বিস্ময়কর মনে হতে পারে,কিন্তু একটু চোখ প্রসারিত করে চারিদিকে দেখলেই দেখা যাবে এই ব্যাপারটা সমাজে নেহায়েতই  কম নয়। হয়তো সেটা হাজী মোহাম্মদ মোহসীন কিংবা হাতেম তাঈ এর মত এত বৃহৎ আকারে নয় বলে চোখে পড়ে না।
হালের করোনা কালেই দেখেছি আমরা তার উদাহরণ। হাজার হাজার মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছে সমাজে কর্মহীন,দরিদ্র লোকদের সাহায্য করার জন্য।এইতো মাত্রই কিছুদিন আগেই একজন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষুক তার তিন বছরের তিল তিল করে জমানো টাকা সরকারি তহবিলে জমা দিয়েছেন করোনার জন্য ত্রান দিতে।
বলুন তো,কিভাবে ব্যাখা করা যায় ব্যাপারটা?  জ্বী,এটাই মানবতার সর্বোৎকৃষ্ট গুনাবলীর একটি – পরার্থপরতা। 
এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই অনেকের মধ্যেই আসে যে, কেন কিছু মানুষ তার নিজের সর্বস্ব দান করে দেয় বা জীবন পর্যন্ত বিপন্ন করে ফেলে অন্যের উপকারের জন্য।আর কেনই বা কিছু মানুষ অন্যকে বিপন্ন করে নিজের সুবিধার জন্য?
বা রাস্তায় একজন মানুষ পড়ে থাকলে কেনই বা বেশির ভাগ মানুষ না দেখার ভান করে চলে যায়,আর কেনই বা কেউ নিজের শক্তি, সময় খরচ করে কোনো কিছু পাবার আশা না করেই ঝাপিয়ে পড়ে তাকে সাহায্য করতে?
আজ এই মানবিক গুনগুলোর মধ্যে অসাধারণ যে ব্যাপারটি “পরার্থপরতা বা অল্ট্রুইজম (Altruism)” সেটা নিয়ে বলবো।
পরার্থপরতা যাকে ইংরেজিতে ‘অল্ট্রুইজম’ বলা হয়, ল্যাটিন শব্দ “অল্টার” (“অপর”) থেকে এসেছে, যার আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় “অপর-বাদিতা”। ১৯ শতকের মধ্যভাগে ফরাসি দার্শনিক-সমাজবিজ্ঞানী আগস্টে কম্ট স্বার্থপরতার বিপরীতার্থক ধারণা হিসেবে সমাজবিজ্ঞানে এই ধারণাটি আনেন; এই শব্দের প্রথম ব্যবহার ১৮৫৩ সালে করা হয়েছিল বলে অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানে আছে।

পরার্থপরতা হ’ল অন্য মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে এবং কোনও পুরষ্কারের প্রত্যাশা ছাড়াই কোনো কাজ করা।

মনোবিজ্ঞানীরা পরোপকার কেন বিদ্যমান তার জন্য বিভিন্ন ধরণের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেস্টা করেছেন। সেগুলো একটু দেখে নেয়া যাক:
জৈবিক কারণসমূহঃ
জিনগত বৈশিষ্ট্য: বিভিন্ন স্টাডিতে দেখা গেছে,নিকট আত্মীয়দের মধ্যে যত বেশী পরোপকারতার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান,তাদের পরবর্তী জেনারেশনে এই বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন থাকে।
বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গির আর একটি বৈশিষ্ট্য হ’ল লোকেরা অন্যদের বাঁচতে সাহায্য করার সম্ভাবনা বেশি থাকে যদি তারা যে ব্যক্তিকে সাহায্য করছে তাদের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এটি জৈবিকভাবে বোঝা যায় কারণ নিকটাত্মীয়রা সেই ব্যক্তির সাথে ডিএনএ ভাগ করে যাঁরা সাহায্য করছেন। 
✪নিউরোলজিকাল কারণসমূহঃ
পরার্থপরতা মস্তিষ্কের পুরষ্কার কেন্দ্রগুলিকে সক্রিয় করে। নিউরোবায়োলজিস্টরা খুঁজে পেয়েছেন যে যখন কেউ কোনও পরার্থপর কাজে লিপ্ত হয় তখন মস্তিষ্কের আনন্দ কেন্দ্রগুলি (reward centre) সক্রিয় হয়।
সোশ্যাল কগনিটিভ অ্যান্ড এফেক্টিভ নিউরোসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত ২০১৪ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সহমর্মীতাপূর্ন আচরণে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চল যেমনঃ ডোপমেনার্জিক ভেন্ট্রাল ট্যাগমেন্টাল এরিয়া,ইনসুলা, ভেন্ট্রাল স্ট্রায়াটাম, প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্স সহ পুরষ্কারের সাথে জড়িত মস্তিষ্কের অঞ্চলগুলিকে সক্রিয় করে। মস্তিষ্কের এই অংশগুলি পরার্থতাকে বিভিন্ন উপায়ে চিত্রিত করে।
✪পরিবেশগত কারনঃ
মনস্তত্ত্ববিদরা দীর্ঘকাল ধরে বিতর্ক করেছেন যে কিছু লোক কেবল অন্যের সাহায্য করার জন্য একটি প্রাকৃতিক প্রবণতা নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছেন-যা অন্য সবার মধ্যে থাকে না, এই তত্ত্বটি যা এই ধারনা দেয় যে পরার্থপরতা জেনেটিক্স দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবার সম্ভাবণা বেশী।
আবার কিছু সমীক্ষায় এই তত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ বলা হয়েছিল, কারন দেখা গেছে এক এবং দু’বছরের শিশুদের মধ্যে সামাজিকীকরণ পরার্থবাদী কাজের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। যেসব বাচ্চারা পরোপকার সরাসরি পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তীতে তারা পরার্থপরতা প্রদর্শন করার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল।
এই জাতীয় গবেষণা এটাই পরামর্শ দেয় যে,পরিবারে বাবা -মা,বা গুরুজনের মধ্যে একটা শিশু যত বেশী মানবিক গুনগুলোর প্রয়োগ দেখবে,পরবর্তীতে তার জীবনেও সে এই মহৎ গুনের প্রতিফলন ঘটাবে। 
✪সামাজিক নিয়মঃ
সমাজের নিয়ম ও প্রভাব ফেলতে পারে পরার্থপর আচরণে। যেমন প্রতিদানের ইচ্ছা।
উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি আমাদের জন্য কিছু করে থাকে,বা কোনো উপকার করে তবে তাদের সেটা প্রতিদান দেয়ার জন্য আমরা চাপ অনুভব করি।
✪জ্ঞানীয় কারণঃ
গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে লোকেরা যখন দুর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতি বোধ করে তখন তারা পরার্থপর আচরণে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।গবেষকরা দেখেছেন যে শিশুরা তাদের হিসাবে আরও পরার্থপর হয়ে ওঠে যদি তাদের মধ্যে সহানুভূতির বোধ বিকশিত হয়।
আসলে উপরের খটমটে সব সামাজিক, মনস্তাত্বিক, বা বায়োলজিকাল ত্বত্ত্বগুলো থেকে এটাই বোঝা যায়, একজন মানবিক গুন সম্পন্ন ব্যাক্তি হঠাৎ করেই গড়ে ওঠে না,তার মানবিকতার, পরার্থপরতার গুনটি তার জিন গত,সামাজিক,পাারিবারিক সবকিছুরই মিলিত ফসল।
একটা শিশু যা দেখবে তাই শিখবে।আপনার মধ্যে মানবীয় গুনগুলো যত প্রকট হবে,আপনার ভবিষ্যত প্রজন্ম ও তত বেশী গড়ে ওঠবে আলোকিত মানুষ হয়ে।
যদিও সব উপকারই নিঃস্বার্থ,তা কিন্তু না।অনেক ক্ষেত্রেই লোক দেখানো মানবিকতা কিংবা প্যাথলজিক্যাল এল্ট্রুইজম এর ব্যাপার ও থাকে।
কিন্তু যুগে যুগে মানবতার সত্যিকার জয় রচিতই হয়েছে অন্যের জন্য নিঃস্বার্থভাবে  কিছু করার তাড়না থেকে।লোভ,স্বার্থ আর প্রতিহিংসার এ পৃথিবীতে ক্ষমা,উদারতা, পরার্থপরতা নিয়ে এই মানবতাই পৃথিবীকে আলোকিত করে রেখেছে।   
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন

 

Previous articleবয়ঃসন্ধিকাল এবং হোম কোয়ারেন্টাইন
Next articleপ্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং মানসিক রোগ
ডা. রেজওয়ানা হাবীবা
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here