ঘটনা ১
২০ বছরের লিজা, একটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। পরীক্ষার জন্য রাত জেগে পড়ালেখা করতে হয়েছিল এক মাস। পরীক্ষা শেষ হয়েছে, কিন্তু তারপর আগের অভ্যাসমতো রাত দশটায় বিছানায় গেলে আর ঘুম আসছে না। দুই সপ্তাহ ধরে সারারাত বিছানায় ছটফট করে ভোরের দিকে ঘুমাতে পারছেন, সকালে উঠছেন দশটা বা এগারটায়।
ঘটনা ২
হালিমা বেগম, গত দুইমাস ধরে যার রাতের বেলা ঘুমাতে গেলে ঠিক দুই-তিনটায় ঘুম ভেঙে যায়, এরপর আর ঘুম আসে না। আর এই জেগে থাকার সময়টাতে প্রচন্ড কষ্ট হয়, কত কষ্টের কথা যে মনে আসে। আগে সুন্দর সকাল সাড়ে ছয়টায় ঘুম থেকে উঠতেন, ৩৫ বছরের জীবনে এই ছন্দে ভালোই কাজ চলছিল। কিন্তু গত দুইমাস ধরে অন্য কাজও করতে পারছেন না। ভাবছিলেন ঘুম না হওয়ার জন্যই এমনটা, কিন্তু চিকিৎসক নিশ্চিতভাবেই বলছেন তার সমস্যা বিষণ্ণতা, আর বিষণ্ণতা ঠিক হলে তার ঘুমও ঠিক হয়ে যাবে। হালিমা পরে ভেবে দেখলেন গত দুইমাস ধরে কোনো কিছু ভালো লাগছে না, আগ্রহ-খুশি নিয়ে কিছু করতে পারেন না, সবসময় খিটমিটে মেজাজ, কোনো চিন্তা একটানা আর করতে পারছেন না। চিকিৎসক জিজ্ঞেস করার আগে মনে করছিলেন কম ঘুমের জন্যই এগুলো হচ্ছে।
ঘটনা ৩
২১ বছরের লিটন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সকাল আর দুপুরের ক্লাস তার জন্য রীতিমতো আতঙ্কের বিষয়। সারারাত ইন্টারনেটে চ্যাটিং, গেম খেলা, লেকচার শোনা, ভিডিও দেখার পর সকালে ঘুম আসে তার, সন্ধ্যা সাতটায় ঘুম ভাঙে।
এরকম আরো অনেক অভিজ্ঞতাই অনেককে কষ্ট দিচ্ছে। ঘুম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঘুম না হওয়া বা অনিদ্রা অথবা অতিরিক্ত ঘুম দুটোই আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যাহত করে। বিভিন্ন কারণ থাকে ঘুম কম এবং বেশি হওয়ার। এই লেখায় দুইটি সমস্যার কারণ এবং করণীয় নিয়ে পাঠকদের ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছি।
কম ঘুম বা অনিদ্রার সমস্যা কেমন
- এটা হতে পারে বিছানায় গেলে ঘুম না আসা,
- একবার ঘুমিয়ে পড়লেও বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়া
- ঘুমিয়ে যেতে পারলেও আগের অভ্যাস অনুযায়ী জেগে ওঠার সময় থেকে দুই-তিন ঘণ্টা আগে ঘুম ভেঙে যাওয়া এবং আর না ঘুমাতে পারা
- রাতে যথেষ্ট সময় ঘুমাতে পারার পরও জেগে উঠে তরতাজা না লাগা
কেন হয় অনিদ্রা
- অনিদ্রা হতে পারে সাময়িক অথবা দীর্ঘস্থায়ী সাময়িক অনিদ্রা হতে পারে
- চাপজনিত ঘটনার কারণে জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পরিবর্তন যেমন : চাকরি যাওয়া বা বদলি, নিকটজনের মৃত্যু অথবা অসুস্থতা, বিবাহ-বিচ্ছেদ, বাসস্থান পরিবর্তন ইত্যাদি।
- অসুস্থতা যেমন : প্রচন্ড ব্যথা।
- পরিবেশগত বিষয় যেমন : অতিরিক্ত শব্দ, আলো, প্রচন্ড গরম বা ঠান্ডা, নতুন পরিবেশ।
- স্বাভাবিক ঘুমের ছন্দে ব্যাঘাত যেমন : জেট ল্যাগ (দিনরাত বিপরীত এরকম দেশ ভ্রমণের কারণে ঘুমের ছন্দে ব্যাঘাত), নিজস্ব রুটিনের পরিবর্তন যেমনটা প্রথম উদাহরণে দিয়েছি।
- ঔষধ যেমন : সালবিউটামল, এমাইনোফাইলিন, এসএসআরআই গ্রুপ, ক্যাফেইন মিশ্রিত যেকোনো ঔষধ, সর্দি-কাশির জন্য সিউডোএফিড্রিন মিশ্রিত ঔষধ, স্টেরয়েড প্রভৃতির প্রভাবে।
- অতিরিক্ত চা, কফি, কোমল পানীয়, ধূমপান।
- বিভিন্ন মাদক যেমন : এমফেটামিন।
- সন্ধ্যাবেলায় অতিরিক্ত উত্তেজনাকর কাজ বেশি করা যেমন-ভারী ব্যায়াম, মোবাইল-কম্পিউটার ব্যবহার, রাতে ভারী খাওয়া। এই সাময়িক অনিদ্রা সাধারণত জীবনযাপনে পরিবর্তন আনলে, কার্যকারণ সরিয়ে নিলে ভালো হয়ে যায়। তাহলে কখন অনিদ্রাকে দীর্ঘস্থায়ী এবং একটি রোগ হিসেবে বলা যায়-এ প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের দেয়া সংজ্ঞামতে অনিদ্রা যখন সপ্তাহে তিনদিন বা তার বেশি এভাবে অন্তত তিন মাসের জন্য দেখা যাবে তখন সেটাকে অনিদ্রা রোগ বলা হয়। প্রতি একশ জন অনিদ্রায় ভুগতে থাকা ১৫ জনের ক্ষেত্রে অনিদ্রার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়না। অন্যান্য কারণ হচ্ছে :
- মানসিক রোগ : বিষণ্ণতাজনিত রোগ (যেমনটি দ্বিতীয় ঘটনায় দেখা যাচ্ছে), উদ্বিগ্নতাজনিত রোগ, চাপজনিত মানসিক রোগ, সাইকোসিস বা গুরুতর মানসিক রোগ, মাদকাসক্তি।
- দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ।
- শারীরিক অসুখ যেমন-হার্ট ফেইলিউর, শ্বাসকষ্ট, বাতরোগ প্রভৃতি।
করণীয়
কম ঘুমের সমস্যা দেখা দিলে আগে সাময়িক কোনো কারণে কিনা সেটা দেখতে হবে। সাময়িক কারণে হলে সাধারণত কারণটা সরিয়ে নিলে এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। যদি অনিদ্রার সমস্যা এক-দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে, প্রতিদিনের কাজকর্মে অসুবিধা হতে থাকে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কী কী চিকিৎসা আছে অনিদ্রার
- ঘুমের স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিগুলো মেনে চলা প্রয়োজনীয়
- কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা
- মানসিক রোগের কারণে হলে সেই নির্দিষ্ট মানসিক রোগের চিকিৎসা
- শারীরিক অসুখের চিকিৎসা : যেমন শ্বাসকষ্ট, ব্যথা এসব উপশম নির্মূল হলে রোগীর ঘুম ঠিক হয়ে যায়
- সাময়িকভাবে লক্ষণজনিত চিকিৎসার জন্য ঘুমের ঔষধ যেমন : বেনজোডায়াজেপিন, মেলাটোনিন ব্যবহার করা যায়। তবে এই ঔষধগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এবং অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করতে হবে।
- সাইকোথেরাপি : ঘুমের অভ্যাস, শারীরিক অবস্থার ওপরে ঘুমের প্রভাব নিয়ে চিন্তাধারা প্রভৃতি বিষয়ে নির্দিষ্ট সাইকোথেরাপি আছে। এছাড়াও যেই মানসিক রোগের জন্য ঘুমের সমস্যা হচ্ছে সেই মানসিক রোগের নির্দিষ্ট সাইকোথেরাপি দিতে হয়।
অতিরিক্ত ঘুমের সমস্যা কেমন ধরনের হতে পারে
- একজন সাধারণ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ঘুমের প্রয়োজন ৬৮ ঘণ্টা। সারারাত এই সময় ঘুমানোর পরেও দেখা যায়
- দিনের বেলায় ঘুম ভাব/ঝিমুনি ক্স যেকোনো সময় ঘুম চলে আসা
- ৯-১০ ঘণ্টা প্রতিদিন ঘুম আসা কোনো কারণ ছাড়া
- সারাদিন ক্লান্ত থাকা/কোনো কাজে ইচ্ছা থাকলেও মনোযোগ না দিতে পারা
অতিরিক্ত ঘুমের কারণ কী কী
- অভ্যাসজনিত। যেমন ওপরের তৃতীয় ঘটনাটি যদি দেখি। এখানে ঘুমের অভ্যাসটিই সমস্যাজনক। সারারাত না ঘুমিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা ঘুম হচ্ছে। এভাবে রাতে-দিনের অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য ঘুমের সমস্যা হয়ে থাকে।
- রাতের বেলায় ভালো ঘুম না হওয়া। যেমন ছোট বাচ্চাসহ মায়েদের দেখা যায় রাতে বাচ্চার দেখাশোনা করতে গিয়ে ঘুম হয় না।
- নারকোলেপ্সি, মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগ যেমন : পারকিনসনস ডিজিজ, স্মৃতিভ্রংশতা, মস্তিষ্কে আঘাত এবং আঘাত পরবর্তী অবস্থায়
- থাইরয়েড হরমোনের অভাব, রক্তস্বল্পতা
- স্লিপ অ্যাপনিয়া : ঘুমের সময় শ্বাস বারবার বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যা
- ঘুমের ঔষধ যেমন : বেনজোডায়াজেপিন, অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ঔষধ, বিষণ্ণতারোধী ঔষধ, অ্যান্টিসাইকোটিক ঔষধ
- মাদকাসক্তি : অ্যালকোহল, হেরোইন-মরফিন জাতীয় মাদক, বেনজোডায়াজেপিন
- ওজন বেড়ে যাওয়া
- বংশগত কারণ
করণীয়
অতিরিক্ত ঘুমের সমস্যা যদি দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটায় এবং এক-দুইমাসেও কোনো উন্নতি না হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ঘুম কম অথবা বেশি সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগে কয়েকটি বিষয় মনে রেখে চিকিৎসকের কাছে উল্লেখ করলে কারণ নির্ণয় যথাযথ হবে। যেমন :
- সমস্যার শুরু হওয়ার দিন তারিখ এবং সমস্যাটা কী রকম এটা উল্লেখ করে একটা তালিকা তৈরি (স্লিপ ডায়রি বা প্রতিদিনকার ঘুম আসার এবং ঘুম থেকে ওঠার সময়, ঘুমের অবস্থা উল্লেখ করে অন্তত দুই সপ্তাহের ডায়রি নিয়ে যেতে পারেন)
- কী কী ঔষধ খাচ্ছেন চিকিৎসকের কাছে উল্লেখ করা
- পরিবারে নিকটাত্মীয়দের (বাবা, মা, ভাইবোন, সন্তান) ঘুমের সমস্যা আছে কিনা
- কোনো চাপজনিত পরিস্থিতি, ধূমপান বা কোনো মাদকের আসক্তি আছে কিনা
- শারীরিক এবং মানসিক রোগের ইতিহাস
এই সমস্যাগুলোর যথাযথ কারণ নির্ণয় করতে পারলে চিকিৎসা যথাযথভাবে করে সমস্যার সমাধান অনেকাংশে সম্ভব। তাই ঘুমের স্বাস্থ্যকর নিয়মকানুন দুই-চার সপ্তাহ পালনের পর ঘুমের সমস্যা ঠিক না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে