নিকটজনের মৃত্যু ও আমাদের সামাজিকতা

0
16
নিকটজনের মৃত্যু ও আমাদের সামাজিকতা

ডা. মো. আব্দুল মতিন
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মানসিক রোগ বিভাগ
রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

মৃত্যু

মৃত্যু শব্দটি খুব বেদনাদায়ক। মৃত্যু মানে যবনিকাপাত অর্থাৎ একটি জীবনের সমাপ্তি এবং ইহলৌকিক সমস্ত ক্রিয়াকলাপের সাথে তার সম্পূর্ণ সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া। আমরা বলি যার জন্ম আছে তার মৃত্যু আছে। জন্মালে একদিন না একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এবং এর কোন ব্যত্যয় নাই। তবে জীবনের পরিসমাপ্তি দুই ভাবে হয়ে থাকে।

একটি মানুষ জন্মের পর শৈশব ও কৈশোরের গণ্ডি পেরিয়ে ধীরে ধীরে বড় হয়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে অবদান রাখা, বিয়ে করে সংসার বাঁধা, সন্তান সন্ততি উৎপাদন, তাদেরকে গড়ে তোলা ইত্যাদি কর্মের মধ্যে দিয়ে এক পর্যায়ে সে বার্ধক্য উপনীত হয় এবং একপর্যায়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এই মৃত্যু হলো স্বাভাবিক মৃত্যু। তবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ছাড়াও নানান ভাবে মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

যেমন দুর্ঘটনায় মৃত্যু, রোগ ব্যাধিতে ভুগে মৃত্যু, সহিংসতায় মৃত্যু ও আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু ইত্যাদি। তবে মৃত্যু স্বাভাবিক উপায়েই হোক আর অস্বাভাবিক উপায়েই হোক তা আমাদের হৃদয়কে বিষাদিত করে, শোকাকিভূত করে।Magazine site ads

জীবনে মৃত্যুর প্রভাব

প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদের জীবনে নানান ভাবে প্রভাব ফেলে। বয়োঃজনিত স্বাভাবিক মৃত্যু মানুষের জীবনে যে শোকের ছায়া ফেলে তার চেয়ে অস্বাভাবিক হঠাৎ কোন মৃত্যু তাদেরকে বেশী বেদনায় ভারাক্রান্ত করে যা বহু গবেষণায় প্রমাণিত। আবার বৃহৎ পরিবারের কারও মৃত্যু তার নিকটজনের মনে যে শোক তৈরি করে, ছোট পরিবারের কারও মৃত্যু তাদের মনে অনেক বেশী শোক তৈরি করে।

অন্যদিকে বাবা—মা, ভাইবোনের মৃত্যু কারও কাছে যতটা কষ্টের, নিজের সন্তানের মৃত্যু তার কাছে তার চেয়ে আরও বেশী কষ্টের। আবার মৃত ব্যক্তি একটু দূরের আত্মীয় হলে শোক একটু কম হয়। প্রিয়জনের মৃত্যুতে কান্না করা, দুঃখ পাওয়া, শোকে হতবিহ্বল হওয়া একজন মানুষের স্বাভাবিক আবেগিক প্রক্রিয়া। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে একসময় শোক কমে আসে এবং সে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। তবে কখনও কখনও এই শোক অতিমাত্রায় তীব্র হয় ও দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে এবং সেটা তার জীবন প্রবাহ ও স্বাভাবিক কাজকর্মকে ব্যাহত করে। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শের প্রয়োজন হতে পারে।

আবার মৃত ব্যক্তির সাথে জীবিতদের সম্পর্ক, পরিবারে ও জীবনে তার অবদান, পরিবারের উপার্জন ও নিরাপত্তায় তার ভূমিকা ইত্যাদি সব কিছু স্বজনের শোকের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। মৃত ব্যক্তির জীবন প্রবাহ, চারিত্রিক গুনাবলি ও কর্মের উপর পরিচিতরা তাকে কীভাবে স্মরণ করবে, কষ্ট পাবে না ঘৃণা করবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে। অনেকের প্রয়াণে তার আত্মীয়—স্বজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে অর্থাভাবে নিদারুণ কষ্টে দিনানিপাত করে।

বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা, নিদ্রাহীনতাসহ নানারকম মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে তারা। আবার কিছু মহান মানুষের মৃত্যু তার পরিবার ছাপিয়ে সারাদেশ তথা জাতিকে ভাসায় চোখের জলে। সহিংসতায় মৃত্যু ও কোন বীভৎস মৃত্যু যেমন মারাত্মক দুর্ঘটনা মৃত্যু, পুড়িয়ে ও পিটিয়ে মারা, ধর্ষণজনিত হত্যা, অ্যাসিড নিক্ষেপে মৃত্যু ইত্যাদি মানুষের মনে ভয়ানক ট্রমা তৈরি করতে পারে যা বছরের পর বছর যার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে।

মৃত্যুর সামাজিক প্রভাব

প্রতিটি মৃত্যু যেমন পরিবার ও সমাজের মানুষের মনে গভীর বেদনার ক্ষত তৈরি করে ঠিক তেমনি কিছু মানুষের মৃত্যু ঘিরে মানুষকে উল্লসিত হতেও দেখা যায়। অত্যাচারী, জুলুমবাজ ও সন্ত্রাসী মানুষের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ একসময় তাদের মৃত্যু কামনা করে। অনেকের মৃত্যুতে মানুষকে স্বস্তি প্রকাশ করে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে এবং মিষ্টি বিতরণ করতেও দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। জীবন এমন ভাবে গড়া উচিত যেন কেউ আপনার মৃত্যু কামনা না করে অথবা কেউ নিজেই আপনার মারার জন্য উদ্যত না হয়। সবাই আপনার মৃত্যুতে কষ্ট পাবে, কাঁদবে এমন জীবনই সবার চাওয়া উচিত।

কারও অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হলে তার বাবা মা, সন্তান, ভাই বোন ও আত্মীয়—স্বজনের মনে কি অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তা ওই জায়গায় নিজেকে কল্পনা করলেও বুঝতে পারবেন। বিভিন্ন আন্দোলনে, বিপ্লবে সহিংসতায় অনেক তাজা প্রাণ ঝরে যায় যা খুবই কষ্টের। একজন শিক্ষার্থী যখন মারা যায় তখন তার পরিবারে ও বাবা—মায়ের মনে যে শূন্যতা তৈরি হয় তা কেউ কোন কিছুর বিনিময়ে পূরণ করার নয়। একজনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু একটি পরিবারের তিল তিল করে গড়া স্বপ্নকে মুহূর্তে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়। তাদের মনে যে বেদনার ক্ষত তৈরি হয় তা কোন কালেই শুকাবার নয়।

দায়বদ্ধতা ও করণীয়

অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো মৃত্যুই কারও কাম্য হতে পারে না। প্রতিটি মানুষের এমনভাবে চিন্তা করা উচিত, কথা বলা উচিত বা কাজকর্ম করা উচিত যেন তা অন্য কারও অনুভূতিতে আঘাত না করে, কাউকে ছোট না করে, কারও ধর্মকে অপমান না করে। কাউকে প্রতিপক্ষ বা লক্ষ্যবস্তু বানানোও সঠিক নয়। কারও মন্তব্য আপনার পছন্দ না হলে তাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন বা তাকে এড়িয়ে চলতে পারেন বা তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু তাকে হত্যা করা বা লাঞ্ছিত করা শোভনীয় কাজ নয়।

কেউ অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন কিন্তু কখনও আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়। আইনের প্রতি সকলের শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত।

কাউকে উসকে দেওয়া বা কারও বিরুদ্ধে অন্য কাউকে খারাপ কিছু করতে প্ররোচিত করাও গর্হিত কাজ। কোন সহিংসতা ও বীভৎস মৃত্যুর খবর প্রচারে সংবাদ মাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়াকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। কারণ একটি খারাপ ঘটনা যেন আরও একটি খারাপ ঘটনার ঘটাতে জনগণকে উৎসাহিত না করে।

প্রতিটি অভিভাবকেরও উচিত ছোটবেলা হতেই সন্তানকে ভালো আচরণ করতে শেখানো, বিনয়ী হতে শেখানো, ক্ষমা করতে শেখানো। প্রতিটি শিশুই আগামীর ভবিষ্যৎ। তাই তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
পরিশেষে বলতে চায়, আমরা কারও উপকার করতে না পারি, অন্তত কারও ক্ষতি যেন করি। আমরা আরও বেশী সহনশীল হব, অপরের কষ্টে কষ্ট পাব, অন্যের বিপদে তার পাশে দাঁড়াব এটাই হোক আমাদের আগামীর প্রত্যাশা।

আর যেন কোন সহিংসতায় কারও অকাল মৃত্যু না হয়, কারও বুকে অন্যায়ভাবে কোন গুলি না চলে, কোন মা—বাবার বুক খালি না হয়। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আমাদের কর্ম দিয়ে সেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবে। সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।

  • এপোয়েন্টমেন্ট নিতে যোগাযোগ করুন-Prof. Dr. Shalahuddin Qusar Biplob
  • চেম্বার – MK4C -মনের খবর ফর কেয়ার
    মগবাজার রেইল গেইট।
    নাভানা বারেক কারমেলা, লিফটের ৩,
    (ইনসাফ কারাকাহ হাসপাতালের বিপরীতে)।
    চেম্বার সিরিয়াল – ০১৮৫৮৭২৭০৩০

আরও পড়ুন-

Previous articleজাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের নতুন পরিচালক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মাহবুবুর রহমান
Next articleরাতে ঘুম থেকে চিৎকার করে ওঠে, আর ভয়ে কাঁপতে থাকে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here