নিকটজনের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতায় করণীয় এবং সতর্কতা

নিকটজনের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতায় করণীয় এবং সতর্কতা

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মইনুল (ছদ্মনাম), বয়স ২২। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট সে।  মইনুল প্রায়ই চুপচাপ গুটিয়ে রাখে নিজেকে, ক্লাসেও যায় না, কেমন গম্ভীর সবসময়, বাবা-মা কিছু বললে রেগে যায়, নিজের ঘরে গিয়ে চুপ করে থাকে, অথচ আগে সে খব হাসিখুশি ছিল।

হঠাৎ এক ভোরে সে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেয়। পরিবারের সবাই ভেঙে পড়ে প্রচন্ডভাবে, বিশেষ করে বড় ভাই। কারণ সে প্রায় পাঁচ মাস যাবত মইনুলকে কান্নাকাটি করতে দেখেছিল, লেখাপড়া করতে পারছে না এটাও জানতে পেরেছিল। চেহারা বিষণ্ণ দেখে জানতে চেয়েছিল কোনো সম্পর্ক আছে কিনা-অল্প বয়সের ছেলের আর কোনো সমস্যা মাথায় আসেনি তার।

তবে মইনুল প্রায়ই বলত, ‘আমি তো সবার ছোট, আমি না থাকলেও তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।’ মইনুলের বন্ধুদের মধ্যে দুইজন তাকে জানিয়েছিল যে তারা চিন্তিত মইনুলকে নিয়ে, ক্লাসে অমনোযোগী, ফলাফল খারাপ হচ্ছে, তাকে যেন ডাক্তার দেখানো হয়। বড় ভাই ভেবেছিল এসব গুরুত্ব দেয়ার মতো কিছ না।

ওপরের ঘটনার অবতারণা এ কারণে যে অনেক সময়ই নিকটজনের (পরিবারের সদস্য, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব) মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি বুঝতে এবং সেই অনুযায়ী সতর্ক হতে আমরা ভুল করে ফেলি। কিন্তু ঝুঁকির লক্ষণগুলো সম্পর্কে এবং সেইসঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির পরিজনদের করণীয় সম্পর্কে জানলে অনেকাংশে আত্মহত্যা এড়ানো সম্ভব।

নিকটজনের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বা এমন আশঙ্কা মনে আসাটাই একটা চাপ হিসেবে কাজ করে। এই বিষয়ে কথা বলা নিয়েই অস্বস্তিতে ভোগেন অনেকে। একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে, আত্মহত্যার কথা জিজ্ঞেস করাটা ব্যক্তিকে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যাবে। এই ধারণা থেকে আর জিজ্ঞেস করা হয় না, অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায় না। বরং আত্মহত্যার বিষয়ে জিজ্ঞেস করাটাই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু প্রতিরোধ করতে পারে। তাই নিকটজনের মধ্যে কারো কোনো আচরণে এই সংশয় দেখা দিলে তার সঙ্গে সময় নিয়ে খোলাখুলিভাবে কথা বলতে হবে। যেমন : ওপরের ঘটনায় পরিবারের কেউই কিছু জিজ্ঞেস করেনি, ভাই নিজের মতো ব্যাখা দাঁড় করিয়েছে এরকমটাই বিপজ্জনক।

করণীয় কী

  • সরাসরি কথা বলুন। মৃত্যুর কথা বললেও সেটা নিয়ে আলাপ চালিয়ে যান
  • সময় দিয়ে তার সমস্যার কথা শুনুন
  • এটা আশ্বস্ত করুন যে আপনি তার পাশে আছেন
  • সহমর্মিতা দেখান। নিরপেক্ষভাবে শুনুন
  • আপনার সাথে কষ্টে থাকা ব্যক্তির সম্পর্ক যেটা সেই সম্পর্কে থাকন। বাবা-মা হলে বাবা-মা, সঙ্গী হলে সঙ্গী, বন্ধু হলে বন্ধু; এই ভূমিকাতেই তাকে সময় দিন। এর বাইরে গিয়ে বিচারক বা চিকিৎসকের ভূমিকা গ্রহণের প্রয়োজন নেই।
  • তার সমস্যার বাস্তব সমাধানে তাকে নিজের অবস্থান থেকে চেষ্টা করতে সাহায্য করুন। যেমন : সন্তান হয়তো পড়ালেখায় অনেক পিছিয়ে গিয়েছে, তাকে ধীরে ধীরে রুটিনে নিয়ে আসতে উৎসাহ দিন।
  • নিঃশর্তভাবে সেই ব্যক্তিকে দেখুন। সাফল্য ব্যর্থতা মিলিয়েই সবাই মানুষ-এটা মাথায় রাখুন।
  •  দৈনন্দিন জীবনে কিছ ইতিবাচক অভ্যাস আনতে উৎসাহ দিন, নিয়মিত  ‍ঘুম, ব্য়ায়াম, সামাজিকতা ইত্যাদি বিষয়ে উৎসাহ দিন।
  • বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শের জন্য যেতে বলুন।  ‍বুঝিয়ে বলুন যে, মনের কষ্টের জন্য চিকিৎসা নেয়াটা অনেক সময় প্রয়োজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কারণ থাকে কোনো চিকিৎসাযোগ্য মানসিক রোগ, যেমন গুরুতর বিষণ্ণতাজনিত রোগ। এসব ক্ষেত্রে রোগের যথাযথ চিকিৎসায় আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্ভব।
  • কোনো বিপজ্জনক বস্তু (ঔষধ, ধারালো জিনিস) সরিয়ে রাখবেন।

যা করবেন না

  • বকা বা ধমক দেয়া
  • অন্য কত মানষ কত কষ্টে আছে, তোমার এত আরামে থেকেও এই চিন্তা’ এইরকম বলা
  • ছোট করা, ‘কাপুরুষ’ ‘জীবনকে মোকাবেলা করার সাহস নাই’, ‘ভীতু’ এসব বলা
  • সমস্যাকে ছোট করে দেখা-মাত্র একটা পরীক্ষায় ফেল করলি, তাতেই মইরা যাবি’, ‘ স্বামী তোরে পিটাইছে তো কী হইছে, এইটা কারে না করে!’
  • সম্পর্কের ভূমিকার বাইরে গিয়ে বিচারক, চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী হয়ে যাওয়া। বন্ধুর ঔষধ নিজে বন্ধ করে দিলেন, এদিকে বন্ধু সিজোফ্রেনিয়ার রোগী এবং হ্যালুসিনেশনের আদেশে আত্মহত্যার চেষ্টা করল-তখন অনুতাপ করা আর হা-হুতাশ করা ছাড়া আর উপায় থাকবে না।
  • বিদ্রুপ করা, খোঁচা দেয়া
  • ‘আমি সব ঠিক করে দেব’ এই রকম গ্যারান্টি দেয়া
  • গোপন রাখা, গোপন রাখার আশ্বাস দেয়া। সবার সামনে ঢাকঢোল বাজিয়ে বলার যেমন দরকার নেই
    তেমন আবার চেপে যাওয়াও বোকামি। অনেক ক্ষেত্রেই যে ব্যক্তির আত্মহত্যার ঝুঁকি থাকে তাকে আরো দূরে রাখা হয় সামাজিকভাবে হয়রানির ভয়ে। এতে সেই ব্যক্তি আরো হীনমন্য হয়ে যেতে পারে, সাহায্য চাওয়ার স্থানও সংকুচিত হয়ে যায় তার।
  • নির্ভরযোগ্য আত্মীয়-বন্ধু, চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানীকে জানানোর বিষয়টি এড়িয়ে যাবেন না। আত্মহত্যার
    সিদ্ধান্ত নেয়া মানে ভীরুতা নয়, বরং সমস্যা থেকে বের হতে চাওয়ার তীব্র আকুতি। ‘অন্যকে আর সমস্যায় ফেলতে চাই ন ‘-এরকম চিন্তা মাথায় কাজ করে অনেকের আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের পেছনে। সমস্যা সমাধানের অন্য উপায় মাথায় থাকে না। নিকটজনের আত্মহত্যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক একটা বিষয়, তাই এড়িয়ে না গিয়ে এই বিষয়ে করণীয় যা আছে সেগুলো চেষ্টা করুন।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleলক্ষ্য যখন সন্তানের মানসিক সুস্বাস্থ্য
Next articleডিপ্রেশন: কে ভাই তুমি!!
ডা. সৃজনী আহমেদ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল, মগবাজার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here