নারীর যৌন সমস্যা ও কিছু কথা

নারীর যৌন সমস্যা ও কিছু কথা

সেদিন এক মহিলা রোগী আমার হাতে চিরকুট ধরিয়ে দিল। পাশে বসা মেডিক্যাল অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম রোগীর সমস্যা কী? সে আমাকে অনুরোধ করে বলল, ‘স্যার, ওটা আগে পড়েন তারপর বলছি।’ আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি জানো না?’ সে বলল যে সে কিছুটা জানে, তবে রোগী সরাসরি আমাকেই বলতে চায়। কিন্তু চিরকুটটা না পড়া পর্যন্ত সে শুরু করতে পারছে না । বাধ্য হয়ে পড়তেই হলো। সেখানে সে লিখেছে সে মাস্টারবেশনে অভ্যস্ত। কিন্তু সে যেখানে থাকে সেখানে যথেষ্ট প্রাইভেসি না পাওয়াতে ইদানিং সে মাস্টারবেশন করতে পারছে না। ফলে তার সিগারেট খাওয়া এবং রাগ বেড়ে গেছে।

আমি তখন ইন্টার্নি চিকিৎসক। গাইনি ম্যাডামের সাথে বসেছি ম্যাডামকে সহযোগিতা করতে। রোগী ম্যাডামের কানে কানে কী যেন বলল। ম্যাডাম কান পেতে গুরুত্ব সহকারে রোগীর সব কথা শুনলেন । তারপর বললেন, ‘এতে আপনার অসুবিধা কী ? আপনাকে তো কিছু করতে হচ্ছে না।’ রোগী ম্যাডামের কথা ফেলতে পারল না । কিন্তু সন্তষ্টও হলো না। রোগী চলে যেতে ম্যাডামের কাছে জানতে চাইলাম তার সমস্যা কী ছিল । ম্যাডাম সহজ সরল ভাষায়ই বললেন তার নাকি স্বামীর সাথে থাকার সময় উত্তেজনা হয় না। গাইনিতে ভ্যাজাইনোপ্লাস্টি অপারেশন দেখেছি। ভ্যাজাইনা লুজ হয়ে গেলে এ ধরনের অপারেশন করা হত। কিন্তু সেটা তো উত্তেজনা সংক্রান্ত সমস্যা নয়।

‍দুটি ঘটনার মধ্যে ব্যবধান পনেরো বছর। এই দীর্ঘ পনেরো বছরে নারীর যৌন সমস্যার ধরনও বদলে গেছে। বর্তমানে যেসব যৌন সমস্যা নিয়ে নারীরা ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন তা হলো ফিমেল অর্গাজমিক ডিজঅর্ডার, ফিমেল সেক্সয়াল ইন্টারেস্ট অথবা এ্যারাউজাল ডিজঅর্ডার, জেনিটো পেলভিক পেইন অথবা পেনিট্রেশন ডিজঅর্ডার, নেশাদ্রব্য বা ঔষধজনিত যৌন সমস্যা । নারীর যৌন প্রতিক্রিয়া পুরুষের থেকে কিছটা ভিন্ন। নারীর যৌন আগ্রহ বুঝতে হলে যৌন বিজ্ঞানীদের প্রস্তাবিত দুটি মডেল সম্পর্কে সামান্য কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়োজন।
সাধারণ জ্ঞানে আমরা যা বুঝি তা হলো যখন একটি যৌনাকাঙ্খা মনে কাজ করবে তখন উদ্দীপনা দিলে শরীর উত্তেজিত হবে এবং উত্তেজনা ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে চড়ান্ত পর্যায়ে যাবে। তারপর চরম পুলকের মধ্য দিয়ে উত্তেজনা প্রশমিত হবে। এটাই লিনিয়ার মডেল। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে পুরুষের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে। নারীদের ক্ষেত্রে যৌন উত্তেজনার কোনো কোনো লক্ষণ উত্তেজিত না হলেও দেখা যেতে পারে। বিষয়টা লিনিয়ার মডেলের মতো ধারাবাহিক বা

ক্রমাগত ভাবে হয় না। অর্থাৎ যৌন উত্তেজনার অনেক শারীরিক লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও একজন নারী যৌনমিলনে আগ্রহ বোধ নাও করতে পারে। রোজ মেরি ব্যাশন তাঁর প্রস্তাবিত সার্কুলার মডেলে এই বিষয়টাই তুলে ধরতে চেয়েছেন।

নারীর যৌনমিলনে অনীহা বোধ করার কারণগুলোকে আমরাদুটি গ্রুপে ফেলতে পারি: এক. বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক কারণ। দুই. সাইকোলজিক্যাল বা মানসিক কারণ।

জৈবিক কারণ
– ক্লান্তি
– বিষণ্ণতা
– ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
– হরমোনজনিত সমস্যা

মন খারাপ মানেই বিষণ্ণতা নয়। বিষণ্ণতা একটি রোগ। যেখানে বলতে গেলে প্রায় সব সময়ই মন খারাপ লাগে এবং দুই সপ্তাহেরও অধিক সময় ধরে তা থাকে। এই মন খারাপের পাশাপাশি আরো কিছু লক্ষণও থাকে। সেসব বিবেচনায় এনে বিষণ্ণতা রোগটি ডায়াগনসিস করতে হয়। এই বিষণ্ণতার একটি জৈবিক ভিত্তি থাকে। তা হলো শরীরে সেরোটনিন নামক জৈব উপাদানটি কমে যাওয়া। বিষণ্ণতায় ভুগলে কারো কারো যৌন আগ্রহ কমে যায়। কিছু কিছু ওষুধে যৌন আগ্রহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব আছে। বিশেষ করে যে ওষুধগুলো ডোপামিন নামক জৈব উপাদানের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। বেশ কয়েকটি হরমোন নারীর যৌন-ইচ্ছার সাথে জড়িত। যেমন- ইস্ট্রোজেন, টেসটোস্টেরন, প্রোল্যাকটিন ও থাইরক্সিন। এই হরমোনগুলো যথাযথ না থাকলে যৌন আগ্রহ কমে যায়।

মানসিক সমস্যা:
-প্রাত্যহিক ব্যস্ততা
-নেতিবাচক ফলাফল
-অপরিকল্পিত গর্ভধারণের ভীতি
-যৌনবাহিত রোগের ভীতি
-বন্ধ্যা প্রমাণিত হওয়ার ভীতি
– নেতিবাচক যৌন অভিজ্ঞতা

প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে যৌনতা এক সময় চাপা পড়ে যায়। একটু পরনো দম্পতিকে (মানে মাত্র বিবাহিত এমন নয়) যদি সাদা কাগজ আর পেন্সিল দেওয়া হয় প্রাত্যহিক কাজের লিস্ট করতে তাহলে দেখা যাবে বেশিরভাগ দম্পতির ক্ষেত্রেই যৌন- মিলনের বিষয়টি আছে লিস্টের একেবারে শেষ প্রান্তে। কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা নাও পাওয়া যেতে পারে। এছাড়া নেতিবাচক ফলাফল যেমন ডিসপেরোনিয়া বা মিলনকালীন ব্যথা অথবা স্বামীর যৌনরোগ যেমন: দ্রুত বীর্যপাত, লিঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যা যা স্ত্রীর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্ত্রীর উত্তেজনা আসার আগেই মনে হতে পারে উত্তেজিত হয়ে লাভ কী বা আগ্রহ করে লাভ কী-আবার তো কষ্ট পাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।

অনেকে যৌন নিপীড়নের শিকার হন। কারো অতীত জীবনে এ ধরনের অভিজ্ঞতা থাকলে পরবর্তী জীবনে যৌন উদ্দীপনায় যথাযথ সাড়া দিতে পারেন না। আর ভীতি যে কারণেই হোক তা যৌন অনুভূতি নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। জেনিটো-পেলভিক পেইন বা পেনিট্রেশন ডিজঅর্ডার- জেনিটো শব্দ দিয়ে জননাঙ্গ বুঝানো হয়। পেলভিক শব্দটা তল পেটের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। পেনিট্রেশন বলতে প্রবিষ্ট করানো বা ঢোকানো  ‍বুঝি। জেনিটো-পেলভিক পেইন বা পেনিট্রেশন ডিজঅর্ডার নারীদের একটি যৌনরোগ। এই রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো মিলিত হতে গেলে নারী ব্যথা পায়।

দুই জায়গায়ই সে ব্যথা অনুভব করতে পারে- এক. তার জননাঙ্গ বা যোনিতে আর দুই. তার তল পেটে। ফলে যৌন- মিলন তার জন্য ঝামেলার হয়ে পড়ে। কখন আমরা বুঝব একজন নারী জেনিটো-পেলভিক পেইন বা পেনিট্রেশন ডিজঅর্ডারে ভগছে? যদি সে নীচের বর্ণিত সমস্যাগুলোর একটি বা ততোধিক অনুভব করে:
– যৌনমিলনে কষ্ট হওয়া
– জেনিটো-পেলভিক ব্যথা
– ব্যথা পাবে ভেবে ভয় পাওয়া
– পেনিট্রেশনে ভয় পাওয়া
– তলপেটের নিচের দিকের মাংসপেশি শক্ত বা আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া

পূর্বে এ ধরনের সমস্যাকে দুইটি ভাগে ভাগ করা হত। যারা ব্যথার সমস্যায় ভুগত তাদেরকে বলা হতো- তারাডেসপেরোনিয়া বা ব্যথাযুক্ত মিলনে ভুগছে। আর যারা পেনিট্রেশন সমস্যায়  ‍ভুগত তাদেরকে বলা হতো- তারা ভেজিনিসমাসে ভুগছে। কিন্তু এভাবে পৃথক করাটা অনেক সময়ই সম্ভব হতো না। কারণ এমন অনেক রোগী আছে যারা একই সাথে উভয় সমস্যায় ভোগে। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে একটা সমস্যার জন্য আরেকটা হয়। যেমন দেখা গেলো একজন হয়ত ভেজিনিসমাসে ভুগছে, সেই ভেজিনিসমাসের কারণে পরবর্তীতে ব্যাথাযুক্ত মিলনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই সহজ করার জন্য বর্তমানে একত্রে একটি শিরোনামে দেখা হয়।

অনেক সময় ফিমেল অর্গাজমিক ডিজঅর্ডার রোগটি ডায়াগনোসিস হয় না। দেখা যায় উল্টো স্বামীকে দোষারোপ করা হয় দ্রæত বীর্যপাতের জন্য। কারণ এই রোগে একজন নারীর অর্গাজম বা চরম পুলক সেভাবে হয় না। এই চরম পুলকের সমস্যা দুইভাবে দেখা দিতে পারে।
– চরম পুলক আসতে দেরি হওয়া অথবা একদমই না আসা
– চরম পলক হলেও আগের মতো তীব্র না হওয়া

আক্রান্তের হার
আমাদের দেশে নারীর যৌন সমস্যা নিয়ে কোনো জরিপ পরিচালনা করা হয়নি। ইউরোপ ও আমেরিকায় যে জরিপ পরিচালিত হয়েছে তার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যদি বলি তাহলে বলা যায় আমাদের দেশে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা সেখানকার  ‍তুলনায় কম হবে। সেখানে প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে একজন ফিমেল সেক্সুয়াল ডিজফাংশন বা যৌন সমস্যায় ভোগেন।

চিকিৎসা
যদিও আগামী বছরগুলোতে ওষুধ কোম্পানির জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ যৌন অনীহার ওষুধ খুঁজে বের করা। যৌন উত্তেজক নির্ভরযোগ্য কোনো ওষুধ বাজারে নেই। তারপরেও বলব, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। অনেক রোগীর ক্ষেত্রেই সেক্সথেরাপি ভালো কাজ করে। জেনিটো-পেলভিক পেইন বা পেনিট্রেশন ডিজঅর্ডারের ক্ষেত্রেও ভাল চিকিৎসা আছে।

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

 

 

 

Previous articleমহামারী এবং নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য
Next articleগাঁজা সেবনে যত সমস্যা
ডা. এস এম আতিকুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here