দীর্ঘ দাম্পত্য অতঃপর সঙ্গীবিহীন মন

দীর্ঘ দাম্পত্য অতঃপর সঙ্গীবিহীন মন

‘… কয়েকদিন হলো তোমার মা আমায় খুব জ্বালাচ্ছে। তাকে হারানোর ১৫ বছর পর এমনটা কেন ঘটছে তা বুঝতে পারছি না। স্বপ্নে সে কেবল ডেকেই যাচ্ছে। আমার আরো অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছা করে এবং বৃদ্ধাশ্রমের খালি ঘরগুলোতে কারা আমার বন্ধু হয় তা দেখতে সাধ হয় কিন্তু সে সৌভাগ্য আমার হবে না বোধহয়! আমি মারা যাওয়ার পর, তোমার মায়ের পাশেই আমাকে কবর দিও। এতে কিছুটা জায়গা নষ্ট হবে ঠিক কিন্তু তোমার মাকে ছেড়ে আমি দূরে থাকতে পারব না। আমার এ আবদারটুকু রেখো। রাখবে তো? আমায় ক্ষমা করে দিও। তোমার অক্ষম জন্মদাতা, নতুনপল্লী বৃদ্ধাশ্রম।’’

ওপরের গদ্যাংশটুকু বৃদ্ধাশ্রম থেকে ছেলেকে লেখা অসহায় বৃদ্ধ বাবার আবেগী চিঠির শেষাংশ। একটি বাংলা অনলাইন পত্রিকায় এই শিরোনামেই ২৯ মে, ২০১৯-এ প্রকাশিত হয় চিঠিখানা। চিঠির বিষয়বস্তু ক্রমবিকাশমান একটি সামাজিক সমস্যা নিয়ে হলেও আজ আমি সেদিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি না। প্রশ্ন হলো, এই বৃদ্ধের মৃত স্ত্রীর সাথেই মিলিত হবার এই আকুতি কেন? উত্তর খুবই সহজ, আমাদের সবার জানা, বৃদ্ধটি এখন বেশিরভাগ সময় তার স্ত্রীর কথাই ভাবেন, তার স্মৃতিই মনে পড়ে, নিজের পাশে তাকেই দেখতে চান; আজকালের ভাষায় ‘মিস করেন’। মৃত স্ত্রীর সঙ্গই এখন তার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। অথচ পারিবারিক ইতিহাস ঘাটলে হয়ত দেখা যাবে স্বৈরাচারী শাসকের মতো এই বৃদ্ধের একনায়কতন্ত্রে স্ত্রী ছিলেন নিতান্তই সাধারণ নাগরিক, যার না ছিল বাক্-স্বাধীনতা, ছিল না মত প্রকাশের অধিকার। অধিকাংশ বৃদ্ধেরই জীবনচিত্র তাই।

Francis Baconএর মতে ‘Wives are young men’s mistresses, companions for middle age, and old men’s nurses.’ অর্থাৎ স্ত্রী যুবক স্বামীর প্রভু, মধ্যবয়সী পুরুষের বন্ধু এবং বৃদ্ধের জন্য সেবিকা। আমাদের এই প্রাচ্যের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় স্ত্রীগণ হয়ত বা সমাজের সকল স্তরে পুরুষের প্রভু নন কিন্তু মধ্যবয়সে কিছুটা বন্ধু বা সহকর্মী এবং বৃদ্ধ বয়সে একই সাথে বন্ধু ও সেবিকা। গ্রামীণ যৌথ পারিবারিক কাঠামোর চেয়ে শহুরে একক পারিবারিক কাঠামোয় এই চিত্র আরো বেশি স্পষ্ট।

প্রায় সব সমাজেই বিয়ে নামক সামাজিক আচারঅনুষ্ঠানের মাধ্যমে একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদেশে একজন মানুষের জন্য এটাই সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক, যার পরিসমাপ্তি হয় একজন সঙ্গীর মৃত্যুর মাধ্যমে। এই দীর্ঘ সময় একটি দম্পতি তাদের পরস্পরের সঙ্গে ঘরের স্থানের সাথে মানসিকতাও (যেমন, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, রাগ-বিরাগ, সুখদুঃখ, আবেগ-অনুভ‚তি) ভাগাভাগি করে নেয়। একে অন্যের নানা প্রয়োজন মেটায়। দুজন মিলে একটি ইউনিট হিসেবে কাজ করে। একপর্যায়ে তারা সন্তান লাভ করেন, এর বৃদ্ধি ও বিকাশে দম্পতি আত্মনিয়োগ করেন। এই সন্তানের মাধ্যমে তাদের পারস্পরিক বন্ধন আরো দৃঢ় হয়, সন্তানের লালন-পালনে তাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা আরো বৃদ্ধি পায়। এভাবে সরল অর্থে একটি মিথোজীবী সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুজন মানুষ একসঙ্গে বেড়ে ওঠেন, একইসঙ্গে তিন চার দশক চলার পর একপর্যায়ে বয়স্ক হন। তাদের সামাজিক অবস্থান ও সামাজিক ভূমিকার পরিবর্তন হয়। সন্তানেরা বড়ো হয়, তারা নিজেদের পরিবার গঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই পুরোনো দম্পতির পারস্পরিক নির্ভরশীলতা আরো বাড়ে। এ পর্যায়ে তারা যথার্থই বন্ধু বা সাথী হয়ে ওঠেন।

বৃদ্ধ বয়সের পরিবর্তনগুলো কয়েকটি দিকে হয়; যেমন-শারীরিক পরিবর্তন, মানসিক পরিবর্তন, সামাজিক পরিবর্তন ইত্যাদি। শারীরিক পরিবর্তনগুলো হচ্ছে দৈহিক শক্তি বা সক্ষমতার হ্রাস, বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধির আবির্ভাব ইত্যাদি। মানসিক পরিবর্তনের মধ্যে স্মৃতি শক্তি হ্রাস, মন-মেজাজের পরিবর্তন, চিন্তাভাবনার ধীরগতি ইত্যাদি উল্লেখ্য। সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে পরিবারে ও সমাজে অবস্থানের পরিবর্তন, অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা এসবই প্রধান। এই বহুমাত্রিক পরিবর্তনের প্রভাবে বৃদ্ধ দম্পতির মধ্যে নির্ভরশীলতা আরো বেড়ে যায়। স্বামী ও স্ত্রী দুজন পরস্পরের সাহায্যের দ্বারা তাদের অক্ষমতার মাত্রা কমানোর চেষ্টা করে থাকেন।

এভাবে পথ চলতে চলতে কোনো একসময় একজন থেমে যান। এই সঙ্গী বিয়োগের দুঃখবোধ কতটা, এর মাত্রা কেমন? কেউ কি মেপে দেখেছে! নাকি মাপা সম্ভব! কবি জসীম উদ্দীন তাঁর বিখ্যাত কবর কবিতায় সে চেষ্টা করেছেন- “এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম-গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। … এমনি করিয়া জানি না কখন জীবনের সাথে মিশে ছোট-খাটো তার হাসি-ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে। …. আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়, কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝঝুম নিরালায়।”

এই দুঃখের মাত্রা বা পরিমাণ নির্ণয় এখনো সম্ভব না হলেও বিভিন্ন রকমের দুঃখের তুলনামূলক মাত্রা নির্ধারণ সম্ভব। মনোবিজ্ঞানীগণ সে কাজটি করেছেন। দৈনন্দিন আলাপে একটি প্রশ্ন অনেকেই করেন যে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু কী? উত্তর হচ্ছে-বাবার কাঁধে সন্তানের মৃতদেহ। পিতার কাছে সন্তানের মৃত্যুর কষ্টের তীব্রতা বোঝাতেই এই উপমা। তবে কি সন্তানের মৃত্যুই মানুষের অনুভূত সবচেয়ে কষ্টদায়ক অনুভূতি। মনোবিজ্ঞানের গবেষণা কিন্তু তা বলে না। মানুষের দুঃখানুভূতির তালিকায় সবার ওপরে আছে, বৃদ্ধ বয়সে সঙ্গী বা স্বামী এবং স্ত্রী হারানোর বেদনা। গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে, দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন কাটানো দম্পতিদের কোনো একজনের মৃত্যু অপর জনের মৃত্যুকেও ত্বরান্বিত করে। আলঝেইমার রোগের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, আকস্মিক সঙ্গীর মৃত্যু এ রোগের প্রকাশ এগিয়ে দেয় এবং রোগের বিস্তার দ্রুত করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ২১০১ জন পঞ্চাশোর্ধ্ব নাগরিকদের ওপর ২০০২ থেকে ২০০৮ অবধি পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিঃসঙ্গতা পরবর্তী ৬ বছরে মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। সমসাময়িক অন্য গবেষণায় দেখা যায়, নিঃসঙ্গ ব্যক্তি বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন। সেইসঙ্গে এমন ব্যক্তিদের শারীরিক রোগাক্রান্ত হওয়ার হার বেড়ে যায়, আরোগ্য লাভের হার হ্রাস পায়। এই হার বৃদ্ধিতে কেবল অস্বাস্থ্যকর জীবনাচরণ দায়ী তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। নিঃসঙ্গ ব্যক্তিদের মধ্যে বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তাসহ আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি।

অনেকেই মনে করেন নিঃসঙ্গ দাম্পত্য জীবন ব্যাধির মতোই মারাত্মক। পশ্চিমা সমাজে এই সমস্যা অধিক প্রকট। বৃদ্ধ বয়সে নিঃসঙ্গতা মানুষকে চূড়ান্ত অবসাদের দিকে ঠেলে দেয়। মাদকসেবন বা শারীরিক স্থূলতার মতো নিঃসঙ্গ দাম্পত্য জীবনও অনাকাক্ষিত পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন ক্রয়ের বিশেষ অফার

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে

Previous articleঅন্যের ছেলেমেয়ের সঙ্গে তুলনায় সন্তানের মানসিক সমস্যা তৈরি করে: গবেষণা
Next articleটিকা নিতে ভয়: ট্রাইপ্যানোফোবিয়া
ডা. নাসির উদ্দিন আহমেদ
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here