জুয়াখেলা-একটি মানসিক রোগ

‘জুয়াখেলা’ একটি খেলা। খেলা হলেও এই শব্দযুগল খেলার মতো সহজ-সরল আনন্দদায়ক অর্থ নিয়ে এটি সবসময় পড়ে থাকে না। জুয়া আরো ভিন্ন কিছু, ভিন্ন আচরণ, ভিন্ন মাত্রা। জুয়া শব্দটি শোনার সাথে সাথে মনের মাঝে এক ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। জুয়া যখন একজন মানুষের চিন্তা-ভাবনা, কাজকর্ম, আচার-আচরণ সব কিছুকে নীরবে গ্রাস করে নেয়, যখন বারবার চেষ্টা করার পরও সেই কাজ থেকে বিরত থাকা যায় না, ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক-পারিবারিক বা সামাজিক সমস্ত সম্পর্ক এবং অবস্থান নষ্ট হতে থাকে তখন সেটা শুধুই খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সেটা তখন মানসিক রোগের মধ্যেই পড়বে। মাদকাসক্তির মতো এটিও তখন নেশার পূর্ণরূপ নিয়ে হাজির হয়। একজন মানুষের সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে।

জুয়ায় আসক্তি
যখন কোনো খেলার ভেতর ডুবে গিয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক সকল কাজের প্রতি অবহেলা চলে আসে, যখন সেটা নিজের জন্য কিংবা অন্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায় সর্বোপরি-খেলা যখন খেলার আনন্দের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে যায় তখন সেটা আর শুধুই খেলা থাকে না। হয়ে যায় আসক্তি। জুয়ার ক্ষেত্রটিও তাই-খেলার অধিক বনে গিয়ে হয়ে যায় জুয়া আসক্তি। জুয়ার আসক্তিতে, জুয়া খেলার জন্য মনের ভেতর অসম্ভব ও অনিয়ন্ত্রিত এক ধরনের চাহিদার সৃষ্টি হয়। নিয়ন্ত্রণাতীত সেই চাহিদা পূরণ না করে থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যেকোনো কিছুর বিনিময়েই আসক্ত মানুষটি সেই চাহিদা পূরণ করতে চায় এবং জুয়া খেলতে চায়। আক্রান্ত মানুষটি তখন জুয়া খেলার চাহিদাটিকে নিয়ন্ত্রণ না করে বরং জুয়াখেলা সংক্রান্ত আচরণগুলোকে লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। বিষয়টি লুকিয়ে রাখার জন্য সব ধরনের কৌশলই তারা অবলম্বন করে। তারা চায় না তাদের এই আচরণ মানুষ জেনে যাক। লুকানো, মিথ্যাচার এমনকি বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার পথ বেছে নিতেও তারা পিছপা হয় না। কিছুতেই সেই কাজটি থেকে তারা নিজেদেরকে দূরে রাখতে পারে না। এই আসক্তি একজন মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

জুয়ায় আসক্তিতে আচরণগত পরিবর্তন
টাকা, অর্থাৎ অর্থনৈতিক লাভের চেয়ে জুয়াখেলার উত্তেজনা বা এক্সাইটমেন্টই এর পেছনে বেশি কাজ করে। বেশিরভাগ সময়ই জুয়াখেলা বা খেলার ভাবনা নিয়েই সময় পার হয়। দিনকে দিন বড়ো ধরনের বাজি ধরতে প্রস্তুত থাকে। পেছনের হার বা ক্ষতির কথাও তারা মনে রাখে না। অনেকে ব্যক্তিগত সমস্যা, অসহায়ত্ব এমনকি বিষণ্ণতা ঢাকার জন্যও জুয়া খেলে। পরিবার বা পেশাগত কাজে অবহেলা চলে আসে। নিজেকে সবসময় লুকিয়ে রাখার বা আড়ালে থাকার চেষ্টা করে। টাকা পয়সা লুকানো-সরানো এমনকি চুরির প্রবণতাও দেখা যায়। নিজের ভেতর এক ধরনের হীনম্মন্যতাও কাজ করে। বারবার চেষ্টা করেও সেখান থেকে সরে আসতে পারে না। অনেকে আবার এসবকে সমস্যা হিসেবে মানতেও রাজি নয়। যারা এ ব্যাপারে নিষেধ করে বা করতে পারে তাদেরকে এড়িয়ে চলে। জুয়া বিষয়টিকে লুকানোর জন্য যেকোনো ধরনের মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যার আশ্রয় নেয়া অভ্যাসে পরিণত হয়। জুয়ার আসক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে সেটা কখন বুঝব :

  • যখন দিন দিন জুয়ার পেছনে সময় এবং শক্তি দুটোই নষ্ট হতে থাকে।
  • যখন চেষ্টা করেও অভ্যাসটি পরিবর্তন করা যায় না। ক্স যখন মানুষের সাথে সম্পর্ক, অর্থনৈতিক অবস্থা কিংবা কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা শুরু হয়।
  • যখন পরিবার বা কাছের মানুষের কাছে জুয়া খেলার বিষয়টি চেপে যেতে দেখা যায়।
  • যখন অর্থ যোগানোর জন্য চুরি কিংবা প্রতারণার প্রবণতা তৈরি হয়। ক্স যখন গচ্ছিত টাকা বা সম্পদ ধীরে ধীরে কমতেই থাকে।
  • যখন অন্যের কাছে টাকা পয়সা ধার-দেনা শুরু হয়। ক্স যখন জুয়াখেলার সাথে সাথে বিভিন্ন অপরাধচক্রের সাথে সম্পর্ক বাড়তে থাকে।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সম্পূর্ণ মানুষটি ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। স্বাভাবিক চলাফেরা, কাজ বাদ দিয়ে অস্বাভাবিক একধরনের কার্যাচরণের ভেতর দিয়ে দিন পার হতে থাকে।

কখন চিকিৎসার কথা ভাবা উচিত?
পরিবারের কেউ বা কোনো কাছের মানুষ, বন্ধু, কিংবা পেশার স্থানের কেউ বিষয়গুলো জেনে যায় বা বুঝে যায়, সেইসঙ্গে তারা যখন বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয় তখনই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত মানুষটি বিষয়টিকে পাত্তা দিতে চায় না (denial is almost always)। অনেকে আসক্তির বিষয়টি নিজে নিজে বুঝতেও পারে না। মনে রাখতে হবে, অনেক সময় নিজে নিজে অনেক কিছুই বোঝা যায় না যা কাছের মানুষ বুঝতে পারে।

জুয়া আসক্তির কারণ
একেবারে সঠিক কারণ বলতে না পারলেও এর পেছনেও বায়োলজিক্যাল, জেনেটিক বা পরিবেশের প্রভাব থাকার কথা বলা হয়। সবকিছুর ভেতর পরিবেশ বা বন্ধুবান্ধবদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার প্রবণতাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। দেখা যায় প্রথমে বিষয়গুলেকে আনন্দ বা খেলার অংশ হিসেবেই শুরু হয়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে আসে।

কাদের জুয়ায় আসক্ত হবার সম্ভাবনা বেশি
নারী-পুরুষ দুজনের ভেতরই এ সম্ভাবনা থাকলেও, পুরুষরাই এতে বেশি আসক্ত হয়। বছরের পর বছর কার্ড (তাস) খেললেও বা বাজি ধরলেও অনেকে জুয়ায় আসক্ত নাও হতে পারেন। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় আছে যেসব জুয়ায় আসক্ত হবার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়-

  • যেসব পরিবারে, অর্থাৎ পিতা-মাতার মধ্যে এই প্রবণতা থাকে তাদের সন্তানদের মাঝেও এই আসক্তি বেশি হয়।
  • পুরুষদের মাঝেই অপেক্ষকৃত বেশি হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কম বয়সেই তারা আক্রান্ত হয়।
  • নারীদের মাঝে অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সে এই আসক্তি আসতে দেখা দেয়।
  • কিন্তু নারীরা সহজেই আসক্ত হয়ে যায়। দেখা যায়, কোনো কারণে ডিপ্রেশন বা অন্যকোনো মানসিক সমস্যা থেকে আপাতত দূরে থাকার জন্য বা ভুলে থাকার জন্যই তারা এই কাজে বেশি ঝুঁকে পড়ে এবং সহজেই আসক্ত হয়ে যায়।
  • যারা সারাক্ষণ প্রতিযোগিতায় থাকতে বা করতে পছন্দ করেন এমন সব ব্যক্তিত্বের মাঝে এই আসক্তি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • কিছু কিছু অন্যান্য মানসিক রোগ বা সমস্যার কারণেও জুয়া আসক্তি বেশি হতে পারে। যেমন-নেশাগ্রস্ত, পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার, এডিএইচডি, ডিপ্রেশন, যৌন সমস্যা।
  • জুয়ায় আসক্ত বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবেশ।

জুয়া আসক্তির ক্ষতিকর দিক
ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক যেকোনো দিকেই এর প্রকট ও লম্বা সময়ের প্রভাব পড়তে দেখা যায়। অনেকে নিজে সেসব বুঝতে না পারলেও যেসব ক্ষতিকর দিক লক্ষ করা যায়; সেসব হলো-

  • মানুষের সাথে সম্পর্কের সমস্যা সৃষ্টি হওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া।
  • অর্থনৈতিক সমস্যা, এমনকি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়া।
  • আইনগত সমস্যা, থানা-পুলিশ-জেল বিষয়ক জটিলতা। ক্স কর্মজীবন ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা চাকরিতে সকলের কাছে ছোট হয়ে থাকা।
  • নেশা কিংবা বিভিন্ন অপরাধচক্রে জড়িয়ে পড়া।
  • অন্যকোনো মানসিক রোগ বা আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া।

জুয়া আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে : জুয়া আসক্তির বিভিন্ন ক্ষতিকর দিকগুলো ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আসক্ত মানুষজন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব মনে করতে চায় না বা মনে রাখে না। এই অভ্যাস বদলে ক্ষতিকর প্রভাব-লক্ষণও কিংবা পেছনের কারণগুলোকে বিশ্লেষন করে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। নিজে নিজে অন্তত এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে, আমি জুয়া খেলা বাদ দিতে চাই। জুয়া থেকে মুক্তি পেতে চাই। যেহেতু চাহিদা এমন পর্যায়ে থাকে যেখানে নিজেকে বিরত রাখা কঠিন, তাই পেশাগত বা প্রফেশনালদের সাহায্য নেয়া প্রয়োজনীয়। তবে তার আগে-

  • জুয়া নিয়ে নিজের সমস্ত অনুভূতিগুলি লিখে ফেলুন। নিজে পারলে নিজে অথবা অন্য কারো সহায্য নিয়ে লিখতে পারেন।
  • কখন-কিসে-কীভাবে-কেন জুয়া খেলার ইচ্ছা বেড়ে যায়, ভালোভাবে মনে করার চেষ্টা করুন এবং পারলে লিখে ফেলুন।
  • জুয়া বাদে অন্য আরো যেসব বিষয় আপনার আস্বস্তি তৈরি করছে, সেসব কিছুই লিখে ফেলুন।
  • কতবার কীভাবে জুয়া খেলা বন্ধ করতে চেয়েছেন কিন্তু পারেননি তার বিস্তারিত মনে করুন এবং লিখে ফেলুন।
  • কেন পারেননি সেটাও লিখে ফেলুন।
  • জুয়া বর্তমানে আপানর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে সেটারও বিস্তারিত নোট করুন।
  • জুয়ার বাইরে অন্য কোনো মানসিক চাপ, সমস্যা কিংবা বড়ো কোনো ঘটনা থাকলে সেটাও ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।
  • অন্য কোনো শারীরিক রোগ, নেশা বা ঔষধ খেয়ে থাকলে সেটিও লিস্ট করে ফেলুন।

চিকিৎসা ও সচেতনতা
চিকিৎসার আগে যে বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি তা হলো-এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি। সেটা আসক্ত মানুষটির জন্য যেমন, তেমনই সমাজের অন্যদের জন্যও প্রযোজ্য। আসক্তি বিষয় সম্বন্ধে ভালো করে জানাও জরুরি। তার ক্ষতিকর দিকগুলোও জানা প্রয়োজন। এটিও জানা দরকার যেকোনো ধরনের আসক্তিই এক ধরনের মানসিক সমস্যা বা রোগ। জুয়ার আসক্তি চিকিৎসা সহজ বিষয় নয়। বেশিরভাগ আসক্তরাই এটাকে কোনো সমস্যা হিসেবে মানতেই চান না। যদি কেউ সেটা মেনেও নেন, তবে সেটা চিকিৎসাযোগ্য সেটাও মানতে নারাজ। তাই আসক্তি, এর ক্ষতিকর দিক বা প্রভাব, চিকিৎসা, সর্বোপরি এটি একটি রোগ এ বিষয়ে জানতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, ভালো করে চিকিৎসা করলে নিজের ওপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পাবে। সেইসঙ্গে হারানো সম্মান, অর্থ, সামাজিক প্রতিষ্ঠা, পেশা সবকিছুতেই নিজেকে ফিরে পাবার সুযোগ তৈরি হবে।

চিকিৎসার প্রধান প্রধান ধাপ
সাইকোথেরাপি : আপনার অনিয়ন্ত্রিত চাহিদাকে কমিয়ে, সেসবের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে সহায়তা করবে। সেইসঙ্গে নেতিবাচক চিন্তাগুলিকে পরিবর্তন করে গ্রহণযোগ্য চিন্তা মনে স্থান করে নিতে সাহায্য করবে। রাগ বা মেজাজকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সাইকোথেরাপি সাহায়ক হবে।

ঔষধ : জুয়ার আসক্তির পাশাপাশি অন্য কোনো মানসিক রোগ যেমন : ডিপ্রেশন, ওসিডি, নেশা কিংবা পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার থাকলে সেগুলোকে যদি চিকিৎসার আওতায় আনা হয় তাহলে সেটা জুয়ার ব্যাপারেও সহায়ক হবে। আগে থেকে কোনো ঔষধ যদি ‘মুড’ এর সমস্যা বাড়িয়ে দেয় সেসবও খেয়াল করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনমতো অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বা মুডস্টেবিলাইজার যেকোনো আসক্তিতেই উপকারী।

সেল্ফ হেল্প গ্রুপ : এটি এক ধরনের বিশেষ গ্রুপ যারা নিজেরা নিজেদের সাহায্য করতে পারে। যারা জুয়ায় আসক্ত বা আসক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করেছেন সেই ধরনের মানুষদের নিয়ে এমন গ্রুপ। যেখানে নিজেদের সমস্যা বা সমস্যামুক্ত হবার বিষয়গুলি নিজেরা আলাপ করে সমাধানের পথ খুঁজতে পারেন।

মনে রাখতে হবে, সব কিছু করার পরও একজন আবার আসক্ত হয়ে যেতে পারে, যদি অন্য আসক্তদের সাথে কিংবা আসক্ত হওয়ার মতো পরিবেশে সময় কাটায়। এটা সবার জন্যই প্রযোজ্য; যিনি আসক্ত ছিলেন এবং যিনি আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত।

Previous articleআমার সিজোফ্রেনিয়া রোগ হয়েছিল
Next articleপর্নের নেশা থেকে বেরিয়ে আসার সহায়ক কিছু উপায়
অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যাি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here