চীন ব্যাপক হারে কোভিড ১৯ সংক্রমন নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে । যেই দেশটি ১৪০ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ এবং যা আয়তনে প্রায় ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান, সেই দেশে মহামারী আকারের সংক্রমনের বদলে অল্পসংখ্যক কিছু বিচ্ছিন্ন সংক্রমনের কথা শুনা যায় । মহামারী সম্পর্কিত সতর্ক বার্তা, স্বচ্ছতা ও মানবাধিকার বিষয়ক ইস্যুতে চীন কে তার ভূমিকা এবং কর্তব্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার মুখোমুখী হতে হয়েছে । কিন্তু, শত সমালোচনার মাঝেও চীন এই মহামারী নিয়ন্ত্রনে রাখার মধ্য দিয়ে যে সফলতা অর্জন করেছে তা দেখে বিশ্বের বাকি দেশের অনেক কিছু শেখার আছে ।
চীনের পদক্ষেপ সমূহ যাচাই তাদের নিজস্ব গবেষনা ও জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব এর বিষয়টি স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় । সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম (সার্স ) এর তুলনায় কোভিড ১৯ এর জন্য চীন অধিক পরিমাণে প্রস্তুত ছিল। কারন ২০০২ সালে সার্স যখন মহামারী আকার ধারন করে তখন চীন সেই জীবাণু সম্বন্ধে অজ্ঞাত থাকায় তারা শুরুতে অপ্রস্তুত ছিল । কিন্তু ডিসেম্বর ২০১৯ এ যখন কোভিড ১৯ শনাক্ত হয় তখন চীনের বিজ্ঞানীগণ অতি দ্রুততার সাথে ভাইরাস শনাক্ত করেন এবং ১১ ই জানুয়ারি ২০২০ এ ভাইরাসটির জিনোম সিকুয়েন্স উদঘাটনে সচেষ্ট হন ।
জানুয়ারির শেষদিকে “দ্যা ল্যান্সলেট” নামক সাময়িকীতে চীন ও হংকং এর ডাক্তারগণ কোভিড ১৯ এর রোগীদের চিকিৎসা পদ্ধতি , সংক্রমন বৃদ্ধির কারন, জিনগত পরিচয়, রোগবিস্তার রোধে করণীয় এবং সারা বিশ্বের সামনে কোভিড ১৯ এর ভয়াবহতা তুলে ধরা সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন । মে ও জুলাই মাসে একই সাময়িকীতে চীন দাবি করে যে তাদের বানানো রিকম্বিন্যান্ট এডিনো ভাইরাস টাইপ ৫ ভেক্টরড ভ্যাক্সিন এর ১ম দফার পরীক্ষায় সফলতার মধ্য দিয়ে চীন ভ্যাক্সিন গবেষনায় অগ্রগামী ভূমিকায় রয়েছে । দেশে জরুরী অবস্থা জারি থাকা সত্বেও চীন অত্যন্ত দ্রুততা ও বিচক্ষনতার সাথে এই গবেষনা সম্পন্ন করতে সক্ষম হয় । চীনের জনস্বাস্থ্য ও গবেষনা খাতে উন্নয়ন এর লক্ষ্যে বিনিয়োগ, নিম্নআয়ের বা মধ্যম আয়ের অন্যান্য দেশের জন্য অনুকরনীয় । তাদের প্রাথমিক লক্ষ্যই ছিল জাতীয় মহামারীতে দ্রুততার সাথে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা ।
দ্বিতীয় শিক্ষনীয় বিষয় হল উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সহায়তা ব্যাতিত কেবল গবেষনা প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে মহামারীর নিয়ন্ত্রনে বিজ্ঞানসম্মত ও নির্ভরযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব নয় । সরকার ও শাসকগোষ্ঠীকে বৈজ্ঞানিক পন্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে , এর মূল্য বুঝতে হবে এবং বিজ্ঞানকে সমাজের উন্নয়নের সর্বোৎকৃষ্ট পথ হিসেবে বেছে নিতে হবে । চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞদের তিনটি দল উহানে পাঠান। যারা কোভিড ১৯ এর ঝুঁকি এবং সংক্রমণ বিষয়ে তদন্ত করেন ও তাদের সুপারিশের কারনেই ২৩ জানুয়ারী উহানকে লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
তৃতীয়ত, কোভিড ১৯ এর নিয়ন্ত্রণের জন্য দ্রুত এবং কার্যকর ব্যবস্থার অর্জন করতে প্রয়োজন সম্প্রদায়িক সংযুক্তি। চীনে কোভিড ১৯ প্রাদুর্ভাবের সময় জনগণের সংহতি নজিরবিহীন ছিল । ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তখেপকারি নিয়ম নীতি যেমন বাধ্যতামূলক মুখোশ পরার মত নিয়ম জনগণ সহজেই গ্রহণ করেছিল। সিওহুয়া নিউজ এজেন্সি অনুসারে, কয়েক মিলিয়ন চীন কমিউনিটি কর্মীরা তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যের অবস্থা নির্ণয় ও অসুস্থ ব্যক্তিদের যেমন জ্বর, গুরুতর রোগ, গর্ভবতী মহিলাদের এবং বাড়িতে সীমাবদ্ধ আছেন এমন ব্যক্তিদের সহযোগিতার মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে প্রথম সারির প্রতিরক্ষা গড়ে তুলে। যেখানে অনেক দেশই তাদের স্বাধীনতা এবং সুরক্ষার নিয়ে চিন্তিত সেখানে চীন এর কিছু পদ্ধতি যেমন ক্রমাগত নজরদারি করা ইত্যাদি অন্যত্র সহজে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তবে চীনের অভিজ্ঞতাগুলি সম্প্রদায় সংহতির উপর গুরুত্ব আরপ করে ।
সুতরাং, চীন থেকে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা শেখার প্রয়োজন রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে কীভাবে চাইনিজ এবং বিশ্ব সম্প্রদায় স্বাস্থ্য বিষয়ক ব্যপারে একসাথে কাজ করবে সে ব্যপারে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন যে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আরও বেশি পরিমাণে বিশ্বায়নের প্রয়োজন কেননা তা সবার জন্যই উপকারী, সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ও উন্নতি করার জন্য বহুপাক্ষিকতাও দরকার। স্বাস্থ্যখাতে চীন বিশ্বব্যাপী একটি বহুপক্ষীয় নেতা হয়ে উঠবে কিনা, এবং নেতা হলেও সে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কী ভূমিকা পালন করবে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি শূন্যস্থানটি পূরণ করতে পারবে কিনা তা দেখার জন্য বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অপেক্ষা করছে । চীন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বহু ক্ষেত্রে বিভিন্ন বৈধ প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে তবে কোভিড ১৯ মহামারীর কারনে চীন এই সকল প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছে যা গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া নয়।
মহামারীর মতো জরুরী ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য এর এহেন দুর্যোগ মোকাবেলায় সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। কোভিড ১৯ এর মোকাবেলার জন্য বিশ্ব সংহতির অভাব, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আমাদের সকলের জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করবে ইতিমধ্যে সকলেই এটা অনুধাবন করতে পেরেছেন। তাই হয়ত নেলসন ম্যান্ডেলা বার্ষিক বক্তৃতায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন “এখন বিশ্বব্যাপী নেতারা সিদ্ধান্ত নেবেন: আমরা কি বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলার কাছে আত্ম সমর্পণ করব? নাকি সকলের মঙ্গলার্থে অতীতের ভুলগুলি সংশোধন করব? ”
মূলঃ https://www.thelancet.com/…/la…/PIIS0140-6736(20)31637-8.pdf
অনুবাদঃ নাওমি নুর, সম্পাদনাঃ ডা. মোঃ রিজওয়ানুল করিম
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন