শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যে ধর্ষণের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ প্রভাব নিয়ে গত ১৬ই মার্চ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট মেন্টাল হেলথ এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সম্মেলনের আয়োজন করে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট মেন্টাল হেলথ-এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব, সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. রাহানুল ইসলাম, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবর রহমান, বিএসএমএমইউ-এর শিশু-কিশোর মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোর্শেদ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সাইকিয়াট্রিস্টস-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যা সচিব অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দীন এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মী।
অনুষ্ঠানে প্রথম প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডা. শবনম সাবা, যেখানে তিনি ধর্ষণের সংজ্ঞা, আইনি দিক ও সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, ধর্ষণ শুধুমাত্র ভুক্তভোগীর জন্যই নয়, বরং এটি সমাজের প্রতিটি স্তরে গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি আরও বলেন, ধর্ষণের ফলে শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়।
শারীরিক প্রভাব:
- অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ও অনিরাপদ গর্ভপাত
- যৌন সংক্রমণ, যার মধ্যে এইচআইভি/এইডস অন্তর্ভুক্ত
- তলপেটে ব্যথা ও পেলভিক প্রদাহজনিত রোগ
- দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথা ও অনিদ্রা
মানসিক প্রভাব:
- বিষণ্নতা ও পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি)
- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা
- মাদক বা অ্যালকোহলের প্রতি আসক্তি
- শিশু-কিশোরদের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন
উক্ত অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডা. নিশাত তামান্না নূর, যেখানে তিনি ধর্ষণ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশে গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, গণমাধ্যম যদি সংবেদনশীলভাবে ধর্ষণের ঘটনা প্রচার করে, তবে তা জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে, ভুক্তভোগীকে দোষারোপ বা তার ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করলে মানসিক চাপে পড়ে তার মানসিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হতে পারে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, যেমন:
- ভিকটিমকে “সারভাইভার” হিসেবে উপস্থাপন করা
- অপরাধীর দৃষ্টিভঙ্গিকে মহিমান্বিত না করা
- সহিংসতার বর্ণনা রগরগেভাবে না উপস্থাপন করা
- সহায়তা কেন্দ্রগুলোর তথ্য প্রচার করা
ধর্ষণের ঘটনাকে গণমাধ্যমে মুখরোচক সংবাদের অংশ না করার পরামর্শ দিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবর রহমান বলেন, অপরাধী যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়, সে বিষয়টি আগে নিশ্চিত করা জরুরি। ধর্ষণ প্রতিরোধে পরিবার ও সমাজের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সাইকিয়াট্রিস্টস-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যা সচিব অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দীন বলেন, এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্র যদি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে পারে, তবে ধর্ষণের হার কমবে।
মেয়েদের পাশাপাশি ছেলে শিশুদের নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোর্শেদ বলেন, শুধু মেয়েরা নয়, অনেক ছেলে শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা সামনে আসে না। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির মানসিক চিকিৎসার উপর গুরুত্বারোপ করে অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিরা সাধারণত মানসিক চিকিৎসকের কাছে আসেন না, যতদিন না তারা ধর্ষণ-পরবর্তী মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হন। তাই জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এই ধরনের আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ষণের ক্ষেত্রে সম্পর্ককে গুরুত্ব না দিয়ে অপরাধকে গুরুত্ব দেয়ার কথা উল্লেখ করে ডা. মো. রাহানুল ইসলাম বলেন, গণমাধ্যমে সম্পর্কের দিকে বেশি মনোযোগ দিলে অনেক মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারেন। ধর্ষণের পুনরাবৃত্তির মূল কারণ বিচারহীনতা উল্লেখ করে ধর্ষনের সুবিচার নিশ্চিত করার উপর গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য দেন চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. মাহাবুবা রহমান।
সংবাদ সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দীন কাউসার বিপ্লব BACAMH এর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ জানান এবং আশা প্রকাশ করেন যে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ধর্ষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে এবং ভুক্তভোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন সম্ভব হবে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও অভিজ্ঞতা স্পষ্টভাবে দেখায় যে, ধর্ষণের ঘটনা শুধু আইনগত সমস্যা নয়, এটি একটি গভীর সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সংকট। যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মানসিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।