১৮ সেপ্টেম্বরকে এখন অনেকে “প্রথম প্রেম দিবস” হিসেবে পালন করছে। যাকে বলা হয় নিউ ট্রেন্ড। আসলেই কি নতুন? হ্যাঁ, নতুন।
প্রথম প্রেম দিবস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে এবং প্রতি বছর জাতীয়ভাবে সারা দেশে পালিত হতে থাকে। এই দিনটি কে বা কেন তৈরি করেছে সে সম্পর্কে কোন বক্তব্য নেই। শুধু এটুকু জানা গেছে যে মানুষ তার প্রথম রোমান্টিক সঙ্গীকে অবশ্যই মনে রাখে, হোক মধুর কিংবা কষ্টের।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম প্রেম হয়ে থাকে বয়ঃসন্ধিকালে। আপনি যদি ভাগ্যবান হন হয়ত প্রথম ভালোবাসার মানুষকে পাশে নিয়ে আপনি চার কুড়ি বছরও পার করে দেবেন। কিন্তু সবাই তো ততোটা ভাগ্যবান নাও হতে পারে। তাই এই দিনটি আপনার জন্য হতে পারে একটি তিক্ত কিম্বা মিষ্টি দিন!
জেইমি সিটন লিখেছেন, “আমাদের মধ্যে অনেকেই আমরা প্রথম কিশোর প্রেমকে ভুলে যাই। হরমোনের প্রভাবে এ সময় তীব্র আবেগের অভিজ্ঞতাটি অপ্রতিরোধ্য এবং কিছুটা দুরন্ত হয়ে থাকে। আমি প্রথম ১৫ বছর বয়সে প্রেমে পড়েছিলাম, ১৬ বছর বয়সী একজন জনপ্রিয় হকি খেলোয়াড়ের সাথে। যিনি আমার সাথে একা থাকার সময় তার মিষ্টি, রোমান্টিক দিকটি দেখিয়েছিলেন।
যখন সে দূরে চলে যায়, সেই থেকে আমি আজো প্রায় ৪০ বছর পরে, এখনও আমার সে সময়ের গ্রাসকারী হৃদযন্ত্রকে স্পষ্টভাবে স্মরণ করতে পারি। এই অনুভূতি থেকে আমি হয়ত কখনই মুক্তি পাব না।
বয়ঃসন্ধিকালে প্রেম (১০–১৯বছর):
এই বয়সের প্রেমকে বেশিরভাগ মানুষই অল্প বয়সের ভুল, মোহ, খামখেয়ালি, পাকামো ইত্যাদি বলে মনে করে থাকেন। কঠিন মাইর দিলেই সব প্রেম ছুটে যাবে এমনটাও ভাবতে দেখা যায়। কিন্তু এ সময় জীবন বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য থাকে তা প্রেমে ব্যর্থ কিম্বা সফলতার সাথে জড়িত হয়ে যায়।
নিউ হ্যাম্পশায়ারের হ্যানোভারের শিশু এবং কিশোর মনোবিজ্ঞানী সলস্ট্রোম বলেন, “It’s all about love and belonging, and we all want that. “তিনি আরো বলেন, “ভালোবাসা বেঁচে থাকার গভীর অনুপ্রেরণা। অন্যের সাথে পারস্পারিক যোগাযোগ, বন্ধুত্ব জীবনের জন্য একটি চালিকাশক্তি।
কৈশরে প্রেম এত তীব্র কেন?
কিশোর-কিশোরীদের জন্য সম্পর্কগুলো আরও নিবিড় হয় কারণ তারা তাদের সম্পর্কে কে কী ভাবছে তা নিয়ে বেশিরভাগ সময় চিন্তিত থাকে। সবকিছুতে খুব বেশি সেনসিটিভ এবং তাদের অভিজ্ঞতা কম, চেনা জগৎ তুলনামূলক ছোট হয়।
উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি সাধারণ কিছুতেও না বলেন কিম্বা বাঁধা দেন দেখবেন তারা হয়ত খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, রুমের দরজা বন্ধ করে আর খুলছেই না। এতদিনের চেনা বাচ্চাটাকেই আপনার হয়ত অচেনা লাগবে।
অকারণে হাসি-কান্না, ক্ষণেক্ষণে পছন্দ বদল, বেষ্ট ফ্রেন্ডের সাথে অন্য কেউ কথা বললে, ভাই-বোন, কাজিনদের সাথেও অন্য কারো বেশি ভাব হলে সেটাতেও এক রকম হীনমন্যতা তৈরি হয়।
কিশোর-কিশোরীরা প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারে না। তারা নিজের কোন কিছুই শেয়ার করতে পছন্দ করে না এবং তাদের নিজের ভাল লাগার গুরুত্ব খুঁজে সব যায়গায়। যেখানে বেশি প্রশংসা পায়, গুরুত্ব পায় শুধু সেখানেই তারা একটা কম্ফোর্ট জোন বানাতে চেষ্টা করে।
নিজেকে জাহির করতে সোস্যাল মিডিয়াতে উদ্ভট কাজ কারবার করতেও ছাড়ে না। “আমি অন্য রকম, সবার থেকে আলাদা” এরকম তীব্র আবেগ তৈরি হয়। এই অতি আবেগ থেকে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আগ্রহ তৈরি হওয়া খুব স্বাভাবিক।
স্যালস্ট্রোম ব্যাখ্যা করেন যে, “কিশোর-কিশোরীদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং বাঁধা অতিক্রম করার ক্ষমতার অভাব হতে পারে। কারণ তাদের ব্রেইনের যে অংশে এক্সিকিউটিভ ফাংশন কাজ করে তা এখনও বিকাশমান”।
এসময় বন্ধু, সহপাঠী, খেলারসাথী, প্রতিবেশী, শিক্ষক/ শিক্ষিকা, সুপার স্টার, ভাই/বোনের বন্ধু, এমনকি বাবা-মার বন্ধুর প্রেমে পরাটাও অস্বাভাবিক নয়। আর এখনকার সময় বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর কিশোরীদের কাছে জনপ্রিয় টার্ম হল “ক্রাশ”।
মজার ছলে সব বন্ধু/ বান্ধুবী মিলে একজনের উপর ক্রাশ খেতেও দেখা যায় এবং এ নিয়ে পরবর্তীতে নিজেদের মাঝে বন্ধুত্বে দূরত্ব তৈরি হয়। এই প্রথম প্রেম কিন্তু শুরু হতে পারে ক্রাশ খাওয়া দিয়েই।
বাবা–মার করণীয়:
১. আপনার সন্তানের বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ড হয়েছে শুনেই সাথে সাথে চৌধুরী সাহেবের মত বন্ধুক নিয়ে দৌঁড় দেয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। মনোযোগ দিয়ে শুনুন তার কথা।
পারিবারিক থেরাপিস্ট এবং ইগনোর ইট এর লেখক ড: ক্যাথরিন পার্লম্যান পরামর্শ দেন, “বাবা-মাকে সন্তানের কথা শুনতে হবে!” তাদের অনুভূতি বুঝতে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করুন।
আপনার সন্তান তার কিশোর সঙ্গীর কি কি পছন্দ করে তা জিজ্ঞাসা করুন। সম্পর্কের লক্ষ্য এবং পারস্পারিক শারীরিক ও মানসিক আচরণ সম্পর্কে কথা বলুন।”
২. তুলনা দিয়ে কথা বলা বন্ধ করতে হবে। আমাদের সময় এই বয়সে কোনো ছেলে/মেয়েদের দিকে তাকাতাম না ইত্যাদি তুলনা না দেয়াই ভাল। সম্পর্কের গভীরতা বুঝতে চেষ্টা করুন।
উপদেশ, অবমাননা/ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন না। তার পরিবর্তে একজন পরামর্শদাতা হয়ে উঠুন এবং অনিবার্য চ্যালেঞ্জ দেখা দিলে সম্পর্কটিকে সমর্থন করুন।
৩. অনুভূতি কে সম্মান করুন। তুমি কেমন ছেলে/মেয়ে এই বয়সে এসব করছ! অনুভূতিগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে অথবা কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্কদের রোমান্টিক প্রেমের তুলনা করে তার অনুভূতিকে আঘাত করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
আপনি হয়ত ভাবছেন এটা নিছক পাগলামি কিন্তু আপনার সন্তান তার সংগীকে নিয়ে গাছ তলায়ও থাকারও প্ল্যান করে ফেলেছে!
৪. একতরফা প্রেম কিনা বুজতে চেষ্টা করুন। আপনার সন্তান হয়ত অপর পক্ষের সারা না পেয়েও নিজে নিজেই বেশ সিরিয়াস। এক্ষেত্রে আঘাত সামলানোর জন্য সে কতটুকু তৈরি বুঝতে চেষ্টা করুন।
৫. সন্তানকে প্রতিপক্ষ বানাবেন না। আপনি হয়ত বললেন, এই প্রেম কয়দিন টেকে আপনি দেখবেন কিংবা বাসা থেকে পকেট খরচ দেবেন না, খাওয়া পড়া বন্ধ! তাতে দ্বন্দ্ব বাড়বে ছাড়া কমবে না।
আপনার কিশোরকে প্রথম প্রেমের সমাপ্তি সম্পর্কে সতর্ক করা আপনার কাছে এই মুহুর্তে জরুরী মনে হতে পারে কিন্তু পার্লম্যান বলছেন এর কোন প্রয়োজন নেই। তিনি বুঝিয়েছেন, শিশুরা বিভিন্ন উপায়ে ভালবাসতে শেখে, পরিবার, বন্ধু, প্রেমিক/প্রেমিকা সব রকমের আলাদা অনুভূতি শেখে আর এভাবেই তারা মুভ অন করতেও শেখে।
তিনি আরো বলেন, “একজনের জীবনে প্রথম প্রেমের সম্পর্ক খুব বিশুদ্ধ এবং বিশেষ কিছু। এটি স্থায়ী নাও হতে পারে, তবে স্মৃতিগুলো জাদুকরী হতে পারে। কোন কিশোর/কিশোরী শুনতে চায় না যে, এই তরুণ প্রেমের সম্পর্ক স্থায়ী হবে না এবং প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমের তুলনায় এটি কিছুই নয়।
বাবা-মা হিসেবে তাদের বুঝতে চেষ্টা করুন যে তারা অন্যদের কাছ থেকে যে সময় এবং প্রশংসা চায় তা পরিবার থেকে পাচ্ছে কিনা। যদি না পায় তবে তা অনিবার্যভাবে হতাশাজনক এবং অসন্তোষজনক হতে পারে। আর তার পরিণাম আপনার সন্তানের ব্যক্তিত্ব, আত্মবিশ্বাস, ক্যারিয়ার তথা ভবিষ্যৎ জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পরতে পারে।
কে জানে মনের কোনে আজকের দিনে আপনিও হয়ত গাইছেন…
প্রথম প্রেমের মত
প্রথম কবিতা এসে বলে
হাত ধরে নিয়ে চলো
অনেক দূরের দেশে…..
ফারজানা ফাতেমা রুমি
মনোবিদ
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে