ডা. দেবদুলাল রায়
রেসিডেন্ট, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যৌবনে লিখেছিলো ‘’ মরন রে তুঁই মম শ্যাম সমান’’। অর্থাৎ তিনি উক্ত পংক্তির মাধ্যমে মৃত্যুকে শ্যামের সাথে তুলনা করেছেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে, শ্যাম দেবতা শ্রীকৃষ্ণের অপর নাম। দেবতার দর্শন পাওয়া অত্যান্ত কাঙ্খিত ও সৌভাগ্যার প্রতীক। অর্থাৎ উক্ত পংক্তির মাধ্যমে তিনি মৃত্যুকে পরম কাঙ্ক্ষিত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যে মৃত্যু প্রতিটি মানুষের শেষ পরিনতি, সেই মৃত্যুকে বিষাদের ছায়ারুপে না দেখে কবি দেখেছেন সৌভাগ্যর প্রতীক হিসেবে।
সম্ভবত পৃথিবীতে নিত্য নতুন চলতে থাকা ক্ষুধা, চাহিদার সংগ্রাম, হিংসা বিদ্বেষ আর স্বার্থের হানাহানি, পাওয়া না পাওয়ার দৈরথ, ঘাত-প্রতিঘাত সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে অনন্তের পথে যাত্রাকেই কবি সেই বয়সে সমীচিন মনে করেছেন। আবার একই বার্ধক্য এসে তাঁর ‘’প্রাণ’’ কবিতায় লিখেছেন ‘’ মরিতে চাইনা আমি সুন্দর ভুবনে , মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই’’। জীবনের সম্পূর্ণ পরিক্রমা শেষে জীবনের এক পর্যায়ে কবি উপলব্ধি করেছেন , মৃত্যু নয় জীবন-ই কাঙ্খিত।
জীবনে থাকবে ঘাত-প্রতিঘাত, মুখরিত সংগ্রাম, কখনও প্রাপ্তি হৃদয়কে কানায় কানায় পূর্ন করবে আবার কখনও অপ্রাপ্তি হৃদয়কে ম্লান করবে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মানুষের মাঝে , মানুষ পরিবেষ্ঠিত হয় । মানুষের সাথে মিলেমিশে বেঁচে থাকার মধ্যই কবি মানব জীবনের স্বার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন। তাই জীবনর শেষ পর্যায় এসে তাঁর উপলব্ধি মৃত্যু নয় বরং জীবন-ই কাঙ্খিত।
পৃথিবীর আপামর মানুষ, যারা কাব্যরসে শিক্ত নয়, যাদের কাছে জীবন মানেই সংগ্রাম , যাদের জীবনের হিসাবের খাতায় প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তিই বেশি, তৃপ্তির চেয়ে অনুশোচনা বেশী, স্বপ্ন পূরনের আনন্দের চেয়ে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বেশী তাঁদের কাছেও মৃত্যু নয়, বরং জীবন-ই কাঙ্খিত। সকল অপ্রাপ্তি- অনুশোচনা ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনাকে ছাপিয়ে যায় বেঁচে থাকার আনন্দ।
এই আনন্দের স্বাদ পেতে প্রতিটা ভোরে নতুন করে উদ্যমে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দিনশেষে হয়তো রিক্ততার হৃদয় বিদীর্ন হয়। কিন্তু পরেরদিন আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে, চোখে নতুন স্বপ্ন নিয়ে । তাই মৃত্যু অমোঘ পরিণতি হলেও মরতে আসলে কেও চায়না, একই সাথে চায়না প্রিয়জনের মৃত্যুও । প্রতিটি মানুষ প্রাণপণে বেঁচে থাকতে চায় নিজের প্রিয়জনদের আঁকড়ে ধরে।
কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের কাছে মানুষের চাওয়া না চাওয়া কী বা গুরুত্ব । তাই বেঁচে থাকার দুর্নিবার আকাঙ্খা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে মৃত্যু আসে নিজস্ব নিয়মে, ধীরলয়ে। কেড়ে নিয়ে যায় আমাদের একান্ত আপনজনদের । যাদের ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব বলে মনে হয়, সেই মানুষগুলোর মৃত্যুর করাল গ্রাসে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে। সেই সব মানুষদের হারিয়েও আমাদের বেঁচে থাকতে হয় জীবনের নিয়মে।
মৃত্যু শোকের পাশাপাশি সৃষ্টি করে অসীম শূন্যতা। এই পূর্ন্যতা অপূরনীয় হয়ে ওঠে যদি পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিটি মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের দেশের অধিকাংশ পরিবারের ভরন পোষণ তথা যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব একজন মানুষের উপর অর্পিত থাকে। তিনি সকাল সন্ধ্যা পরিশ্রম করে পরিবারের সকল সদস্যাদের গ্রাসাদাচ্ছনের ব্যবস্থা সহ অন্যান্য চাহিদা নিবৃত্ত করে থাকেন। এক্ষেত্রে ব্যক্তির কর্ম ও আয়ের উপর পরিবারের অন্যান্য সদস্যাদের জীবনমান ও ভবিষ্যৎ সরাসরি সম্পৃক্ত । তাই কোনো কারনে উক্ত ব্যক্তিটি মৃত্যুমুখে পতিত হলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যাদের জীবনকে গ্রাস করে নেয় দুর্ভেদ্য অমানিশা। মুহুর্তেই জীবনে ঘটে যায় অনাকাঙ্খিত ছন্দপতন।
ছোট হোক, বড় হোক প্রতিটি পরিবারের থাকে স্বাতন্ত্র্য , থাকে চলার নিজস্ব ছন্দময়তা আর স্বাতন্ত্র্যবোধই পরিবারের সদস্যাদের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। কিন্তু পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিটির মৃত্যুতে এই ছন্দময় আকস্মিক পতন ঘটে , থাবা পড়ে স্বাতন্ত্রবোধেও । হঠাৎ ধেয়ে আসা অভাব পূরন করতে পরিবারের অন্যান্য সদস্যাদের আয়ের পথ খুজতে হয়। কখনও কখনও দেখা যায় পরিবারের অন্যান্য সদস্যারা আয় করার উপযুক্ত বয়সে পৌঁছায়নি। কিন্তু তবুও ক্ষুধা-তৃষ্ণার চাহিদাতো থেমে থাকেনা।
থেমে থাকেনা বস্ত্র, বাসস্থান কিঙ্গবা অসুখ বিসুখের খরচও, অর্থাভাবে অনেকেই কর্মসংস্থান বদলায় , নতুন জামা কাপড় কেনা বন্ধ করে ব্যয়সংকচনের চেষ্টা চালায়। পাতে উঠেনা প্রিয় খাবার। এত এত বিসর্জনের পরেও জীবন চালাতে লাগে টাকা। কর্মক্ষম ব্যক্তিটির মৃত্যুতে নিয়মিত সেই টাকার যোগানটাই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার অনেকটা দিশেহারা অবস্থান সৃষ্টি হয়। তখন উপযুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও পরিবারের জ্যৈষ্ঠ সদস্যারা প্রাণপনে উপার্জনের প্রচেষ্টায় নেমে পড়ে। অকস্মাৎ নেমে পড়ায় এবং উপযুক্ততা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই সম্মানজনক কাজ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না।
কিন্তু নিদারুল অভাব আর প্রয়োজনীয়তার অতিশয্য যা পাওয়া যায় তাতেই নিযুক্ত হতে হয়। কখনো কখনো তা আত্মমর্যাদায় আধাত হানলেও, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আত্মমর্যাদার সাথে আপোষ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকেনা। আর আপোষ করা না গেলে সইতে হয় পরিবারের অন্য সদস্যাদের অভুক্ত থাকার উদ্বেগ , বাস্তুচ্যুত হবার চোখ রাঙ্গানি, অপরিপক্ক বয়সে এমন ভীষণ সঙ্গগ্রামের মুখমুখি হয়ে এবং ক্রমাগত নিজের স্বাতন্ত্র্য আর আত্মমর্যাদাবোধের সাথে আপোষ করতে করতে ভেতরের কুসুম কোমল স্বত্তাটি ঝাজড়া হয়ে যায়।
এদের মধ্যে কেও কেও কঠিন মনের যোদ্ধা হয়ে উঠেন, আবার কেউ কেউ হতাশাগ্রস্থও হয়ে পড়েন । ক্রমাগত চাহিদার সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে কেউ কেউ বেছে নেন অন্ধকার পথ। যে ফুলগুলো বাগানে সযত্নে ফোটার কথা ছিলো, সেগুলোর কিছু কিছু ফোটে বড্ড অনাদরে। আবার কিছু কিছু ফুল না ফুটেই ঝড়ে যায়।
- এপোয়েন্টমেন্ট নিতে যোগাযোগ করুন-Prof. Dr. Shalahuddin Qusar Biplob
- চেম্বার – MK4C -মনের খবর ফর কেয়ার
মগবাজার রেইল গেইট।
নাভানা বারেক কারমেলা, লিফটের ৩,
(ইনসাফ কারাকাহ হাসপাতালের বিপরীতে)।
চেম্বার সিরিয়াল – ০১৮৫৮৭২৭০৩০ - আরো পড়ুন- MK4C-তে কীভাবে টেলিসাইকিয়াট্রি চিকিৎসা নেবেন?