কর্তারা কি রাখেন কর্মীদের মনের খোঁজ?

0
9
কর্তারা কি রাখেন কর্মীদের মনের খোঁজ?

মীর সানজিদা আলম
গণমাধ্যম কর্মী

শরীরের প্রতি আমরা যতটা যত্নশীল, মনের প্রতি ততটা নই। শরীর ভালো না থাকলে আমাদের মন তো ভালো থাকেই না, উপরন্তু আমরা স্থবির হয়ে পড়ি। কিন্তু মন ভালো না থাকলে আমাদের শরীরও যে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে সে বিষয়টি কিন্তু আমরা মানতে নারাজ। আর তাই বাড়িতেই হোক কিংবা কর্মক্ষেত্র মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আমরা এড়িয়ে যাই।

আমাদের দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একটা ছেলে কিংবা মেয়ে হন্যে হয়ে চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে ছোটে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সেই চাকরি নামক সোনার হরিণের দেখা হয়তো সে পায় কিন্তু তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মন ভরে না। তার অন্যতম কারণ সে তার যোগ্যতা অনুযায়ী হয়তো কাজ বা বেতন পায় না।

বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সে হয়তো চাকরি করে কিন্তু তাতে তার জীবন চলে না। ফলে দেখা দেয় হতাশা। আর বেসরকারি চাকরিতে তো আরেক ঝক্কি, সেখানে তো অভিজ্ঞতার সনদ না থাকলে যে বেতনের চাকরি মেলে তা হয়তো সরকারি বা কোনো ভালো প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন থেকেও কম। আর এ ধরনের অবস্থা থেকে জন্ম নেয় হীনম্মন্যতা, বিষণ্ণতা আর হতাশা। আর হতাশার খবর রাখেন না অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরাই।

এ তো গেল কম বেতনের কথা। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা বেতন দেবে কিন্তু সে ক্ষেত্রে অবশ্য খাটিয়ে নেবে ষোল দু’গুণা বত্রিশ আনা। আইএলও কনভেনশন ও শ্রম আইনের ধারে-কাছ দিয়ে যায় না তারা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো ওভারটাইমও দেয় না।

অথচ বাংলাদেশের শ্রম আইনে নির্ধারিত কর্মঘণ্টার বাইরে অতিরিক্ত কাজের জন্য সাধারণ মজুরির দিগুণ মজুরি দেওয়ার বিধান রয়েছে। প্রতিষ্ঠান মনে করে যত বেশি সময় কর্মীদের অফিসে রাখা যাবে ততই তাদের ফায়দা। কিন্তু আদতে কি তাই? কর্মীদের ওপর অহেতুক চাপিয়ে দেওয়া কাজের বোঝা থেকে রক্ষা পেতে কর্মীদের মধ্যে তাই অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে না যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়, এটা-সেটা বলে তারা তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন।

আবার অনেক সময় চাকরি বাঁচাতে কর্মক্ষেত্রে থাকলেও মনোযোগ দিয়ে হয়তো কাজ করতে পারেন না। এতে আদতে দু’পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কর্মী তার কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে, বিষণ্ণ হয়ে পড়ছে আর প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত পরিশ্রম ও মানসিক চাপে তার সামাজিক ও পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। আর এহেন অবস্থায় অনেক সময় কর্মীটি হয়তো তার চাকরিও হারিয়ে বসছেন। কিন্তু কর্মী ছাঁটাইয়ের আগে প্রতিষ্ঠানটি একবারও কি ভেবে দেখেছে তার কর্মীর এহেন মানসিক অবস্থার জন্য দায়ী কে?

আমরা এমন একটি প্রতিযোগিতার সময়ে বাস করছি, যেখানে সব সময়ই ব্যস্ত থাকতে হয় নিজে টিকে থাকা এবং নিজের যোগ্যতার প্রমাণ নিয়ে। এ বিষয়টি অনেক সহজ হয় যখন সহকর্মী ও কর্তাব্যক্তিরা বন্ধুভাবাপন্ন আমরা এমন একটি প্রতিযোগিতার সময়ে বাস করছি, যেখানে সব সময়ই ব্যস্ত থাকতে হয় নিজে টিকে থাকা এবং নিজের যোগ্যতার প্রমাণ নিয়ে। এ বিষয়টি অনেক সহজ হয় যখন সহকর্মী ও কর্তাব্যক্তিরা বন্ধুভাবাপন্ন হন।

কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে দুটি পক্ষ হয়ে যায় ঠিক সরকারি আর বিরোধী দলের মতো। তবে এখানে বিরোধী দল প্রকাশ্যে সরকারি দলের বিরোধিতা করতে পারে না। বিষয়টি পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক। রাজনৈতিক দলের মতো এখানেও বিরোধী দলকে কোণঠাসা হয়ে থাকতে হয়। এ অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আপাতদৃষ্টিতে বিরোধী দলকে নানাভাবে পিছিয়ে রাখা হয়। আর এর ফলে পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিটির মনে নিজের সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হতে থাকে, যার ফলে তার সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়। কর্তার সঙ্গে কর্মীর সম্পর্ক খারাপ হয়। আর এ ধরনের পরিস্থিতিতে তার মনে উদ্বিগ্নতা আর হতাশার জন্ম হয়।

আমাদের দেশে শ্রমিকদের দিয়ে ষোলআনা কাজ করিয়ে নেওয়ার প্রবণতা থাকলেও তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিতে অধিকাংশ কারখানা কর্তৃপক্ষই কোনো নজর দেন না। ফলে ভবন ধস কিংবা কারখানায় আগুন লেগে শতাধিক শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। কিন্তু এসব ঘটনায় যারা বেঁচে ফেরেন, তারাও ভোগেন নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক বিকলাঙ্গতায়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ রানা প্লাজা ধসের ঘটনা। এ ঘটনায় ১১শ’রও বেশি শ্রমিক নিহত হন। আর আহত হন দুই হাজারেরও বেশি শ্রমিক।

আহত এই শ্রমিকরা এখনো ভয়ে শিউরে ওঠেন সেই ভয়াবহতার কথা মনে করে। শারীরিক বিকলাঙ্গতার সঙ্গে সঙ্গে তারা মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত। এসব ঘটনার দায় কি নেয় সেসব প্রতিষ্ঠান, কিংবা এসব বিপর্যস্ত মানুষকে কি ফিরিয়ে দিতে পারে স্বাভাবিক জীবন? শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ একজন মানুষ যেমন তার পরিবারের আশা-ভরসায় জায়গা, তেমনি তিনি দেশেরও সম্পদ।

কিংবা অন্যভাবে বলতে গেলে তিনি আসলে যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সেই প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ। আর একজন সাধারণ মানুষকে সম্পদে পরিণত করতে চাই কাজের সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ। যে পরিবেশ তাকে চাপে ফেলে নয়, বরং নিজের তাগিদে আরো বেশি কাজ করার উৎসাহ জোগাবে। নিজের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানকেও লাভবান ও সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রেরণা জোগাবে।

Previous articleসাইকিয়াট্রি বিভাগের নভেম্বর মাসের বৈকালিক আউটডোর সূচি
Next articleসব সময় মন খারাপ থাকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here