করোনা মহামারী’তে মন ভাল রাখতে সহায়ক পরামর্শ

এবার কি মনোরোগের মহামারী? সে রকমই ভাবছেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু)৷ করোনা মহামারীর হাত ধরে যে হারে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, একাকীত্ব, অবসাদ বাড়ছে, তা রীতিমতো ভয় জাগিয়েছে তাঁদের মনে৷

গৃহবন্দী অবস্থায় আতঙ্কের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে মনের সব প্রতিরোধ ভেঙে গেলে, বিশেষ করে যাঁরা এমনিই উদ্বেগপ্রবণ বা অন্য মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, কী হবে তাঁদের অবস্থা! এত মনোরোগীর চাপ সামলানো যাবে! এই আশঙ্কা করেছেন ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের বিজ্ঞানীরা৷ ইমারজিং ইনফেকসাশ ডিজিজ নামের জার্নালে তাঁরা জানিয়েছেন, যদিও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনের জোরে এই বিপদ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন,বাকিরা পারছেন না৷ অবিলম্বে এ দিকে নজর না দিলে বিপদ ঘটতে পারে৷

এই সময়ে মন ভালো রাখতে বিশেষজ্ঞরা যেসব পরামর্শ মেনে চলতে বলছেন:

১. দিনে একঘণ্টার বেশি খবর দেখবেন না যদি মনে তা প্রভাব ফেলে৷ আগে যেভাবে কাজকর্ম করে, বই পড়ে বা সিনেমা-সিরিয়াল দেখে সময় কাটাতেন, এখনও সেভাবে কাটানোর চেষ্টা করুন৷

২. কীভাবে সময় কাটাবেন বুঝতে না পারলে হিসেব করে দেখুন, ক-ঘণ্টা বেশি সময় পাচ্ছেন৷ এই সময়টা কীভাবে ভরাট করা যায় দেখুন৷ একটু হয়তো ব্যায়াম করলেন, ঘরের কাজ করলেন, বই পড়লেন কি সেরে নিলেন বকেয়া কাজ৷

৩. নতুন শখ তৈরি করা বা সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার এটাই আদর্শ সময়৷ আদর্শ সময় সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দেওয়ার৷ পুরোনো সম্পর্কগুলো ঝালিয়ে নিন৷ যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছিল, উদ্যোগ নিয়ে তাকে ভাল করা যায় কিনা দেখুন৷ ভালকে করে তুলুন আরও ভাল৷ সময় কেটে যাবে৷

৪. ভবিষ্যত ভেবে আতঙ্কিত হয়ে লাভ নেই৷ সারা পৃথিবীর ভবিষ্যতই এখন অনিশ্চিত৷ যতই ভাবুন কূলকিনারা পাবেন না৷ কাজেই আজকের দিনটা কতটা সুন্দর, কতটা কার্যকর করে তোলা যায়, ভাবুন তা নিয়ে৷ কালকের কথা কাল ভাববেন৷

৫. এভাবে তখনই ভাবতে পারবেন, যখন জীবনের ভাল দিকগুলি দেখার চোখ ও মন তৈরি করতে পারবেন৷ চাহিদা কমাতে পারবেন৷ আকাশচুম্বী চাহিদা মুহূর্তে ধূলিস্যাৎ করেছে করোনা। এখন কী হবে না হবে সেই নিয়ন্ত্রণও প্রকৃতিরই হাতে ৷

৬. আসল কথা হল, এই মুহূর্তটুকু ছাড়া আর কিছুই আমাদের হাতে নেই৷ কাজেই যা হাতে আছে, তাকে সুন্দর করে গড়ে নিতে হবে৷ যা নেই তার জন্য হা-হুতাশ করা বন্ধ করতে হবে।

৭. দুশ্চিন্তার আগে ভেবে দেখুন, এ রকম অতিমারি আগেও এসেছে৷ মানুষ তা অতিক্রমও করেছে৷ এই মহামারিও সেভাবে অতিক্রান্ত হয়ে যাবে৷ এখন বরং চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক বেশি উন্নত ৷ জীবাণুটিও যতটা ছোঁয়াচে, ততটা মারক নয় ৷ কাজেই এই হঠাৎ পাওয়া ছুটি ভাল করে উপভোগ করতে হবে৷

৮. সব কিছু করেও যদি মনে হয় সামলাতে পারছেন না, মনোবিদের পরামর্শ নিতে হবে৷ চিকিৎসকের সাহায্যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন করে বাঁচতে শিখে যাবেন আপনি৷ সামান্য কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ওষুধ দিতে হতে পারে৷

আগলে রাখুন বয়স্কদের

বয়স্কদের কোভিডের আশঙ্কা বেশি, সুগার-প্রেশার-হৃদরোগ ইত্যাদি থাকলে আরও বেশি, এ সব আমরা যেমন জানি, তাঁরাও জানেন৷ শুনছেন প্রতিনিয়ত। ফলে বাড়ছে দুশ্চিন্তা৷ রোগ হলে কোথায় যাবেন, কী করবেন, কাকে ডাকবেন? এ এমন রোগ, কাউকে তো পাশে পাওয়া যাবে না! অ্যাম্বুলেন্স ডাকলে কি আসবে? বাড়ির লোকেদেরও তো বিপদ। ছেলে-মেয়ে বিদেশে, ঘরে স্রেফ বয়স্ক দুটি মানুষ, একজন রোগে পড়লে অন্যজনকে কে দেখবে?

রোগী নিয়ে ছুটোছুটিই বা করবে কে? একা থাকলে তো হয়েই গেল৷ বাজার করতে, পেনশন তুলতে কি ওষুধ কিনতে বাইরে যাওয়া ছাড়া গতি নেই, তখন যদি সংক্রমণ হয়! তারপর একা হাতে ঘরের যাবতীয় কাজ।

এমনিতেই বয়স্ক মানুষের মধ্যে শতকরা ২০ জন অবসাদে ভোগেন৷ একাকীত্ব, উদ্বেগ, অসহায়তা মিলেমিশে থাকে তাঁদের মধ্যে৷ কোভিডের আতঙ্কে ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তা এক ধাক্কায় বেড়ে গেছে৷ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গার্হস্থ্য হিংসা৷ বাড়ির লোকেদেরও তো মাথার ঠিক নেই৷ টেনশন ও অসহায়তার শিকার তাঁরাও৷ ফলে সামান্য ঠোকাঠুকিতেই বড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে৷ মানসিক ও শারীরিকভাবে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন বয়স্করা৷

সমাধান

পরিস্থিতির গুরুত্ব যাঁরা বুঝছেন, তাঁদের দুশ্চিন্তা হবেই৷ অর্থবল, লোকবল না থাকলে আরও হবে৷ তার উপর যদি দিন-রাত কানের কাছে  ঝুঁকি বেশি বলা হতে থাকে, উদ্বেগপ্রবণ মানুষের পক্ষে সে চাপ নেওয়া খুব কঠিন, যদি না তিনি নিজে ও তাঁর আপনজনেরা বিশেষ সতর্ক থাকেন৷

এ ক্ষেত্রে যা বোঝাতে হবে

১. প্রথমেই বুঝে নিতে হবে যে ঝুঁকি বেশি থাকলেও এই মুহূর্তে সাবধানে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই৷ বয়সটাকে নিয়ে তো আর কিছু করা যাবে না, অন্য আর যা যা রোগভোগ আছে, তাদের সামলে রাখতে হবে৷

২. ওষুধপত্র খেতে হবে নিয়ম করে৷ ওষুধের জোগান যেন ঠিক থাকে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ ঠিক সময়ে ঠিকঠাক খাবার খেতে হবে৷ শরীর ঠিক থাকলে, মনও হালকা থাকবে৷

৩. ঘুম ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ এক-আধদিন না হলে বা কম হলে সমস্যা নেই৷ কিন্তু দিনের পর দিন না হলে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে৷ কারণ ভাল ঘুম হল দুশ্চিন্তার অব্যর্থ দাওয়াই৷

৪. নতুন করে যাতে চিন্তা না বাড়ে, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ চারদিকে তো এখন কোভিড ছাড়া কথা নেই৷ কিন্তু যাঁরা উদ্বেগ সহ্য করতে পারেন না, তাঁদের জন্য এ রকম পরিস্থিতি মারাত্মক৷ কাজেই ঘরে এ সব আলোচনা করবেন না৷ তবে বয়স্ক মানুষের মনে কোনও প্রশ্ন জাগলে তিনি যাতে উত্তর পান সে দিকে খেয়াল রাখুন৷ একেবারে কিছু না জানালেও কিন্তু দুশ্চিন্তা বাড়ে৷ কাজেই ভারসাম্য মেনে চলুন৷

৫. হাত ধোওয়া, একটু দূরে দূরে থাকা ও বাইরে বেরোলে মাস্ক পরার যে নিয়ম আছে, তা মেনে চলুন সবাই৷ বয়স্ক মানুষটিকে বোঝান যে এ সব মানলেই বিপদ কমবে৷

৬. সকাল-সন্ধ্যা ছাদে একটু হাঁটাহাটি, হালকা দু-একটা স্ট্রেচিং বা যোগাসন করতে পারলে ভাল৷ কখন কী করা যেতে পারে তার একটা রুটিন করে নিতে হবে৷ ভাল লাগুক না লাগুক যখন যা করার কথা তা মোটামুটি মেনে চলতে হবে৷ নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে চিন্তা কম হবে৷

৭. অসুখ হলে কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে, সে সব খবরও একটু নিয়ে রাখবেন, যদি দরকার হয়, তখন যাতে হাতড়ে বেড়াতে না হয়৷

৮. যাঁরা সারাজীবন সব নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন, তাঁদের পক্ষে এই অসহায়তা মেনে নেওয়া কঠিন৷ তাঁদের বোঝাতে হবে যে পৃথিবীর তাবড় তাবড় মানুষও তাঁর মতো অবস্থায় আছেন এখন৷ জীবাণুর মেজাজ-মর্জি বুঝতে পারছেন না কেউই৷

৯. যাঁদের ঈশ্বর বিশ্বাস আছে, তাঁরা পুজো অর্চনা করতে পারেন৷ কারণ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিরূপ পরিস্থিতিতে বিশ্বাসী মানুষদের কিছু ক্ষেত্রে উদ্বেগ-অবসাদ কম হয়।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন

 

Previous articleমানুষের আবেগানুভূতির সাথে পরিপাকতন্ত্রের কোনও সর্ম্পক আছে?
Next articleপরিবারের কোন সদস্য করোনা আক্রান্ত হলে অন্যরা যা করবেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here