করোনায় আক্রান্তদের একটি বড় অংশ সেরে ওঠার পরও বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছে, সম্প্রতি ল্যানসেট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলিতে সংবাদ প্রকাশের পর অনেকেই বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছেন।
তবে বিষয়টি যে ল্যানসেটে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনর পরই সামনে এসেছে তা নয়। গতবছরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বলা হয়েছে যে, করোনার পর যে মহামারী হবে সেটা মানসিক স্বাস্থ্যের মহামারী।
প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট যেকোনো ধরনের দুর্যোগের পরই মানুষের মধ্যে মানসিক বিপর্যয় দেখা দেয়। মানুষ পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) তথা দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগে থাকেন।
দুর্য়োগের চলাকালীন বিষণ্ণতা, উদ্বেগ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যায় দেখা দেয়।
করোনায় অনেকে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। যারা পরিবারের দায়িত্ব পালন করেন তাদের অবস্থা অনেকটা দিশেহারা। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত, লম্বা সময় ঘরে থাকতে হচ্ছে। এসব থেকে মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া যে পরিবারের কোনো সদস্য করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন, সেই পরিবারের অন্য সদস্যদের মানসিক অবস্থাও সহজে অনুমেয়।
অনেকে আবার করোনো থেকে মুক্ত হওয়ার পর ফুসফুস কিংবা কিডনীর দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ভুগছেন। এটার কারণেও তাদের মধ্যে সবসময় একধরণের মানসিক চাপ এবং আতঙ্ক কাজ করছে। করোনা মুক্ত হবার পরও তার মধ্যে মৃত্যুভয় কাজ করতে থাকে, দুঃস্বপ্নের মাত্রা বাড়ছে, ডিপ্রেশন বাড়ছে। অর্থাৎ করোনা থেকে সুস্থ হয়ে কেউ কেউ যেমন শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হয়েছেন বলা যাচ্ছে না, তেমনি করোনা থেকে সুস্থ হলেই মানসিকভাবে সুস্থ হয়েছেন বলা যাচ্ছে না। করোনা থেকে মুক্ত হবার পর বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সাথে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার এর ঝুঁকি আছেই। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার এমন একটি সমস্যা যেটি দীর্ঘদিন পরেও দেখা দিতে পারে। এটা একেবারে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত একটি বিষয়।
তবে এখন যেটি আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে সেটি হল-করোনা প্রেক্ষিতে সৃষ্ট মানসিক জটিলতা আমাদের দেশে কতটা ভয়াবহ হবে। কারণ আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সীমিত, আমাদের জনবল কম, আমাদের হাসপাতাল গুলিতে ফ্যাসিলিটিজ কম। সবচেয়ে বড় কথা হল-আমাদের ভেতর মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা নেই। তার সাথে রয়েছে কুসংস্কার এবং অজ্ঞতা।
মানসিক বিপর্যয়ের এই ভয়বহতা এড়াতে আমাদের দেশে করোনা আক্রান্তদের জন্য এখন থেকেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দিতে হবে। নাহলে আমাদের অপ্রস্তুতি এবং অপর্যাপ্ত ব্যবস্থার কারণে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।
যদিও অনেক আগেই করা উচিত ছিল কিন্তু আমরা অল্প কিছু প্রশিক্ষণ ছাড়া করতে পারিনি। তাই এই করোনা ইস্যুতে হলেও আমাদের দেশের জেলা উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত মৌলিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনা গেলে করোনা পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য মহামারী পরিস্থিতি মোকাবিলা কিছুটা সহজতর হবে। আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীকে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার গুরুত্ব জানানোটা এখন অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই করোনা আক্রান্তদের যে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে সেটি তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে জানাতে হবে। তাদেরকে নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীর পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
সর্বোপরি, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বাড়ানোটা এখন সবেচেয়ে জরুরি। আর এক্ষেত্রে এখন মিডিয়াই পারে কাজটাকে সহজ করতে। আমাদের দেশের গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়কে তথ্য এবং করণীয় সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট (বিএপি) এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী এর বক্তব্যটি শ্রুতিলিখন করেছেন মনের খবর প্রতিবেদক মো. মারুফ খলিফা।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে