করোনাকালে জাহাজে থাকা মানুষদের অবস্থা জানালেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার শামসুল আনোয়ার মো. সোহেল

[int-intro] করোনার মহামারীতে বিপর্যস্ত বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের জীবন। শুধু স্থল নয়; জলেও জাল ফেলেছে ভয়াল করোনা। জলের সাথে যাদের জীবন যাপন, সেই সকল মেরিন ইঞ্জিনিয়ারগণ কেমন আছেন তা জানতে কথা হয় সিনিয়র মেরিন ইঞ্জিনিয়ার শামসুল আনোয়ার মো. সোহেল এর সাথে। যিনি বর্তমানে চীফ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে সিঙ্গাপুরের নিপ্পন ইউসেন কাইসা শিপ ম্যানেজমেন্টে কর্মরত। দুর্যোগকালীন সময়ে এই পেশায় কর্মরতদের কাজের অবস্থা, মানসিক অবস্থা এবং কতটা কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে সেসব বিষয়ে তার সাথে কথা বলেছেন মনের খবর প্রতিবেদক সৈয়দা মুমতাহিনাাহ্ সোনিয়া[/int-intro]

[int-qs]করোনার এই পরিস্থিতিতে আপনাদের পেশা বা কাজের অবস্থা সম্পর্কে যদি আমাদের জানাতেন?[/int-qs] [int-ans name=” শামসুল আনোয়ার মো. সোহেল”]এই পেশায় জড়িত আমরা সবাই স্মরণাতীত কালের মধ্যে সবচাইতে অনিশ্চয়তা ও হতাশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা যখন সাগরে থাকি কখনও কখনও সর্বোচ্চ ত্রিশ দিন একটানা থাকার পর কোন পোর্টে বা বন্দরে জাহাজ থামাই, এমনিতে আমরা ৭/১০ দিন পর পর পোর্টে থামিয়ে বের হই।  কিন্তু বর্তমানে করোনার কারণে এসব কিছুই হচ্ছে না, একেবারেই বন্ধ। কয়েকমাস ধরে সাগরে থাকা জাহাজ কবে পোর্টে যাবে সেটার এখন ধারণাই নাই। যে নির্দিষ্ট সময়টা নির্ধারণ করা হয় এখন সে সময়ে বা সে তারিখেই জাহাজ শুধু বন্দরে যাবে। আগে কোন জরুরি কিছু হলেই কোন বন্দরে নেমে বাড়ি যাওয়া যেত, এখন কেউ মারা গেলেও সে সুযোগ হচ্ছে না।[/int-ans]

[int-qs]করোনার এই সময়ে আপনার নিজের অবস্থা সম্পর্কে যদি বলতেন?[/int-qs] [int-ans name=” শামসুল আনোয়ার মো. সোহেল”]মার্চের ২৮ তারিখে সিঙ্গাপুরে আমার কাজে যোগ দেবার কথা ছিলো। ১৮ই মার্চ থেকে লকডাউনের কারণে আমার এয়ার টিকেট এবং ভিসা বাতিল হয়ে যায়। জুনের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত বিমানের টিকেট না পাওয়া এবং বিভিন্ন দেশের নতুন নতুন বিধিনিষেধ আরোপের কারণে অনেক চেষ্টার পরেও আমি কাজে যোগ দিতে পারিনি। এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং আর্থিক সংকটে অত্যন্ত দুশ্চিন্তার জীবন যাপন করছি। আমার মত সিনিয়র মেরিনারের যখন এই অবস্থা, হাজার কয়েক জুনিয়র কর্মকর্তা ও রেটিঙদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।[/int-ans]

[int-qs]করোনার ফলে আপনারা যারা মেরিন ইন্জিনিয়ার তাদের জীবনে কি ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে বলে মনে করেন?[/int-qs] [int-ans name=” শামসুল আনোয়ার মো. সোহেল”]আমাদের সাধারণত সিনিয়র অফিসারদের ৪/৫ মাস, জুনিয়র অফিসারদের ৬/৭ মাস এবং ক্রুদের ৬ থেকে ৯ মাস জাহাজে থাকতে হয়। এর মধ্যে বড় একটা সময়ই আমাদের খোলা সাগরে থাকতে হয়। সাধারণত কোন বন্দরে পৌছালে কাজের অবসরে আমরা শহরে গিয়ে কোন দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যেতাম, পরিবারের জন্য শপিং করতাম, কখনো বাইরে খেতে যেতাম। করোনা ছড়িয়ে পড়াতে গত ফেব্রুয়ারী থেকে কোন নাবিক একদিন বা এক মূহুর্তের জন্য জাহাজ থেকে বন্দরে নামতে পারেন নাই, ফলে কার্যত সমুদ্রগামী জাহাজে কর্মরত নাবিকরা একরকম কয়েদীদের মত বন্দী জীবন যাপন করছেন। এর বাইরে সারা বিশ্বব্যাপী বিমান চলাচলের সীমাবদ্ধতার কারণে নির্ধারিত কন্ট্রাক্ট বা চুক্তির পর নাবিকরা বাড়ি ফিরতে পারছেন না (কেউ কেউ নির্ধারিত চুক্তির দ্বিগুণেরও বেশি সময় ধরে আটকা পড়ে আছেন) যা তাদের মধ্যে প্রচন্ড ক্লান্তি ও মানিসিক অবসাদের জন্ম দিয়েছে।

[int-qs]এই পরিস্থিতিতে তাদের উপর কি ধরনের প্রভাব ফেলছে?[/int-qs] [int-ans name=” শামসুল আনোয়ার মো. সোহেল”]এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জাহাজে বেশকিছু আত্মহত্যা এবং হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যা সত্যিই অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এর বাইরে যারা দেশে আটকা পড়ে আছেন, বিমান স্বল্পতার কারণে কাজে যোগ দিতে পারছেন না (চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে আমরা শুধুমাত্র জাহাজে অবস্থানকালিন সময়েই বেতন পাই) তারা একদিকে যেমন তীব্র আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছেন, পাশাপাশি তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ অপেক্ষাকৃত উচ্চ বেতনের এই শ্রমবাজার ভারত, ফিলিপাইন এবং পূর্ব ইউরোপের কাছে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে করোনা টেস্টের মিথ্যা রিপোর্ট সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কুখ্যাতির কারণে বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশীদের জন্য অতিরিক্ত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করায় আমরা সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কারণ একটি জাহাজ বন্দরে সর্বনিম্ন ২ থেকে সর্বোচ্চ ৭২ ঘন্টা অবস্থান করে, এর মধ্যেই নাবিক পরিবর্তন সম্পন্ন করতে হয়। সেই সীমিত সময়ের মধ্যে সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে আমাদের কাজে যোগদান এখন একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে যা দেশে আটকা পড়া কয়েকহাজার নাবিকের মনে তীব্র আতংক ও হতাশার জন্ম দিয়েছে।[/int-ans]

[int-qs]এই যে কভিড-১৯ এর কারণে আটকা পড়ে কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছে বলে আমরা জেনেছি, এই ব্যাপারে আপনার মতামত বা ধারণা কি?[/int-qs] [int-ans name=” শামসুল আনোয়ার মো. সোহেল”]আসলে এই পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে মানসিক দৃঢ়তা বজায় রেখে অনিশ্চয়তার মধ্যে কাজ করে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। একজন মানুষ, যিনি পরিবারের কল্যাণে সবকিছু ছেড়ে জাহাজে অবস্থান করছেন, তিনি যখন তার অতি আপনজনের করোনা আক্রান্তের খবর পান, বা মৃত্যুর খবর পান, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিবারের পাশে এসে দাঁড়াতে পারেন না, তার পক্ষে আসলেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ; ফিলিপাইনের ২৮ বছর বয়স্ক মারিয়া জ্যাকসনের কথা বলা যায়। লকডাউনের কারণে বিখ্যাত প্রমোদতরী হারমোনি অফ দা সীজ (Harmony of the Seas) জাহাজের নাবিক মারিয়ার জাহাজ  অনেক দিন ধরেই ক্যারিবিয়ান সাগরের বারবাডোস বন্দরে আটকা পড়ে আছে। অনেক আগেই চুক্তি সম্পন্ন করা মারিয়া দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন এবং পরিবারের চিন্তায় বিষণ্ণ ছিলেন। একপর্যায়ে তাকে তার কক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, যা পরবর্তীতে আত্মহত্যা বলে প্রতীয়মান হয়।[/int-ans]

[int-qs]করোনা পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কতটা জরুরি বলে মনে করেন?[/int-qs] [int-ans name=” শামসুল আনোয়ার মো. সোহেল”]করোনা পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেকোন সময়ের চাইতে অধিক জরুরী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে সমুদ্রগামী জাহাজের মধ্যে একমাত্র যাত্রীবাহী প্রমোদতরী (Cruise Ship) ছাড়া পণ্যবাহী জাহাজগুলিতে কোন ধরণের স্বাস্থ্যকর্মী কর্মরত থাকেন না। সমস্ত নাবিককেই জাহাজে যোগদানের পূর্বে প্রাথমিক চিকিৎসার ট্রেনিং সম্পন্ন করতে হয়। এর বাইরে নির্দিষ্ট রেডিও স্টেশনে অবস্থানরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্যানেল থাকে, যেখান থেকে জরুরী মূহুর্তে টেলিফোন এবং ইমেইলে সহযোগিতা নেয়ার ব্যবস্থা থাকে। জীবনরক্ষাকারী ঔষধ এবং অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত সরঞ্জামাদি জাহাজে সবসময়ে বহন করা হয় যাতে জরুরী মূহুর্তে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার খুব একটা ব্যবস্থা জাহাজগুলিতে নেই। আর একজন মানুষ, যিনি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সাগরে আটকা পড়েছেন, যাকে নিজের পেশাগত চাপের পাশাপাশি দেশে পরিবারবর্গের ভালোমন্দ মাথায় রাখতে হচ্ছে, বা এসময় নিকটাত্মীয়দের কারো অসুস্থতা বা মৃত্যুর সংবাদ সইতে হচ্ছে, তাকে কাউন্সেলিং করার মত সুব্যবস্থা জাহাজে করা অত্যন্ত দুরূহ। তবে, বর্তমানে জাহাজে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে নাবিকদের মনোবল আগের চাইতে কিছুটা ভালো।[/int-ans]

[int-qs]মানসিকভাবে দৃঢ় থাকার জন্য আপনারা কি কি করছেন?[/int-qs] [int-ans name=” শামসুল আনোয়ার মো. সোহেল”]বিভিন্ন জাহাজ মালিক এবং ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীর কিছু সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে, করোনা পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত গাইডলাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, স্বাভাবিক সময়ের চাইতে ইন্টারনেটের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, খাবারদাবারের বাজেট বাড়ানো হয়েছে। সীমিত সুবিধার মধ্যে সম্ভবপর সবকিছুই করা হচ্ছে। বড় কোম্পানীগুলি নাবিকদের স্ত্রী-সন্তানদের স্বাস্থ্যবীমার আওতায় নিজ নিজ দেশে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করছে।[/int-ans]

[int-qs]আপনার চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতায় করোনাকালীন এই ধরনের দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছেন কিনা? হলেও সেই সময়গুলোতে কিভাবে উত্তরণের চেষ্টা করেছেন?[/int-qs] [int-ans name=” শামসুল আনোয়ার মো. সোহেল”] আমার পেশাগত জীবনে গত ৩০ বছরে কখনোই এই জাতীয় কোন দুর্যোগের মুখোমুখি আমরা হইনি। ২০১০-১১ এর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে কিছু সমস্যা হয়েছিল, যেমন বেতন কমে যাওয়া, পরবর্তী কন্ট্রাক্ট পেতে স্বাভাবিকের চাইতে বেশি সময় লাগা ইত্যাদি। কিন্তু খানিকটা ধৈর্য্যের সাথে সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা গেছে এবং ২০১২ থেকে সে অবস্থা কেটেও গেছে। এবারের মত অনিশ্চয়তায় পুরো বিশ্বের পাশাপাশি আমাদের পেশার মানুষ বিগত অনেক বছরেও পড়েনি।[/int-ans]

[int-qs]মনের খবর’কে সময় দেওয়ার  জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।[/int-qs] [int-ans name=” শামসুল আনোয়ার মো. সোহেল”]মনের খবর’কেও ধন্যবাদ। দেশে মানসিত স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে তাদের সাফল্য কামনা করছি।[/int-ans]

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন

Previous articleধূমপায়ীরা করোনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে?
Next articleকরোনা আক্রান্ত তরুণেরাও ভুগতে পারেন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায়: সিডিসি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here