সারাবিশ্বে মানসিক রোগে আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই চিকিৎসা গ্রহণ করে না এবং নিয়মিতভাবে গ্রহণ করে না। এই চিকিৎসা না নেয়া এবং ট্রিটমেন্ট গ্যাপের কারণে মানসিক রোগ সর্বাত্মকভাবে বৈশ্বিক জনস্বাস্থের জন্য একটি বড়ো সংকট। এজন্যই মানসিক রোগের জন্য চিকিৎসাসেবাসহ অন্যান্য সেবা ঠিক কী ধরনের হলে জনগণকে পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন সেবার আওতায় আনা যায় তা নিয়ে রয়েছে নানা গবেষণা-তথ্য উপাত্ত।
মানসিক রোগীদের জন্য হাসপাতালসমূেহ সাধারণত ইনডোর ও আউটডোর এই দুই ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এই সেবা অপ্রতুল এই কারণে যে, অনেক মানসিক রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণসহ অন্যান্য সেবার প্রয়োজন হয়, যার জন্য ঠিক হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই আবার বাড়িতে বসেও দক্ষ লোক ছাড়া সম্ভব নয়। তাই কমিউনিটি লেভেলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর এখন জোর দেয়া হচ্ছে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মানসিক সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করা, মানসিক রোগীদেরকে যথাযথ চিকিৎসার আওতায় আনা, মানসিক রোগীর শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে বিশেষায়িত হাসপাতালে রেফার করা, কিছু দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক অসুস্থতা যেমন : ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন ইত্যাদি রোগের সাথে সম্পর্কিত বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা চিহ্নিত করা এবং চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা।
শুধু তাই নয়, রোগের সাথে সম্পর্কিত সাইকোথেরাপি প্রদানের ব্যবস্থা, ঔষধ সেবন পর্যবেক্ষণ, রোগী ও রোগীর পরিবারকে রোগ সম্পর্কে অবহিত করা ইত্যাদিও কমিউনিটি লেভেলে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার আওতাভুক্ত।
কমিউনিটি লেভেলের পাশাপাশি বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর একটা সুষম সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত যেন এইসব সেবার স্তর বা ধাপগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হয়। মানসিক রোগের চিকিৎসার চিত্র বিশ্বের উন্নত দেশের তুলনায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সম্পূর্ণ উল্টো। অনেক দেশেই প্রয়োজনের তুলনায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিতান্তই অপ্রতুল। তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে অর্ন্তভূক্ত এখন সময়ের প্রয়োজন।
এই সেবা প্রদানকারীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের ভূমিকাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের একইসঙ্গে দুই ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রাথমিক মনোসেবা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষিত করতে হবে, সেইসঙ্গে রেফারাল যেন সহজসাধ্য হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে যেন মানসিক সমস্যায় আক্রান্তদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগীকে ফলপ্রসূ চিকিৎসাসেবার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়।
এই সমন্বিত সেবার মূল বিষয় হলো কমিউনিটি ভিত্তিক, ব্যক্তি কেন্দ্রিক এবং সিস্টেম ভিত্তিক। এই অপ্রাতিষ্ঠানিক সেবার সহায়তা দিচ্ছে মূলত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্ব সাইকিয়াট্রিক সংস্থা। কিন্তু এর কিছু সমালোচনাও আছে। যেমন : গৃহহীন, জেলখানার বন্দি এবং অসহায় মানুষদের এর আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, মানসিক সেবা দানকারী আলাদা প্রতিষ্ঠান (Asylum) দরকার।
হাসপাতাল পরিচর্যা এবং কমিউনিটি ভিত্তিক সেবা যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তবে তার চিকিৎসা খরচ সমান বা একই হয়। এরকম কিছু অসুবিধা সত্ত্বেও কমিউনিটি মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাই সার্বিক গবেষণার ভিত্তিতে গোল্ডবার্গ এবং হাক্সসহ বিশেষজ্ঞরা কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন। সেগুলোরর মধ্যে অন্যতম হলো :
- কতজনকে এই সেবার আওতায় আনা যায় তার একটা লক্ষ্যমাত্রা রাষ্ট্র এবং স্থানীয় প্রশাসন দ্বারা নির্ণয় করা।
- মানসিক রোগীদের গড় আয়ু বাড়ানো এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস।
- সামাজিক কুসংস্কার দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা এবং কার্যক্রম।
- সেবা এমন হতে হবে যেন সাধারণ মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য এবং সহজসাধ্য হয়।
- বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং কমিউনিটিসেবার মধ্যে যেন একটা সুষম সমতা রক্ষিত হয়।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্যসেবাকে সমন্বিত একটা রূপ দিতে হবে যেন কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প শুধুমাত্র সঠিক ও যথাযথ চিকিৎসা প্রদান নয়, মানসিক রোগ প্রতিরোধেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
তথ্যসূত্র :মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, বর্ষ-১, সংখ্যা-১০