অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপি (এএটি) তে পশুদের নিযুক্ত করা হয় নির্দিষ্ট কয়েকটি লক্ষ্য পূরণের জন্য। এই লক্ষ্য দৈহিক, মানসিক, শিক্ষাগত এবং মনস্তাত্ত্বিক হতে পারে; চিরাচরিত থেরাপির পাশাপাশি এএটি–র সাহায্য নেওয়া হয় চিকিৎসার সুফল বাড়িতে তোলার জন্য।
পশু ও মানুষের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে একটা পারস্পরিক বন্ধন বা সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন সিনেমায় এই বন্ধনের নানা ছবি আমরা দেখেছি, যেমন- মারলে অ্যান্ড মি (২০০৮), ডলফিন টেল (২০১১), হাচি: এ ডগ’স্ টেল (২০০৯) এবং ফ্রি উইলি (১৯৯৩)। গবেষকরা যুগ যুগ ধরে এই সম্পর্ক নিয়ে অনেক গবেষণা চালাচ্ছেন এবং ক্রমশ এই ধারণা আমাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। একজন মানুষের সর্বাঙ্গীণ সুস্থতার ক্ষেত্রে মানুষ-পশুর পারস্পরিক সম্পর্কের অনেক ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এর সাহায্যে মানুষের মানসিক স্থিতিশীলতা বাড়ে। ফলে তার মধ্যে স্ব-মূল্যের বোধ, সামাজিকতা এবং যোগাযোগগত দক্ষতারও উন্নতি হয়।
ষোলোশ (১৬০০) খ্রিষ্টাব্দ থেকেই দৈহিক ও মানসিক সুস্থতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে পশু ও মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধনের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ১৯৬২ সালে যখন শিশু মনস্তত্ত্ববিদ ডঃ বরিস লেভিনসন তাঁর গবেষণা পত্র দ্য ডগ অ্যাস এ ‘কো-থেরাপিস্ট’ প্রকাশ করেন তখন থেকে এটি সাইকোথেরাপির একটি অংশ হিসেবে পরিচিত হয়। পশুকে সাইকোথেরাপির কাজে ব্যবহার করা তখন থেকেই শুরু হয় এবং ক্রমশ তা সর্বজন-পরিচিত একটা থেরাপি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপি বলতে কী বোঝায়?
অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপি (এএটি) তে পশুদের নিযুক্ত করা হয় নির্দিষ্ট কয়েকটি লক্ষ্য পূরণের জন্য। এই লক্ষ্য দৈহিক, মানসিক, শিক্ষাগত এবং মনস্তাত্ত্বিক হতে পারে; চিরাচরিত থেরাপির পাশাপাশি এএটি–র সাহায্য নেওয়া হয় চিকিৎসার সুফল বাড়িতে তোলার জন্য।
”এর সাহায্যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় আক্রান্ত মানুষ তার সমস্যার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়, সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও তা দূর করার চেষ্টা করে।”- একথা বলেছেন শ্রুতি চক্রবর্তী, একজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞ, যিনি তাঁর থেরাপির কাজে কুকুরের সাহায্য নেন।
অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপির প্রত্যেকটি সেশন সাধারণত একঘণ্টা ধরে করা হয়। প্রথম কয়েকটি পর্যায় ধরে বিশেষজ্ঞ রুগির রোগের ইতিহাস বোঝার চেষ্টা করেন এবং অ্যানিম্যাল থেরাপি শুরু করবেন কিনা তার পর্যালোচনা করেন।
অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপি-তে কোন কোন পশু কে ব্যবহার করা হয়?
অনেক ধরনের পশু-পাখি এই থেরাপিতে ব্যবহার করা হয়, যেমন- ছোট ছোট গিনিপিগ, পাখি থেকে শুরু করে বড় জীবজন্তু যেমন- কুকুর, ডলফিন এবং ঘোড়া প্রভৃতি। ভারতে এধরনের থেরাপির কাজে কুকুরের ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। কিছু থেরাপিস্ট আবার বিড়াল এবং ইঁদুরের মতো প্রাণিদেরও ব্যবহার করেন। এগুলো ছাড়া আর অন্য কোনও ধরনের পশুকে এখনও এই থেরাপির কাজে ব্যবহার করা হয়নি।
অ্যানিম্যাল অ্যাসিসটেড থেরাপিতে কুকুরের ব্যবহার প্রচলন করার কারণ হল এরা মানুষের অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারে এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। কুকুর মানুষের করা বিভিন্ন ইশারা বুঝতে পারে, তাদের সঙ্গে মৌখিক এবং চক্ষুগত যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারে এবং তারা মানুষের মুখের ভাব বা ভাষা পড়তে পারে।
থেরাপির কাজে যেসব পশুকে ব্যবহার করা হয় তাদের খুব ভালোভাবে প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। এক্ষেত্রে পশুদের প্রজাতি বা তার বংশ পরিচয়ের চাইতে প্রশিক্ষণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই পশুদের বাছা হয় তাদের মেজাজ ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাদের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে। কুকুরের ক্ষেত্রে দেখা হয় যে তারা শান্ত প্রকৃতির কিনা, তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব আছে কিনা এবং তারা ভরসাযোগ্য কিনা।
”থেরাপির কাজে পশু নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের বাছাই প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”- এমনই মত পোষণ করেছেন অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপিস্ট শিল্পা রাঘাবন।
কখন এএটি-র সাহায্য নেওয়া হয়?
সব বয়সের মানুষের জন্যই এই থেরাপি প্রযোজ্য এবং ব্যক্তিগতভাবে ও দলগতভাবে এই থেরাপি ব্যবহার করা যায়। এই থেরাপির সাহায্যে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা হয় যেমন- হোমসিকনেস, মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি), স্কিৎজোফ্রেনিয়া, আসক্তির সমস্যা, বিকাশগত সমস্যা বা ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার, আচরণগত জটিলতা বা অন্যান্য দৈহিক সমস্যা।
এর সঙ্গে ডিমেনশিয়া এবং পার্কিনসন্স-এর মতো মানুষের স্নায়বিক সমস্যার সর্বাঙ্গীণ সুস্থতার ক্ষেত্রেও এই থেরাপির সাহায্য নেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে মানসিক বিপর্যয় কমাতে এবং ব্যক্তিকে চিকিৎসার মূল স্রোতে থাকার প্রেরণা জোগাতেও সাহায্য করে এই থেরাপি।
কীভাবে অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপি সাহায্য করে?
থেরাপির কাজে পশু ব্যবহারের অন্যতম সুবিধে হল পশুর সঙ্গে সহজভাবে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা। শ্রুতি চক্রবর্তী আমাদের জানিয়েছেন কীভাবে সরাসরি রুগির সমস্যা দূর করতে একজন পশুকে সাহায্যের কাজে লাগানো হয়- ”অনেকসময়ে রুগিরা তাদের অসুখের জন্য খুব বিচলিত হয়ে থাকে। তখন তাদের পশুর সঙ্গে একসঙ্গে বসানো হয়, তারা পশুদের গায়ে আলতো করে ঠেলা দেয়, তারা তাদের সঙ্গে কথা বলে, এবং এসবের সাহায্যেই রুগিরা তাদের উদ্বেগকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।” এভাবে একটি পশুর উপস্থিতির সাহায্যে একজন রুগি তার ডাক্তারের সামনে সহজ হয়ে তার সমস্যার কথা বলতে পারে।
একটি পশুর উপস্থিতির কারণই ক্রমশ একজন রুগিকে তার নিজের অবস্থা ও সেই সম্পর্কে সঠিক চিন্তা করার জন্য সক্ষম করে তোলে। কিছু ক্ষেত্রে থেরাপির সময়েও পশুর উপস্থিতির জন্য পরিস্থিতি তাদের কাছে সহজ হয়ে যায়। অ্যানিম্যাল অ্যাসিসটেড থেরাপিস্ট শিল্পা রাঘবন বলেছেন, ”থেরাপির প্রক্রিয়ায় একটি পশু অনুঘটকের কাজ করে।” যখন একজনের উপর হঠাৎ শারীরিক আক্রমণ বা হামলার মতো বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটে তখন বিশেষ করে এই প্রক্রিয়াটি খুবই সাহায্যদায়ক হয়।
আপনার জন্য কি অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপি প্রযোজ্য?
অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপি সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। একজন রুগির ক্ষেত্রে অ্যানিম্যাল থেরাপি ব্যবহার করার আগে বিশেষজ্ঞরা অনেক বিষয় খতিয়ে দেখেন।
যদি একজন ব্যক্তির মধ্যে নীচের সমস্যাগুলো থাকে তাহলে এএটি-র সাহায্য নেওয়া যায় না:
- যদি রুগি জীবজন্তুকে অপছন্দ করে বা ভয় পায়
- যদি তাদের পশুর সঙ্গে কোনওরকম যোগসূত্রের বোধ না থাকে
- যদি তাদের জীবনে পশুর দ্বারা কোনও ক্ষতিকর বা অবমাননাকর ঘটনার ইতিহাস থাকে
- যদি তাদের ধর্মবিশ্বাসে কোনওরকম পশুর দ্বারা চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকে
- যদি তাদের পশুর লোম বা তাদের কোপে পড়ার ক্ষেত্রে এলার্জি বা বিতৃষ্ণা জন্মায়
এছাড়াও বিশেষজ্ঞরা আরও কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখেন যেমন- রুগির হাইপারঅ্যাক্টিভিটি, তার হঠকারি এবং মারমুখী আচরণ প্রভৃতি। যদি তিনি নিশ্চিত হন যে এই বিষয়গুলো থেরাপি চলাকালীন সময়ে কোনও ব্যাঘাত ঘটাবে না তখন তিনি অ্যানিম্যাল থেরাপি প্রয়োগ করতে উদ্যোগী হন।
একটি পশুর উপর এই থেরাপির কী প্রভাব পড়ে?
পশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে একটি কুকুরকে যদি থেরাপির কাজে ব্যবহার করা হয় তাহলে দেখতে হবে যে কুকুরটি এই প্রক্রিয়াটিকে উপভোগ করছে কিনা এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে কিনা। কারণ এই প্রক্রিয়ার চাপে পশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত বা বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। এই কাজটা পশু-প্রশিক্ষকরা ভালো করতে পারে এবং সেজন্য এই বিষয়টার প্রতি মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞদের সতর্ক থাকা জরুরি। এই থেরাপির প্রতিটি পর্যায়ের আগে ও পরে পশুদের মানসিক চাপের মাত্রা এবং তাদের দৈহিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপি প্রক্রিয়ায় রুগি ও পশু উভয়েরই সাফল্য নিশ্চিত করা জরুরি। কুকুর-সম্বন্ধীয় আচরণবিদ এবং প্রশিক্ষক সিটিজেন কে৯ বলেছে যে, ধরা যাক থেরাপির প্রক্রিয়ায় একটি কুকুর শান্ত ও মনোযোগী হয়ে বসে আছে, রুগির স্পর্শ ও আদর উপভোগ করছে। তার মনে হচ্ছে যে এটা তার জীবনে একটা বড় পুরস্কার। কারণ সে নিজেকে একজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সমতুল্য বলে মনে করছে এবং সেই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সে-ও যেন রুগির চিকিৎসা করছে।
উপমহাদেশে অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপি-র অবস্থান
ভারতীয় উপমহাদেশে অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপি খুব একটা প্রচলিত নয়। তবে ভারতে সম্প্রতি এই থেরাপিটি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করেছে। মানুষের মনে এই থেরাপি সম্পর্কে এখনও ভালোভাবে ধারণা জন্মায়নি। এর ফলে প্রশিক্ষিত নতুন নতুন অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপিস্টদের কাজে কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। অ্যানিম্যাল-অ্যাসিসটেড থেরাপি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্যই তাদের বেশি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে পরিচালকবর্গের অনুপস্থিতি একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই থেরাপির সাফল্যের জন্য পশু, থেরাপিস্ট এবং পশু-প্রশিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ থাকা যেমন জরুরি তেমন তাদের একযোগে বা দলগত হয়ে কাজ করাও একান্ত প্রয়োজনীয়।
সূত্র: ডাব্লিউ এস ফাউন্ডেশন, প্রবন্ধটির মূল লেখক মানসিক স্বাস্থ্য ভারতের বিশেষজ্ঞ শ্রুতি চক্রবর্তী এবং অ্যানিম্যাল অ্যাসিসটেড থেরাপিস্ট শিল্পা রাঘবন।
মানিসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন