মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে কয়েকটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সম্পর্ক তার মধ্যে অন্যতম। একটি অসুস্থ সম্পর্ক যেমন মানসিক রোগ তৈরিতে সাহায্য করে, তেমনি মানসিক অসুস্থতাও সম্পর্ককে নষ্ট করে দেয়।
দীর্ঘদিন বিষন্নতায় ভোগা একজন মানুষের ক্রমে ক্রমে সবার সঙ্গেই সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। তার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আবার সুন্দর একটি সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে শুরু হতে পারে মানসিক অসুস্থতা।
পারুকে হারাবার কষ্টে যন্ত্রণাকাতর বিষন্ন দেবদাসের মুখটি আমাদের সবার পরিচিত। দেবদাসের দুঃখ আমাদের এতোটা স্পর্শ করে যে, দেবদাসের বিষন্নতাকে আমাদের রোগ বলে মনে হয় না। তার মদ খাওয়া, দিনের পর দিন মাতাল হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক মনে হয়। মাদকাসক্তির কথাও কিন্তু আমাদের ভুলেও মনে আসে না। কিন্তু আমরা যদি উপন্যাসের এই চরিত্রটাকে একটু উপন্যাসের বাইরে নিয়ে আসি, সে যদি হয় আপনার বা আমার ভাই অথবা নিকট কেউ, তাহলে আমরা কি চুপচাপ তা দেখে যাব? নীরবে সয়ে যাবো? কখনোই না। আমরা তাকে বোঝাবো। আর তাতে কাজ না হলে মানসিক বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হবো।
মানসিক বিশেষজ্ঞ তাকে দেখবেন। তার এই দেখাটা বিশেষ এক জ্ঞানের আলোকে দেখা। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটির প্রণীত ডিএসএম ফাইভের আলোকে দেখা।
আমরা যেখানে দেবদাসকে একজন বিরহকাতর প্রেমিক হিসেবে দেখবো, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখবেন দেবদাস মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে ভুগছে, পাশাপাশি সাবসট্যান্স রিলেটেড ডিসঅর্ডারেও।
সম্পর্ক ভেঙে গেলেই যে মানুষ অসুস্থ হয়, সম্পর্ক থাকা অবস্থায় হয় না, এমন নয়। কখনো কখনো সম্পর্কের অসন্তুষ্টি মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়ে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। নায়লা একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। তার স্বামী শামীম চাকরি করেন একটি বায়িং হাউজে। তাদের ছয় বছরের একটি মেয়েও আছে। দু’জনেরই বেতন ভালো। হেসে খেলে সংসার চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হয় না।
নায়লা চাকরি সামলান, সংসার দেখেন, মেয়েকে পড়ান। কিন্তু তারপরও শামিম সুযোগ পেলেই নায়লাকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন। একটা তাচ্ছিল্যের ভাব করেন। যেন নায়লার চাকরিটা তাদের জীবনে কোনো গুরুত্ব বহন করছে না। সংসারের সুখ রাখতে গিয়ে অবশেষে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন নায়লা। দেবদাস-পারুলের গল্পের সঙ্গে এ গল্পের কোনো মিল নেই শুধু প্রেম ছাড়া।
নায়লা-শামীমও প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের আগে শামীম ও নায়লাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল নায়লাকে না পেলে তার জীবনটা দেবদাসের মতো হবে। কিন্তু চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার পর নায়লা ভুগছেন মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে। আর সম্পর্কটাকেও অর্থহীন মনে হচ্ছে তার।
মানসিক রোগ কিভাবে সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এবার তার একটি উদাহরণ দেবো। বীনা নামের এক তরুণী, বয়স ২৫ এর কাছাকাছি। অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারে ভুগছিলেন তিনি।
ওসিডি বা অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার এমন একটি রোগ যেখানে ঘুরে-ফিরে রোগীর মনে একই চিন্তা বার বার আসে। অথবা একই কাজ বার বার করার প্রবণতা আসে। এই চিন্তা বা প্রবণতা যে অহেতুক রোগী সেটা বোঝেন, কিন্তু সেটা না করে পারেন না কিংবা সেটা থেকে যে নিজেকে বিরত রাখবেন তাও পারেন না। রোগী নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। বীনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। বিয়ের দিন থেকেই তার মধ্যে চিন্তা আসতে থাকে, স্বামীকে কিভাবে সুখী করা যায়। কিন্তু ওই পর্যন্তই । কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। স্বামী বা বীনার বাড়ির কেউই বিষয়টাকে রোগ হিসেবে বুঝতে পারেন না। অবশেষে স্বামী বিরক্ত হয়ে বীনাকে ডিভোর্স দেন। সবাই ভাবেন, স্বামী না থাকলে বোধহয় বীনা ভালো হয়ে যাবেন। কিন্তু ভালো আর হন না। এক সময় বীনার পরিবার বাধ্য হয় মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে। ওপরে বর্নিত ঘটনা দু’টি সত্য, শুধু নাম কাল্পনিক। পারস্পরিক সম্পর্ক কতটুকু অর্থপূর্ণ তা দেখা জরুরি। সম্পর্কের ভালো চলা, খারাপ চলা অনেক সময় আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা নির্দেশ করে। তাই বলতে চাই, আপনি আপনার সম্পর্কের ব্যাপারে মনোযোগী হোন। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবার সঙ্গে আর ঘরের যে মানুষটা একান্তই আপন তার সাথে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন।
অর্থপূর্ণ সম্পর্কই পারে আপনাকে সবচেয়ে বেশি সুখী করতে। যা ক্ষমতা বা টাকার বিনিময়ে পাওয়া যাবে না। ১৯৮৫ সালে করা একটি জরিপে এরকম একটি সত্য বেরিয়ে এসেছে। জরিপ চালিয়েছিলে প্রোফেসর অ্যালান এস বারশিদ নামের একজন সমাজ মনোবিজ্ঞানী।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে