অভিভাবকত্বের একাল-সেকাল  

0
105

এগারো জন ছেলে-মেয়েকে স্কুলে দিয়ে বাবা-মা যাচ্ছেন অফিস করতে। রূপকথার পরী কিংবা দৈত্য-দানবের চেয়ে এটি কোনো অংশে কম অবিশ্বাস্য নয়। মাত্র কয়েক দশক পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে, ডজনখানেক বাচ্চা-কাচ্চা না থাকলে আমাদের দেশে পরিবার অসম্পূর্ণ লাগত। কালের ধারায় পরিবারের ব্যাপ্তি হয়ে এসেছে ছোটো আর সেইসঙ্গে আমূল পরিবর্তন এসেছে অভিভাবকত্বের ধরণ বা প্যারেন্টিং স্টাইলে।

বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তান লালন-পালনের জন্য পিতা-মাতারা (সাধারণত পিতারা) কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। শিশুদের মতামত বা পছন্দকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের তৈরি করা নিয়ম বা নিজেদের পছন্দকে তাদের ওপর চাপিয়ে দিতেন। কোনো বিষয় বাচ্চাদের কাছে ব্যাখ্যা করাটাকে তেমন প্রয়োজনীয় মনে করতেন না। তাদের কাছে সর্বোচ্চ আনুগত্য প্রত্যাশা করতেন। কোনো কিছু তাদের মতের বিরুদ্ধে গেলে কঠোর শাস্তি প্রদান করতেন। তাদের আবেগ, অনুভূতির প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ দেখাতেন না। প্যারেন্টিংয়ের এই ধরনকে বলা হয় Authoritarian বা স্বৈরাচারী প্যারেন্টিং।

ঐ সময়কালে আরো এক ধরনের প্যারেন্টিং বেশ দেখা যেত যার নাম Neglectful/ Uninvolved বা উপেক্ষামূলক প্যারেন্টিং। এ ধরনের প্যারেন্টিংয়ে পিতামাতা শিশুদের দিকে তেমন খেয়াল করেন না এবং তাদের ভালো-মন্দের প্রতি উদাসীন থাকেন। ফলে তাদের জীবনে তেমন কোনো শৃঙ্খলা থাকে না। মূলত, সেসময় দারিদ্র্য ও অশিক্ষার কারণে অনেক পরিবারের জীবনযাত্রার মান ছিল নিম্ন। দীর্ঘায়িত পরিবারের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খাওয়া পিতামাতারা শিশুদের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পেতেন না বা মানসিকতা থাকত না বললেই চলে।

ডায়ানা বাউম্রাইন্ডের মতে, এগুলো ছাড়াও আরো দুই প্রকারের প্যারেন্টিং হতে পারে। তারমধ্যে একটি হলো Authoritative বা কর্তৃত্বসম্পন্ন প্যারেন্টিং এবং অন্যটি হলো Permissive বা অনুমতিমূলক প্যারেন্টিং। এ প্যারেন্টিং স্টাইলগুলো পূর্বে তুলনামূলক কম দেখা যেত। অথোরিটেটিভ বা কর্তৃত্বসম্পন্ন প্যারেন্টিংয়ে শিশুদের কাছে পিতামাতার প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে। তবে তারা সন্তানদেরকে সাধ্যের অতিরিক্ত কিংবা একতরফা কিছু চাপিয়ে দেন না। তারা শিশুদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম-কানুন বা সীমা নির্ধারণ করে রাখেন এবং এগুলোর কারণ বুঝিয়ে বলেন। এই ধরনের পরিবারে সবসময় বাচ্চাদের সঙ্গে পিতামাতার একটি সহযোগিতা ও অলোচনার পরিবেশ বজায় থাকে। এ ধরনের প্যারেন্টিংয়ে বাবা-মা শিশুদের আবেগ ও অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করেন এবং মূল্যায়ন করেন।

একবিংশ শতাব্দীর মা-বাবার কাছে সন্তানের গুরুত্ব অনেক বেশি। সন্তানের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং প্যারেন্টিং সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এর মূল কারণ। দুই-তিনটির বেশি সন্তান এখন অনেক কম পরিবারেই দেখা যায়। এ কারণে পিতা-মাতা প্রতিটি বাচ্চার প্রতি বেশি সময় ও মনোযোগ দিতে পারেন। আমেরিকার একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্বের তুলনায় বর্তমানে বাবা এবং মা বাচ্চাদেরকে বেশি সময় দিয়ে থাকেন।

ইন্টারনেটের কল্যাণে বাচ্চা লালন-পালনের বিজ্ঞানসম্মত উপায়ও এখন খুব সহজলভ্য। অনেক পিতা-মাতা সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে এসব তথ্য ও পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন। এসব কারণে সন্তানের আবেগ, অনুভূতি ও চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে পিতামাতার খেয়াল যেমন বেড়েছে, একইসঙ্গে কমেছে শারীরিক প্রহারমূলক শাস্তি। লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাস পেয়েছে ব্যাপকভাবে। গঠনমূলক পরিবর্তনের কারণে এখনকার বাচ্চাদের মধ্যে পূর্বের তুলনায় আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি দেখা যায়। তাদের সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতাও অনেক বেড়েছে।

সুইডেনের একটি গবেষণার ফল এরকম যে, বর্তমানে পিতামাতাদের মধ্যে অথোরিটেরিয়ান বা স্বৈরাচারী স্টাইল থেকে অথোরিটেটিভ বা কর্তৃত্বপূর্ণ স্টাইলে রূপান্তর হচ্ছে। কঠোর শাসন এখন বেশ কম দেখা যায় বরং পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের একটি বোঝাপড়ার সম্পর্ক তুলনামূলক অনেক বেড়ে গেছে। তবে, ইদানীং অনেক পিতামাতার মধ্যে পারমিসিভ বা অনুমতিমূলক স্টাইল অনুসরণ করার প্রবণতা তুলনামূলক অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে যেটি আমাদের এই উপমহাদেশে কতটুকু কার্যকর তা অলোচনার দাবি রাখে। এছাড়াও উদ্বেগের বিষয় এই যে, অনেক বাবা-মা সন্তান প্রতিপালনের কৌশলগুলো ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছেন। নিজেদের মতের বিরুদ্ধে গেলে সে পদ্ধতিটি বর্জন করছেন। অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মা (বিশেষভাবে মা) ওভারপ্রোটেক্টিভ থাকেন এবং সন্তানের সুখের ব্যাপারে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ভাবেন। অনেক অভিভাবকই বাচ্চাদের দেওয়া সীমা বা নিয়ম-কানুনেরর তেমন তদারকি করছেন না। একটু আবদার বা জেদ করলেই শিশুর অযৌক্তিক কথাও মেনে নিচ্ছেন বা তার অমূলক চাহিদাও পূরণ করছেন। শিশুদের খেয়াল খুশিমতো চলতে দেওয়া হয় বলে এ ধরনের প্যারেন্টিংয়ে বাচ্চারা ভুল কাজ এবং সঠিক কাজের মধ্যে পার্থক্য ভালো বুঝতে শিখছে না। তাদের মধ্যে বেপরোয়া জীবনযাপনের একটি ধারা তৈরি হচ্ছে। ফলে, কমে যাচ্ছে বড়োদের প্রতি তাদের সম্মান; আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে পিতা-মাতার প্রতি অবাধ্যতা, মাদকদ্রব্য গ্রহণ, সম্পর্কজনিত জটিলতা, সহিংসতা, প্রতিশোধপরায়ণতা কিংবা আত্মহত্যা।

একটা সময় ছিল যখন শিশুরা ছিল পরিবারের অংশ যেখানে তারা ধীরে ধীরে অবদান রাখা শুরু করত। পক্ষান্তরে, এখন শিশুরা হচ্ছে পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু যাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য সদস্যদের কর্মকান্ড আবর্তিত হয়। এসব বাচ্চাদের কষ্ট হবে বলে বা ঝুঁকির ভয়ে বিভিন্ন কাজকর্ম থেকে দূরে রাখা হয়। ফলে, তারা হয়ে উঠছে পরনির্ভরশীল, কমে যাচ্ছে তাদের দায়িত্ববোধ।

গবেষণায় উঠে এসেছে, ১৯৫০-৬০ এর সময় যেখানে দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীর বাচ্চারা একা একাই স্কুলে যেত সেখানে বর্তমানে অষ্টম-নবম শ্রেণীর বাচ্চাদের স্কুলে যেতে অন্যের সহায়তা লাগে। অনেকেই পরিণত বয়সেও পরিবার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বাভাবিক দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করে। চরম দায়িত্বহীনতার উদাহরণ হিসেবে বাবা-মাকে জোরপূর্বক বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর খবর এখন মাঝে মাঝেই শোনা যায়।

এছাড়াও, বর্তমানে অনেক বাবা-মায়ের মধ্যে পারমিসিভের সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে অথোরিটেটিভ এবং কিছু ক্ষেত্রে অথোরিটেরিয়ান মিশে মিশ্র ঘরানার এক প্যারেন্টিং স্টাইল দেখা যাচ্ছে। বাচ্চাদের স্বাস্থ্য, মানসিক বিকাশ এবং আবেগের জায়গাগুলোতে তারা খুবই সচেতন। আবার, তারা শিশুকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন- খাওয়া-দাওয়া, টেলিভিশন দেখা, ইন্টারনেট বা মোবাইল ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রচুর ছাড় দিয়ে থাকেন। তবে, পড়াশোনা বা দক্ষতার জায়গাগুলোতে পিতা-মাতাদেরকে খুব কঠোর হিসেবে দেখা যায়। অনেক অল্প বয়সে অ্যাকাডেমিক শিক্ষা শুরু, বিভিন্ন কোচিং বা শিক্ষকের কাছে বিরামহীন পড়াশোনা, অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে তুলনা বা প্রতিযোগিতা, পরীক্ষায় ভালো নম্বর ইত্যাদি আজকালকার বাচ্চা লালন-পালনের একটি হলমার্ক বলা যেতে পারে। পিতামাতার প্রত্যাশা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সমগ্র বিশ্বজুড়ে নৈতিক মূল্যবোধের যে অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে তার অন্যতম কারণ ত্রুটিপূর্ণ প্যারেন্টিং। সেজন্য, এই বিষয়ে সঠিক উপলব্ধি এখন সময়ের দাবি। নিজের ইচ্ছামতো বা অবেগের বশে নয় বরং শিশুর প্রকৃত ভালোর জন্য বাস্তবিক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের পুষ্টি, মানসিক বিকাশ, আবেগ, খেলাধুলা, বিনোদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে যেমন পজিটিভ থাকতে হবে। একইভাবে আচার-ব্যবহার বা নিয়ম-কানুন ও মূল্যবোধের সীমার ব্যাপারে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। তাদেরকে বিভিন্ন পরিবেশে মিশতে দিতে হবে যেন তারা বিভিন্ন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দক্ষতা অর্জন করে। তাদেরকে ধীরে ধীরে সাধ্যানুযায়ী বিভিন্ন কাজ-কর্মে সম্পৃক্ত করতে হবে যেন তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে। আজকের শিশুই আগামীর পিতামাতা। তাই, আসুন আমরা আজকের পিতা-মাতারা আরো দায়িত্বশীল হয়ে এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করি যারা হবে শারীরিক ও মানসিক শক্তিতে বলীয়ান এবং জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধের গুণে মহীয়ান।

ডা. মো. আরিফুজ্জামান

এম ডি রেসিডেন্ট, সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, ঢাকা।

সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৫ম সংখ্যায় প্রকাশিত।   

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে  

 

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleকাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনে চাই ধীর স্থির মনোভাব
Next articleমানসিক স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here