আমাদের চারপাশে অনেকেই আছে যারা স্বাভাবিক আচার আচরণ করতে পারে না কারণ তাদের মধ্যে অনেকেই স্নায়ু বিকাশ জনিত সমস্যায় (Neuro Developmental Disorder) ভুগছে। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার এ ধরনেরই একটি ডিজঅর্ডার যার মূলে রয়েছে স্নায়ু বিকাশ সংক্রান্ত সমস্যা। ১৮৬৭ সালে হেনরি মুডসলে একদল খুবই তরুণ শিশুদের গুরুতর মানসিক সমস্যাগ্রস্থ হলে চিহ্নিত করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বিকাশ জনিত ধীরগতি এবং স্বাভাবিক শিশুদের চেয়ে আচরণের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। তখন তিনি এটাকে শৈশবকালীন গুরুতর সাইকোসিস বলে শ্রেণীভুক্ত করেন। ১৯৩৪ সালে লিও ক্যানার সর্ব প্রথম এটাকে “অটিস্টিক ডিস্ট্রাবেন্স” বলেন । ডিএসএম-১ ( ডায়গনোস্টিক অ্যান্ড এস্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়াল ফর মেন্টাল ডিজঅর্ডার-১) এ অটিজম কে শৈশবকালীন সিজোফ্রেনিয়া বলা হয়। নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে ডিএসএম-৫ এ এটাকে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার বলা হয়েছে। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত ডিএসএম-৫ এ এই ডিজঅর্ডারের কতগুলো লক্ষণের কথা বলা হয়েছে।
১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন…
গ)
অটিজমের ক্ষেত্রে লক্ষণ গুলো অতি শৈশবকালীন বিকাশের পর্যায়ে থাকতে হবে। কিন্তু যখন সে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আচরণ করার পর্যায়ে আসবে ত খন এই সীমাবদ্ধ ক্ষমতা গুলো সম্পূর্ণভাবে চলে যাবেনা বা পরবর্তী জীবনে শিক্ষা গ্রহণের ফলে ও সম্পূর্ণভাবে চলে যাবেনা।
ঘ)
এই লক্ষণ গুলোর কারণে ক্লিনিক্যালি তাৎপর্যপূর্ণভাবে তার সামাজিক, পেশাগত এবং বর্তমান ব্যবহারিক ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের বিঘ্ন ঘটে।
ঙ)
এই সমস্যা গুলোর বৃদ্ধিবৃত্তীক অক্ষমতা দ্বারা ব্যাখ্যা না করাই ভাল (ইন্টাল্যবকচুয়াল ডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার) অথবা গ্লোবাল ডেভলপমেন্টাল ডিলে দ্বারা। বৃদ্ধিবৃত্তীক অক্ষমতা এবং অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার প্রায়ই একসাথে হতে দেখা যায়। বৃদ্ধিবৃত্তীক অক্ষমতা যদি অটিজমের সাথে সহরোগ হিসাবে থাকে তবে সাধারণ বিকাশ জনিত পর্যায় থেকে অটিজমের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগের পর্যায়টি নিচে থাকে।
নোট
যাকে ডি,এস,এম-৪ দ্বারা অটিস্টিক ডিজঅর্ডার অ্যাসপারগারস ডিজঅর্ডার পারভেসিভ ডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার নট আদার ওয়াইজ স্পেসিফাইড হিসাবে সনাক্ত করা হয়েছে তাকে অবশ্যই অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার এর লক্ষণের মাধ্যমে সনাক্ত করা উচিত। যাদের উল্লেখযোগ্যভাবে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে কিন্তু অটিজম এর মানদন্ড পূরণ করে নাই। তাদের কে মূল্যায়ণ করা উচিত সোস্যাল (প্র্যাগমেটিক) কমিনিকেশন ডিজঅর্ডার হিসাবে।
বিশেষায়িতকরণ
– বুদ্ধিবৃত্তীয় অক্ষমতা আছে বা নাই।
– ভাষাগত অক্ষমতা আছে বা নাই।
– বংশগত, শারীরিক এবং পরিবেশগত উপাদানের সম্পৃক্ততা।
– অন্যান্য নিউরোডেভলপমেন্টাল, মেন্টাল এবং বিহ্যাভিওরাল ডিসঅর্ডার এর সম্পৃক্ততা।
– কান্টাটোনিয়া আছে নাই।
শিশুর বিকাশের এই অস্বাভাবিকতা সাধারণত ১২-২৪ মাসের মধ্যেই বোঝা যায় তবে বিকাশের গতি যদি গুরুতরভাবে ধীরগতিতে হয় তখন ১২ মাসের মধ্যেই পরিস্কারভাবে বুঝতে পার যায়। অর্থাৎ অটিজমের ক্ষেত্রে আচরণগত সমস্যাগুলো অতিশৈশব কালেই ধরা পরে। কার কার ক্ষেত্রে জীবনের প্রথম বৎসরের মধ্যেই সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন আগ্রহ থাকে না। এছাড়া বিকাশ জনিত ধীরগতির বিষয়টি ক্রমান্বয়ে অথবা দ্রুত অবনতি হতে দেখা যায় ২ বৎসর বয়স এর মধ্যেই। কিছু অবনতি বা ক্ষতি রেড ফ্ল্যাগ হিসেবে কাজ করে।
অটিজম এর প্রথম লক্ষণ হচ্ছে ভাষা বিকাশের ধীর গতি। ইহা সামাজিক বিষয়ে আগ্রহ এবং সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। যেমনঃ এক জনের দিকে না তাকিয়েই তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়া। তার চারিদিকে খেলনা ছড়িয়ে রাখলে ও কখনই তা দিয়ে খেলেনা। একটি বর্ণমালার নাম জানলেও জিজ্ঞসা করলে বলেনা।
২ বৎসরে তার মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ একই ধরণের আচরণ/নিদিষ্ট আচরণ বার বার করার প্রবণতা, সঠিকভাবে খেলতে না পারার বিষয়গুলো সহজেই চোখে পরে। এধরনের আচরণ প্রবণতা পরবর্তী জীবনেরও বয়ে বেড়ায়। কিশোররা একই ধরণের খাবার খেতে পছন্দ করে । একই ধরনের ভিডিও বার বার খেলে। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে হাটো, কুনই এ আঘাত করে থাকে। নির্দিষ্ট আচরণ বার বার করার প্রতি অগ্রহের বিষয়গুলো অনেক সময় স্কুলে যাবার আগে সনাক্ত করা সম্ভব হয়না।
খুবই অল্প সংখ্যকই প্রাপ্ত বয়সে স্বনির্ভরশীল জীবন যাপন করতে পারে । তারাই পারে যাদের ভাষাগত এবং বুদ্ধিবৃত্তীক ক্ষমতা উচ্চতর ধরণের এবং যে কাজ সে করছে সেটি যদি তার পছন্দ এবং আগ্রহের সাথে মিলে যায় তবেই সেটা সম্ভাব হয়। যাদের অল্প মাত্রায় সমস্যা থাকে তারা স্বনির্ভরশীল হয়ে কাজ করতে পারে। যাই হোক, সামাজিক অভিজ্ঞতা কম থাকার কারণে অন্যের সাহায্য ছাড়া বাস্তব জীবনের অনেক চাহিদাই পূরণ করতে পারেনা এবং উদ্বেগ এবং বিষন্নতায় ভুগতে পারে। অটিজম আক্রান্ত কিছু প্রাপ্ত বয়স্করা বলেন যদিও তারা খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করেন, যার ফলে অন্যরা তাদের সমস্যা গুলো বুঝতে পারেনা কিন্তু সামাজিক গ্রহণযোগ্য আচরণ করতে গিয়ে তাদের মধ্যে অনেক চাপের সৃষ্টি হয় তথাপি বয়স্কদের ব্যপারে খুবই কম তথ্য জানা গিয়েছে।
অটিজমের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান হিসাবে পিতামাতার বয়স, জন্মকালীন কম ওজনের শিশু এবং বংশগতির প্রভাব রয়েছে। এছাড়া অটিজমের কারণে তার ব্যবহারিক জীবনে কি ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় সেই বিষয়েও আলোচনা করা প্রয়োজন। শিক্ষণে সমস্যা হয় বিশেষ করে যে সব শিক্ষণ সামাজিক পারস্পরির সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। সহপাঠীদের সাথে খেলাধূলা, মেলা-মেশায় সমস্যা হয়। তার চাহিদা পূরণ করতে না পারলে বা রুটিনে যদি কোন পরিবর্তন হয় তবে সে বিরক্ত হয়।
তার খাওয়া, ঘুম, চুলকাটা, দাঁতব্রাশ ইত্যাদির ক্ষেত্রে তীব্র সমস্যার সৃষ্টি করে। পরিকল্পণা প্রনয়ণ, সংগঠিতকরণ এবং খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তীব্র সমস্যার কারণে লেখা-পড়া নেতিবাচক প্রভাব পরে। যদিও কার কার ক্ষেত্রে গড় বুদ্ধি রয়েছে। কিন্তু পরিবর্তনের প্রতি অনিচ্ছা এবং নতুনত্বের প্রতি আগ্রহ না থাকার কারণে এরা প্রাপ্ত বয়সে এসেও স্বনির্ভরশীল হতে পারে না।
গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফল থেকে জানা যায় প্রায় ১০,০০০ জনের মধ্যে ২০ জন অটিজমে আক্রান্ত ( ফোমবোন ২০০৯)। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের চারগুণ বেশী হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৮% শিশু অটিজমে আক্রান্ত। মনে রাখতে হবে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের লক্ষণ গুলো সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবে কমে বা চলে যায়না। ভাল পরিস্থিতির দিকে বা অক্ষমতা কমিয়ে আনার জন্য সারাজীবন শিক্ষা অর্জন করতে হয়।
অটিজম ডিসঅর্ডারে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে বিহ্যাভিয়র থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, ফ্যামিলি কাউন্সিলিং এর প্রয়োজন হয়। এদের কে স্পেশালাইড স্কুলে ভর্তি করার আবশ্যকতা রয়েছে। উপযুক্ত শিক্ষা তাদের সমাজ জীবনে খাপ-খাওয়াতে সাহায্য করবে।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।