পর্দায় দেখা যাচ্ছে, নায়ককে তার শত্রু পক্ষ চক্রান্ত করে একটা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বেশ কয়েকজন ধরাধরি করে একটা ঘরে নিয়ে তাকে চেয়ারে বসিয়ে হাত-পা বেঁধে, মুখের মধ্যে একটা চোঙা ধরনের কাঠি গুঁজে, হেলমেট পরিয়ে কারেন্টের শক দিচ্ছে। কারেন্টের শক চলতে থাকা অবস্থায় পাশাপাশি দৃশ্যে শত্রু পক্ষ আর চিকিৎসককে হা হা করে বীভৎস হাসি দিতে দেখা যাচ্ছে। আর নায়ক একদম নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত কারেন্টের শক দেয়া হচ্ছে।
নায়ককে যখন বের করা হয় তখন দেখা যাচ্ছে, তার মাথা একদিকে ঝুঁকে আছে, লালা পড়ছে ঠোঁটের এক কোণা দিয়ে, চোখে ফ্যাল ফ্যাল একটা দৃষ্টি। এরপরের দশ্যৃগুলোতে দেখা যাবে, নায়কের আর কোনো নিজস্ব শক্তি নাই। কাহিনির মোড়ে তাকে কেউ উদ্ধার করলে তখন সে বাঁচতে পারে।
পাঠক, আপনাদের কাছে এরকম দশ্যৃ অচেনা নয়। প্রায়ই ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপিকে এরকমভাবে শাস্তিমলূক এবং ভয়ংকর একটি পদ্ধতি হিসেবে দেখানো হয়। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া ওয়ান ফ্লিউ ওভার দ্যা কাক্ক’স নেস্ট চলচ্চিত্রটিতে ইসিটিকে শাস্তির পদ্ধতি হিসেবে দেখানো হয়। এইরকম ধারণা গড়ে ওঠার পেছনে ঐতিহাসিক একটা কারণও আছে। উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিশ শতকের শুরুতে সামাজিক নিয়মকানুন, শ্রেষ্ঠত্ব এসবের বিচারে যাকে আলাদা মনে হতো, মানসিক রোগী হিসেবে বিবেচিত হতো তাদেরকে সমাজের থেকে দূরে রাখা, হত্যা করা-এগুলো প্রচলিত ছিল।
তখন ধারণা করা হতো, এই বংশগতিকে রোধ করার মাধ্যমে সমাজকে বাঁচাতে হবে। এছাড়া নাৎসি ক্যাম্পে অনেক রোগীকে মেরে ফেলা, অত্যাচার করার ঘটনাও আছে। বর্তমানে যদিও অমানবিক কোনো গবেষণা, চিকিৎসা-পদ্ধতি বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত নয়, তবু পূর্বের স্মৃতি এবং ধারণা আমাদের মধ্যে এখনো কাজ করছে। তাই গণমাধ্যম, জনমনে এখনো এই ধারণা প্রচলিত এবং জনপ্রিয় যে, ‘মানসিক রোগীকে অথবা ষড়যন্ত্র করে কাউকে মানসিক রোগী হিসেবে অন্য কেউ প্রমাণ করতে পারলে তাকে হাসপাতালে বা এসাইলামে নিয়ে শক দিয়ে পাগল বানিয়ে দিবে’।
কিন্তু আসলে এই চিকিৎসা-পদ্ধতিটি কি এরকমই? কেন দেয়া হয় এটা? শাস্তি কিংবা হয়রানি হিসেবে? নাকি আসলে কোনো ফলাফল পাওয়া যায় এই চিকিৎসায়?
ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি শুরু হয় ১৯৩০ সালে অধ্যাপক উগো শার্লেটি (অধ্যাপক, নিউরোসাইকিয়াট্রি) এবং তড়িত প্রকৌশলী লুশিও বিনির হাত ধরে। ১৯৩০-এর আগে একটা বিষয় ধারণা করা হতো যে, যাদের মধ্যে মৃগী রোগ দেখা যায় তাদের মানসিক রোগ বিশেষ করে সিজোফ্রেনিয়া হয় না। এই ধারণাটি আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী ধরনের মনে হলেও এবং বর্তমানে এই তত্ত্বের বিপরীতটাই দেখা গেলেও, তখন দেখা যেত যেকোনোভাবে একজন মানসিক রোগীর যখন খিচুঁনি তৈরি করা গেলে তখন তার আচরণে পরিবর্তন আসত।
এই ধারণার প্রবক্তা হিসেবে মনোরোগবিদ লাডিসলাক মেডুনা বিখ্যাত ছিলেন। তিনি বুদাপেস্টে ক্যামফর, কারডিয়াজোল প্রয়োগ করে খিচুঁনি তৈরি করেন। খিচুঁনি হওয়ার পর রোগী কিছুটা ভালো বোধ করলেও এই পদ্ধতি ছিল ব্যয়বহুল এবং ভীতিকর। ইতালির অধ্যাপক শার্লেটি একদিন ভেড়াকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে অজ্ঞান করে দেখেন। এরপর খিচুঁনির পদ্ধতিকে আরামদায়ক এবং কার্যকরী করতে মস্তিষ্কে বিদ্যুৎপ্রবাহ দিয়ে খিঁচুনি তৈরির চিন্তা করেন। তড়িত প্রকৌশলী লুসিও বিনি এইরকম যন্ত্র বানালে তাঁরা প্রথমে কুকুর এবং শূকরের ওপর প্রয়োগ করে দেখেন যে এতে মস্তিষ্কের কোনো ক্ষতি হয় না। রোগীর ওপর প্রয়োগ করার পর ১৯৩৮ সালে প্রথমবারের জার্নালে এই পদ্ধতির ওপর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন তাঁরা। অল্প কয়েক বছরেই মানসিক রোগের চিকিৎসা-পদ্ধতি হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি।
প্রথম দিকে অবশ না করেই এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলেও পরবর্তীকালে (১৯৫০-৬০ সালে) মাংশপেশি অবশকারী ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে আরো আরামদায়ক এবং নিরাপদ করে তোলা হয় পদ্ধতিটিকে। বর্তমান যুগে ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি বেশ কিছু রোগের জন্য একটি নির্দেশিত চিকিৎসা-পদ্ধতি। যেমন : তীব্র বিষণ্ণতা, সিজোফ্রেনিয়া ,ম্যানিয়া , প্রসবকলীন বিষণ্ণতা , সাইকোসিস, ক্যাটাটোনিয়া, বয়স্ক রোগীদের তীব্র বিষণ্ণতা।
ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি চিকিৎসার যেই দশ্যৃ আমরা নাটকে, সিনেমায় দেখি ঠিক তার বিপরীত দৃশ্য বাস্তবে ঘটে। প্রথমে রোগীকে পেশাদার মনোচিকিৎসক ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে রোগ নির্ণয় করেন, চিকিৎসা-পদ্ধতিগুলো চিন্তা করেন, শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষা করেন, ল্যাব পরীক্ষা করে রোগীর শারীরিক অবস্থা যাচাই করেন। তারপর যথাযথভাবে রোগী বা রোগীর আইনগত অভিভাবককে পুরো বিষয়টা জানিয়ে একটি ‘অবহিতক্রমে সম্মতি’ নিয়ে এবং অবেদনবিদসহ (এ্যানেসথেসিওলজিস্ট) এই চিকিৎসা দেয়া হয়।
রোগীকে অজ্ঞান করে নির্দিষ্ট যন্ত্রের মাধ্যমে নির্দিষ্ট মাত্রার বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয় যেটাতে খিচুঁনি তৈরি হয় এবং ২০-৪৫ সেকেন্ড খিচুঁনিটা থাকে। তারপর অন্তত ছয় থেকে আট ঘণ্টা রোগীকে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। সাধারণত সপ্তাহে দইু-তিনবার করে তিন-চার সপ্তাহ দেয়া হয়। রোগীর অবস্থা অনযুায়ী মোট চিকিৎসাকাল ঠিক করা হয়। গবেষণায় দেখা যায় এই চিকিৎসা স্বল্প মেয়াদে খবুই ফলপ্রসূ।
ইসিটি কাজ করে মস্তিষ্কে রাসায়নিকের পরিবর্তন ঘটিয়ে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, খিচুঁনি হওয়ার পূর্বে এবং পরে মস্তিষ্কের রাসায়নিকগুলোর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়। ইসিটি দেয়ার পর ঔষধের কার্যক্ষমতাও বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
এই পদ্ধতির কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। যেমন : মাথাব্যথা (সাময়িক), মাংসপেশি, চোয়ালে ব্যথা, অচেতন অবস্থা (কয়েক মিনিট থেকে ঘণ্টা খানেক থাকে), ভুলে যাওয়া (বিশেষ করে ইসিটি প্রয়োগের আগেপরের সময়ের স্মৃতি), অজ্ঞান করার ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে হৃৎপিন্ডের সমস্যা, অতিসংবেদনশীলতা ইত্যাদি দেখা যেতে পারে। তবে ইসিটি দেয়ার আগে এই বিষয়ে ইতিহাস নেয়া হয় এবং হৃৎপিন্ডের অবস্থাও পরীক্ষা করা হয়। ইসিটির মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে একটি গবেষণায় (১৯৭০-এর মাঝামাঝি থেকে শুরু করে সাড়ে সাত লাখ ইসিটির রেকর্ড থেকে) দেখা যায়, এতে এক লাখ জনে দুইজনের মত্যৃু হতে পারে-অর্থাৎ এটি যথেষ্ট নিরাপদ পদ্ধতি।
বিখ্যাত লেখক এবং অভিনেত্রী ক্যারি ফিসার দীর্ঘসময় বিষণ্ণতায় ভুগে চিকিৎসা হিসেবে ইসিটি নিতে থাকেন। বিভিন্ন লেখায় তিনি প্রকাশ করেছিলেন যে, ইসিটিকে তিনি নিজের জন্য ঔষধের চেয়ে বেশি উপকারী মনে করতেন। যেসব ক্ষেত্রে প্রয়োজন সেখানে ইসিটির প্রয়োগ ভালো ফলাফল আনতে পারে। তাই ভুল ধারণা না রেখে ইসিটিকে একটি কার্যকর চিকিৎসা হিসেবে গ্রহণ করাই হবে যুক্তিসংগত।
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ১ম সংখ্যায় প্রকাশিত।