ধরা যাক, জনাকীর্ণ কোন স্থানে এক ব্যক্তির উপর ছুরি নিয়ে কয়েকজন হামলা করলো। আক্রান্ত ব্যক্তি সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে লাগলো। আপনি দেখলেন এবং ভাবলেন, তাকে সাহায্য করা উচিৎ, কিন্তু ঠিক কেন যেন কিছুই না করে, আর দশজনের মত আপনিও দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেলেন। এতে আপনি হয়ত উটকো কোন ঝামেলায় পরলেন না, কিন্তু মনের মধ্যে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করতে লাগলো। আপনি ঠিক ভেবে পাচ্ছেন না, আপনার আসলে কী করা উচিৎ ছিলো, যদি সাহায্য করাই উচিৎ ছিলো, তাহলে কেনো করলেন না। আসুন, দেখা যাক, মনোবিদ্যায় এ ঘটনার ব্যাখ্যা কি?
নিঃস্বার্থভাবে অন্যকে সাহায্য করা, অন্যের বিপদে এগিয়ে আসাকে বলা হয় “পরার্থপরতা” যাকে ইংরেজিতে বলা হয় “অল্ট্রুইজম”। মানুষ অন্য মানুষের বিপদে এগিয়ে আসবে, নৈতিকভাবে এটাই আমাদের চাওয়া এবং এটাই মনুষ্যত্ত্ব। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে গিয়ে বেশ হতাশাজনক চিত্রই খুঁজে পান।
প্রথম যে ঘটনার কারণে পরার্থপরতা নিয়ে বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসেন, সেই ঘটনা জানা প্রয়োজন।
১৯৬৪ সালে, নিউ ইয়র্ক শহরে নিজ অ্যাপার্টমেন্টের সামনে কেটি জেনোভেস নামে এক তরুণীকে মারাত্বকভাবে ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে হত্যা করে এক যুবক। একপর্যায়ে ঘাতক যুবক পালিয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে পুনঃরায় ছুরিকাঘাতের মাধ্যমে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। পুরো ঘটনা ঘটতে ত্রিশ মিনিটের মত লাগে, এবং পুরোটা সময় কেটি জেনোভেস সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকে। তখন মোট ৩৮ জন মানুষ ঘটনাটি তারই এপার্টমেন্ট থেকে দেখছিলো, কিন্তু কেউ তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি, এমনকি পুলিশকেও কল দেয়নি।
তখন ঘটনাটি বেশ আলোচিত হয় এবং এরপর থেকেই শুরু হয় এই ঘটনা নিয়ে অনেক বিচার বিশ্লেষণ। সবার মনে প্রশ্ন জাগে, জনাকীর্ণ একটি জায়গায় কেউ আক্রান্ত হলে, আশেপাশের কেউ সাহায্য করার জন্য কেন এগিয়ে আসে না?
দুইজন সমাজবিজ্ঞানী জন ডার্লে এবং বিব ল্যাটানি কেটি জেনোভেসের ঘটনার উপর গবেষণা শুরু করেন এবং খোঁজার চেষ্টা করেন, কেন মানুষ এরকম পরিস্থিতিতে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না।
তাদের গবেষণায় বেশ কিছু বিষয় উঠে আসে।
প্রথমত, বেশি মানুষের উপস্থিতি বিপদগ্রস্থ মানুষকে সাহায্যের প্রবণতাকে হ্রাস করে। এর কারণ দুটো হতে পারে, এক, বেশি মানুষের উপস্থিতি প্রত্যক্ষদর্শীদের একটা দ্বিধা-দ্বন্দে ফেলে দেয় এবং মনে হতে থাকে যে, ঘটনা সম্ভবত বেশি মারাত্বক না। দুই, যেকোন আকস্মিক ঘটনায় উপস্থিত সবার মাঝে “ডিফিউশন অফ রেসপন্সিবিলিটি” কাজ করে। এর ফলে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সবাই ভাবেন, “অন্য সবাইতো আছে সাহায্য করার জন্য, আমি কেনো ঝামেলায় জড়াবো। যদি কেউ এগিয়ে আসে, তাহলে আমিও যাব”। তারা আরো গবেষণা করে দেখতে পান, মানুষ যখন একা থাকেন, তখন অন্য বিপদগ্রস্থ মানুষকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে বেশি।
দ্বিতীয়ত, যখন কেউ অন্য কোন মানুষকে বিপদগ্রস্থ অবস্থায় দেখে, তখন তার মাথায় দুটো জিনিস কাজ করে, এক ঘটনাটি কতটুকু বিপদজনক এবং দুই তার তখন কী করা উচিৎ। অর্থাৎ সাহায্য করতে গেলে তার কতটুকু লাভ এবং কতটুকু ক্ষতি হবে, এদুটো বিষয়ের উপর নির্ভর করে ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নেন, যে সাহায্য করবো, না কী করবো না।
অন্যকে সাহায্য করলে বা না করলে কী কী লাভ বা কী কী ক্ষতি হতে পারে?
অন্যকে সাহায্য করতে গেলে লাভ হচ্ছে, নিজের কাছে ভালোবোধ হওয়া এবং অন্যের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া। আর ক্ষতি হচ্ছে, একটা বিপদজনক, বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়া এবং নিজের প্রয়জনীয় সময় ব্যয় হওয়া।
অন্যকে সাহায্য না করলে লাভ হচ্ছে, ব্যক্তির স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত না হওয়া, কোন ঝামেলায় না জড়ানো। এবং ক্ষতি হচ্ছে, নিজের কাছে অপরাধবোধ কাজ করা এবং অন্যের তিরস্কার পাওয়া।
যেকোন বিপদগ্রস্থ পরিস্থিতিতে যদি ব্যক্তি দেখে, যে সাহায্য করলে বিপদ কম, লাভ বেশি, অর্থাৎ সাহায্য করলে বিপদে পরার সম্ভাবনা কম এবং নিজের কাছে ভালো লাগা কাজ করবে বেশি, তাহলে সে সাধারনত সাহায্যই করে। আর যদি দেখে সাহায্য করলে লাভ কম, ক্ষতি বেশি, অর্থাৎ ভালো লাগার থেকে ক্ষতিই বেশি, তাহলে সে সাধারনত সাহায্য করে না।
যখন দেখে, সাহায্য করলেও ক্ষতি বেশি, না করলেও ক্ষতি বেশি, অর্থাৎ সাহায্য করলে বিপদের মাত্রা বেশি, আবার না করলে নিজের কাছে অপরাধবোধও বেশি, তাহলে সে সাহায্য করার জন্য এমন কাউকে খোঁজে যে সঠিকভাবে সাহায্য করতে পারবে, যেমন- পুলিশকে ফোন দেয়া। আবার যখন দেখে, সাহায্য করলে বা না করলে লাভ এবং ক্ষতি দুটোই কম, তখন সাহায্য করা না করা পরিস্থিতি এবং ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন হয়।
কোন বিপদগ্রস্থ পরিস্থিতিতে সাহায্য করতে পারলে, সাবারই একটা ভালো অনুভূতি হয় যা পরবর্তিতে এধরনের পরিস্থিতিতে আরো বেশি করে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু তারপরও আমরা দেখি, মানুষ সাহায্য করেনা, কারণ হিসেবে মনোবিজ্ঞানিরা দুটো বিষয়ের কথা বলেন, ঘটনার ভবিষ্যৎ নিয়ে “ভীতি” এবং “অনিশ্চয়তা”।
মার্কিন মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম মাসলোর মানুষের চাহিদার ঊধ্বর্গামী শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী, আমাদের ভালো লাগার অনুভূতির থেকে আমরা আমাদের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেই বেশি। এজন্যই বিপদজনক পরিস্থিতিতে আমরা সাহায্যের জন্য কম এগিয়ে যাই। এর মানে এই না, যে মানুষের সাহায্য করার ক্ষমতা বা আকাঙ্ক্ষা কমে গেছে বা মরে গেছে। এর মানে হলো এই, আমাদের সাহায্য করার আকাঙ্ক্ষা বা ক্ষমতা পরিবর্তিত হয়ে নিরাপত্তার দিকে ধাবিত হয়েছে। সেজন্য এই অতি ব্যস্ত, চাহিদা সম্পন্ন এবং বিপদজনক পৃথিবীতে আমাদের সাহায্য করার তীব্র ইচ্ছা বা পরার্থপরতা যথাযথ ভাবে বিকশিত হচ্ছে না।