(জন্ম ৩১ অক্টোবর, ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দ-মৃত্যু ২০ মে, ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দ)
আমেরিকা বা আটলান্টিক সমুদ্রের নাম শুনলে আজো তার নাম ভেসে উঠে মনের পর্দায়। রুপালী জলরাশি আর তান্ডব নৃত্য চালানো সামুদ্রিক ঝড় কাটিয়ে অজানাকে জানার জন্য এগিয়ে চলা একজন দুঃসাহসী নাবিকের কল্পিত ছবি উঁকি দেয়। ক্রিস্টোফার কলম্বাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন আধুনিক ইতালির অন্তর্গত তৎকালীন জেনোয়া রাজ্যে। খুব ছোটোবেলা থেকেই সমুদ্র অভিযানের অভিজ্ঞতা ছিল, বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জ থেকে ঘানা পর্যন্ত ঘুরেছিলেন।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত না হলেও নিজের চেষ্টায় ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। সেসময় ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আমদানিকৃত মশলার বাণিজ্যের প্রতি ইউরোপের বণিকরা আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। সমগ্র ইউরোপের অভিযাত্রীরা চেষ্টা চালাচ্ছিল ভারত ও দূরপ্রাচ্যে পৌঁছানোর সহজ সমুদ্রপথ আবিষ্কার করতে।
সমসাময়িক যুগের এই প্রবণতা তাকেও গ্রাস করেছিল কিশোরকাল থেকেই। তিনি পরিকল্পনা নিয়ে এক রাজদরবার থেকে অন্য রাজদরবারে ঘোরাঘুরি করেছিলেন অনেক। অবশেষে স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্ড ও রাণী ইসাবেলা আর্থিক আনুকূল্য দেখালে তিনটি জাহাজের বহর নিয়ে পশ্চিমে যাত্রা শুরু করলেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ আটলান্টিকের অন্যপারে পশ্চিমে অবস্থিত।
১৪৯২ সালে প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে বাহামা দ্বীপপুঞ্জে পা রাখেন। এরপর কিউবা, হিস্পানিওলাতে যান, হাইতিতে প্রথম ইউরোপীয় কলোনি স্থাপন করেছিলেন। নতুন ভূখন্ড আবিষ্কারের পরেও তার ধারণা ছিল সেটা ভারতীয় ভূখন্ড। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে স্থানীয় আদিবাসীদের নামকরণ করেছিলেন ইন্ডিয়োস বা ইন্ডিয়ান। এই ভুল নামটি এখনো আমেরিকার আদিবাসীদের জন্য ব্যবহার হয়ে আসছে। তার আমেরিকা আবিষ্কার মূলত পৃথিবীর ইতিহাসকেই পালটে দিয়েছিল। শুরু হয়েছিল অভিযান, বিজয়, সাম্রাজ্যবাদের এক নতুন যুগ। পশ্চিমা বিশ্বের ইতিহাসে এর গুরুত্ব এতটাই ব্যাপক যে কলম্বাসের অভিযানের আগের পৃথিবীকে বলা হয় ওল্ড ওয়ার্ল্ড আর পরের পৃথিবীকে নিউ ওয়ার্ল্ড! মৃত্যুর পর কয়েক শতাব্দী তাকে মানব ইতিহাসের বীর হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও বর্তমান সময়ে গবেষকরা বের করে এনেছেন অত্যাচারের অনেক ইতিহাস, আদিবাসীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা, ভয়াবহ দাসত্বের করুণ চিত্র! আবার প্রশ্ন উঠেছে কেমন ছিলেন ব্যক্তি কলম্বাস!
বর্তমানে ধারণা করা হয় কলম্বাসেরও পাঁচশ বছর আগে ভাইকিংরা আমেরিকা পৌঁছেছিল। উপরন্তু কলম্বাস আমৃত্যু বিশ্বাস করতেন তিনি এশিয়া আবিষ্কার করেছেন। তাই মৃত্যুর পাঁচশ বছর পরে নতুন করে চলছে আলোচনা ও বিতর্ক! কলম্বাসের নামে আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকায় অসংখ্য স্থাপনা, স্থানের নাম এমনকি দেশের নাম ও রয়েছে। তাকে মহত্তর করার এই প্রচেষ্টা শুরু হয় ঔপনিবেশিককালে। বিশেষ করে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর আমেরিকানরা যখন নতুন করে তাদের নিজস্ব ইতিহাস লিখতে শুরু করেছিল তখন চেষ্টা চলছিল বৃটেনের সাথে যত কম সম্পৃক্ততা দেখানো যায়। তাই প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কলম্বাসকে মহিমান্বিত করার প্রয়াস শুরু হয় ব্যাপকভাবে। আমেরিকা আবিষ্কার নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই অভিযান প্রচেষ্টাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
একচল্লিশ বছরে চারবার অশান্ত আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিলেন এমন জাহাজে যেগুলো সাগর পাড়ি দেয়ার উপযুক্ত ছিল না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে অনেকেই তখন জানত বা ধারণা করত পৃথিবী গোল, কিন্তু নৌপথে তা আবর্তন করা সম্ভব তা কলম্বাসই চিন্তা করার সাহস দেখিয়েছিলেন।
কলম্বাসের চরিত্রের খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিক সমুদ্র অভিযানের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। সাথে গণিত, জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান তাকে দক্ষ নাবিক বানিয়েছিল। গ্যালিলিওর জন্মের এক শতাব্দী আগেই তিনি প্রাগত ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে ভাবতে পেরেছিলেন পৃথিবী হয়ত বিশ্বের কেন্দ্র নয়! দৃঢ় ধারণা জন্মেছিল পশ্চিমে যাত্রা করলে সূর্য, চাঁদ, গ্রহ নক্ষত্রের গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে অবশ্যই ভারত ও মশলা দ্বীপে পৌঁছানো সম্ভব! দক্ষ ও সাহসী নাবিক হওয়ার পাশাপাশি কলম্বাস মনে প্রাণে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী খ্রিস্টিয়ান।
সমগ্র দুনিয়ায় নিরিবিচ্ছিন্নভাবে খ্রিস্টীয় মতবাদ পৌঁছাতে পারলে প্রকৃত সাফল্য ও সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ পাওয়ার বিশ্বাস হয়ত ছিল। সাত বছর একের পর এক প্রত্যাখাত হওয়ার পর রাণী ইসাবেলা যে তার কথা শুনে রাজী হয়েছিলেন তার পিছনে এই বিশ্বাসের ভূমিকা থাকাও স্বাভাবিক। রাণী ইসাবেলা ও ফার্ডিনান্ড সেই সময় স্পেন তথা ইউরোপে যেকোনো উপায়ে পূর্ণ খ্রিস্টান শাসন কায়েম করার যুদ্ধ চালাচ্ছিলেন। হতে পারে এই ক্ষেত্রে তাদের দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি মিলে গিয়েছিল! কলম্বাসের নিজের বিশ্বাসের ওপর শতভাগ আস্থা ছিল। তাই বলেছিলেন, ‘অভিযানের অনুপ্রেরণা আমি ঈশ্বরের কাছে পেয়েছি এতে কোনো সন্দেহ নেই!’ ১২ অক্টোবর, ১৪৯২ সালে প্রথম বাহামা দ্বীপপুঞ্জের যে দ্বীপে পা রেখেছিলেন তার নাম দিয়েছিলেন সান সালভাদর যার অর্থ ‘পবিত্র ত্রাণকর্তা’। যখনই নতুন ভূখন্ডের দেখা পেতেন সেখানে কাঠের ক্রুশ চিহ্ন পুঁতে দিতেন।
আদিবাসী ও অভিযাত্রীদের মধ্যে ভাষাগত দূরত্ব ছিল। কেউ কারো কথা বুঝত না। কলম্বাস যদিও জার্নালে উল্লেখ করেছেন-নাবিকদের বলা হয়েছিল আদিবাসীদের সাথে ভালোবাসা পূর্ণ আচরণ দেখাতে, জোর জবরদস্তি না করতে! তার মতে আদিবাসীরা এই সাক্ষাতে প্রচুর সন্তুষ্ট ছিল! তবে কলম্বাস নায়কোচিত মানুষ ছিলেন নাকি লোভী আক্রমণকারী ছিলেন এটা বিতর্ক রয়েছে অনেক। হিস্পানিওলাতে যে আদিবাসী গোত্র ছিল টাইনো নামে তাদের সাথেই প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল কলম্বাসের। টাইনোরা সুন্দর গঠন ও মুখশ্রীর বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষ ছিল, স্বেচ্ছায় নাবিকদের সাথে অলংকার, গবাদি পশু বিনিময় করেছিল। তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল না।
এককথায় বলা যায় শান্তিপূর্ণ গোষ্ঠী! তাদের শান্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি কলম্বাসের মনে কোনো সহানুভূতি বা ভালোবাসা উদ্রেক করেছিল বলে মনে হয় না। বরং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন টাইনো দাস হওয়ার উপযুক্ত তাই বন্দী করে দাস বানিয়েছিলেন! তাদের জোর করতেন যাতে সোনা সংগ্রহ করে আনে যারা একটা অংশ কলম্বাসের প্রাপ্য হত। না আনতে পারলে হাত পা কেটে রাখতেন, নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলতেন। তার এই অমানবিক অত্যাচারে আর ইউরোপীয় সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবে মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল এই জনগোষ্ঠী! ১৪৯৯ সালে স্পেনের রাজসভায় কলম্বাসের করা অন্যায় ও দুর্ব্যবহারে খবর পৌঁছায়! বিশেষ করে বিনা বিচারে হত্যাকান্ডের মতো কাজের অভিযোগ আসে। তাকে বন্দী করে শিকলে বেঁধে স্পেনে ফিরিয়ে আনা হয়। কলম্বাস তার বিরুদ্ধে আনীত অনেক অভিযোগ স্বীকার করলে গভর্নর উপাধি কেড়ে নেয়া হয়েছিল। কলম্বাসের শুরু করা গণহত্যা, জাতিবিদ্বেষ, নারী নির্যাতন, সাংস্কৃতিক বিজাতীয়করণ আদিবাসীদের মনের ওপর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ছাপ ফেলেছিল। এসব নির্যাতন সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছিল। এটা এক ধরনের ঐতিহাসিক ট্রমা বা মানসিক আঘাত যার ফলাফল আজো ওইসব আদিবাসী সমাজ বহন করে চলেছে। বেড়ে গিয়েছে হতাশা, পিটিএসডি, মাদকাসক্তি, পারিবারিক কোন্দল প্রভৃতি!
বার্তোলোম ডি লাস কাসাস নামক এক প্রত্যক্ষদর্শী যাজক এই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘স্পেনীয়রা আদিবাসীদের পশু হিসেবেও গণ্য করত না! কারণ পশুদের সাথেও মাঝে মাঝে ভালো ব্যবহার করা হয়!’
সাহস, স্বাধীন চিন্তা শক্তি, সৃষ্টিশীলতা, লেগে থাকার ধৈর্য শক্তি সর্বোপরি ব্যবসায়িক একটা অভিযানে ধর্মীয় বিশ্বাস কেন্দ্রিক অনুপ্রেরণা জোগাড় করতে পারার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার ছিল। আর ছিল সহজাত নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলী ও বিপুল সম্পদ আহরণের সক্ষমতা। ব্যবসায়িক ও আর্থিক বিষয়ে ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ছিলো উঁচুমানের, বড়ো ধরনের পরিকল্পনা ও লক্ষ্য মাথায় রেখে যেকোনো কাজ করতেন। ধর্মীয় ভাবাবেগের পাশাপাশি বস্তুবাদী পৃথিবীকে খুব ভালোভাবে চিনতেন, বড়ো অভিযানের উদ্যোগ কীভাবে সফল করতে হয় সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি অন্যদের অণুপ্রাণিত করতে পারতেন যাতে তার পছন্দের উদ্যোগে তারা অংশ নিত এমনকি যদি সে ব্যাপার সম্পর্কে ভালো জ্ঞান না থাকত তাও। বিচার শক্তিও এই হিসেবে নিখতুঁ ছিল যে লক্ষ্যের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করতে পারে এমন মানুষকেই নির্বাচন করতেন সহকর্মী হিসেবে। আশেপাশের মানুষজন তার ব্যক্তিত্বের সামনে সিদ্ধান্ত ও অনুপ্রেরণার জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়ত। ব্যবসায়িক বুদ্ধির সর্বোচ্চ উৎকর্ষতা দেখিয়েছিলেন স্পেনের রাজা রাণীর সাথে করা চুক্তিতে, যেখানে লেখা ছিল নতুন ভূখন্ড আবিষ্কার হলে কলম্বাস তার গভর্নর হবেন এবং অর্জিত সম্পদের শতকরা দশ ভাগ পাবেন। প্রকৃতপক্ষে এটা নিঃস্বার্থ কোনো নায়কোচিত অভিযান ছিল না বরং সাহসী ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ছিল।
শেষ অভিযান শেষে ১৫০৪ সালে যখন স্পেনে ফিরলেন তখন শরীরের অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না। তিপ্পান্ন বছর বয়সী কলম্বাসের দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে এসেছিল, পায়ে আর্থাইটিসের ব্যথা প্রায় অচল করে ফেলেছিল। অনেকে মনে করেন তিনি হয়ত রিটার্স সিনড্রোমে ভুগছিলেন। রাজা ফার্ডিনান্ড ও রাণী ইসাবেলা তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে তাকে অফিসিয়াল কোনো উপাধি বা দায়িত্ব দিতে অনীহা প্রকাশ করছিলেন। এমনকি চুক্তি মোতাবেক প্রাপ্য সম্পদও পাচ্ছিলেন না। শেষের কয়েক সপ্তাহ চরম মানসিক অস্থিরতায় ভুগেছিলেন। এরই মধ্যে নানা অভিযোগে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছিল! ২০ মে ১৫০৬ সালে এইসব মানসিক অস্থিরতা নিয়ে মারা যান ক্রিস্টোফার কলম্বাস।
ডা. সৌবর্ণ রায় বাধন
রেসিডেন্ট, ফেইজ বি, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৯ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে