করোনাভাইরাস এখনও খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। গত প্রায় পাঁচ মাসে কুড়ি লাখেরও বেশি মানুষ এতে নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত হয়েছে আর মারা গেছে এক লাখ ২৭ হাজারেরও বেশি মানুষ। কিন্তু এর বাইরেও একটা হিসাব আছে এবং সেই হিসাবটা বেশ বড়।
কোন কোন গবেষণায় দেখা গেছে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরও সামান্য কিছু উপসর্গ দেখা দেয় বা রোগীর শরীরে কোন লক্ষণই দেখা যায় না- এরকম মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ। খুব অল্প সংখ্যক মানুষের ক্ষেত্রে এসব উপসর্গ মারাত্মক রূপ নেয় এবং তাদেরকে জরুরি ভিত্ততে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হয়।
উপসর্গগুলো কী কী?
কোন কোন লক্ষণ দেখে বুঝতে পারবো যে আমরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছি? করোনাভাইরাস মানুষের ফুসফুসে আক্রমণ করে। এর পর প্রধানত যে দুটো উপসর্গ দেখা দেয় তা হচ্ছে: জ্বর এবং বিরামহীন শুকনো কাশি।
তো অনেকেই প্রশ্ন করেন শুকনো কাশি কী এবং অন্য কাশি থেকে এটি কীভাবে আলাদা? শুকনো কাশিতে কোন শ্লেষা তৈরি হয় না। অর্থাৎ কাশি দিলে মুখ দিয়ে যে আঠাল তরল পদার্থ বেরিয়ে আসে শুকনো কাশির ক্ষেত্রে সেরকম হয় না। বিরামহীন কাশি বলতে বোঝায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রচুর কাশতে থাকা। এরকম অবস্থা হলে শরীর খুব খারাপ হয়ে যেতে পারে।
এর ফলে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। এটা বোঝা যায় বুকের মধ্যে চাপ অনুভব করা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া অথবা দম বন্ধ হয়ে আসার মতো অনুভূতির মাধ্যমে। শরীরের তাপমাত্রা যদি ৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয় তাহলে বুঝতে হবে আপনার জ্বর হয়েছে। জ্বর হলে আপনার শরীর গরম হয়ে যাবে, শীত শীত লাগবে অথবা শরীরে কাঁপনও ধরতে পারে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে আরো যেসব উপসর্গের কথা জানা যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে:
গলা ব্যথা
মাথা ব্যথা
ডায়রিয়া
গন্ধ না পাওয়া
মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যাওয়া
এসব উপসর্গ দেখা দিতে সাধারণত গড়ে পাঁচ দিনের মতো সময় লাগে। আবার কারো কারো দেহে এসব লক্ষণ দেখা দিতে আরো বেশি সময়ও লাগতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাধারণত ১৪ দিনের মধ্যেই উপসর্গ দেখা দেয়।
কতো মানুষের শরীরে উপসর্গ দেখা যায় না
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, কোভিড-নাইনটিন রোগীদের ৭৮ শতাাংশের দেহে হালকা কিছু উপসর্গ দেখা দেয় অথবা তাদের শরীরে এর কোন উপসর্গই দেখা যায় না।
ইতালির একটি গ্রামে চালানো গবেষণায় দেখা গেছে যে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ লোকের শরীরে কোন লক্ষণ দেখা যায় নি। কিন্তু তারপরেও তাদের মাধ্যমে অন্যদের দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে।
সম্প্রতি আইসল্যান্ডেও একই ধরনের একটি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে যাতে দেখা গেছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ৫০ শতাংশের দেহে এর কোন উপসর্গ পাওয়া যায়নি।
আরেকটি গবেষণা, যেটি চালানো হয়েছে ৫৬ হাজারেরও বেশি রোগীর ওপর, তাতে বলা হয়েছে ৮০ শতাংশের শরীরে সামান্য কিছু উপসর্গ দেখা গেছে যার মধ্যে রয়েছে জ্বর এবং কাশি। কারো কারো নিউমোনিয়াও হতে পারে। বলা হচ্ছে, ১৪ শতাংশের বেলায় উপসর্গ গুরুতর রূপ নিতে পারে। যেমন শ্বাসকষ্ট।
আর ৬ শতাংশ রোগী গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তাদের বেলায় ফুসফুস, কিডনিসহ কিছু জরুরি অঙ্গ অচল হয়ে যেতে পারে। এর ফলে মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
উপসর্গ দেখা দিলে কী করবো?
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষ বিশ্রাম নিলে ও প্যারাসিটামলের মতো ব্যথানাশক ওষুধ খেলে সেরে ওঠে। আপনার জ্বর, কাশি হলে এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ শ্বাসজনিত বা অন্য কোন গুরুতর অসুস্থতা থেকে এসব উপসর্গ দেখা দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আপনাকে আগে থেকেই যোগাযোগ করতে হবে কারণ স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে।
কখন হাসপাতালে যেতে হবে?
লোকজনের হাসপাতালে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে শ্বাসকষ্ট। ডাক্তাররা তখন আপনার ফুসফুস স্ক্যান করে দেখতে পারেন। ফুসফুস কতোটা খারাপভাবে আক্রান্ত হয়েছে সেটা জানার জন্যই তারা এই পরীক্ষা করেন।
আর পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হলে রোগীকে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। আইসিইউ হচ্ছে গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্যে বিশেষ ওয়ার্ড যেখানে অত্যন্ত প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও নার্সরা কাজ করেন।
করোনাভাইরাসের রোগীদের অক্সিজেন দেওয়া হয়। ফেসমাস্ক বা নাক দিয়ে টিউবের সাহায্যে এই অক্সিজেন দেওয়া হতে পারে। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছালে রোগীর প্রয়োজন হয় ভেন্টিলেশনের। এই প্রক্রিয়ায় ভেন্টিলেটর নামক একটি যন্ত্রের সাহায্যে রোগীর ফুসফুসে টিউবের সাহায্যে অক্সিজেন দেওয়া হয়। এই টিউব মুখ কিম্বা নাক দিয়ে অথবা গলার কাছে ছোট্ট একটা ছিদ্র করে ফুসফুসের সাথে সংযুক্ত করা হয়।
কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে?
বয়স্ক ব্যক্তি ও যাদের আগে থেকেই হাঁপানি, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের মতো কিছু অসুস্থতা আছে তাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তারাই মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। এছাড়াও নারীদের তুলনায় পুরুষদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। যাদের শরীরে সামান্য উপসর্গ দেখা দেবে তাদের সুস্থ হয়ে যেতে সময় লাগবে কয়েক দিন বা সপ্তাহ। কিন্তু কেউ যদি হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং তাকে আইসিইউতে নিতে হয়, তাদের পুরোপুরি সেরে উঠতে কয়েক মাসও লেগে যেতে পারে।
কতোটা প্রাণঘাতী?
চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশের মৃত্যু হবে। এই সংখ্যা সাধারণ সর্দি কাশিতে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। সিজনাল বা মৌসুমি সর্দি কাশিতে মৃত্যু হয় আক্রান্তদের শূন্য দশমিক এক শতাংশ। তবে অনেক রোগীর আক্রান্ত হওয়ার খবর জানতে না পারার কারণে মৃত্যুর এই সংখ্যায় তারতম্য হতে পারে।
কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবো?
সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে সাবান ও পানি দিয়ে বেশ ভাল করে বারবার হাত ধোয়া। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশিতে নির্গত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায় করোনাভাইরাস। বাতাস থেকে এই ভাইরাসটি মানুষ গ্রহণ করতে পারে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে। অথবা যেসব জায়গায় ড্রপলেট পড়বে সেখানে স্পর্শ করার পর এই ভাইরাস চোখ, নাক ও মুখ দিয়েও ঢুকে পড়তে পারে।
তাই টিস্যু দিয়ে ঢেকে হাঁচি কাশি দিতে হবে। জরুরি হচ্ছে হাত না ধুয়ে মুখমণ্ডল না ধরা এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে না যাওয়া। উপসর্গ আছে এরকম অসুস্থ ব্যক্তিই সবচেয়ে বেশি সংক্রামক। তবে কেউ কেউ অসুস্থ হওয়ার আগেও ভাইরাসটি ছড়াতে পারেন।ফেসমাস্ক ব্যবহারে কতোটা কাজ হয় সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। তাই এর ফলাফল গবেষণা করে দেখছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সূত্র: বিবিসি