আত্মহত্যা প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন

আত্মহত্যা প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন

বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন করে মানুষ আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশে প্রতিদিন ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। যারা আত্মহত্যা করে তারা চলে যায় পরপারে। আর তাদের স্বজনরা দুর্বিষহ যাতনা নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত শোক বহন করে। কষ্ট আর যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকে। মানব জীবনের এই এক মর্মান্তিক অধ্যায়। এই অধ্যায় থেকে বের হতে হলে মানুষকে সচেতন হতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

কী করব? কীভাবে মোকাবেলা করব এ ‍দুর্বিনীত আত্মহত্যা প্রবণতা?
যখন কেউ আত্মহত্যা করতে চায়, তখনও তার আরেক মন বাঁচতে চায়, হাত বাড়াতে চায় সহজ সাহায্যের জন্য। তখন তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। সঠিক সময়ে সহযোগিতা পেলে একজন আত্মহত্যা পরিকল্পনাকারী আবার ফেরত আসতে পারে স্বাভাবিক জীবনে। প্রয়োজন সর্বোচ্চ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা। প্রয়োজন সর্বোচ্চ সাইকিয়াট্রিক সার্ভিস। একজন বিষণ্ণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড়ো প্রয়োজন সাহায্য। সহযোগিতা। একটি নির্ভরতার হাত, যে-হাত তাকে সাহস যোগাবে, আগলে রাখবে সকল বিপদ থেকে।

জনগোষ্ঠীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আসুন বাড়িয়ে দিই তেমন একটি হাত, যে হাতের অপর নাম নির্ভরতা। এই নিভর্রতা ভালোবাসারও অপর নাম।

আমাদের চারপাশে যারা মনের দিক থেকে মরে যাচ্ছে, তাদের দিকে তাকাতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঘরের মেঝেতে তেলাপোকা-টিকটিকি মরে পড়ে থাকলে আমরা দেখতে পাই, কিন্তু নির্মম সত্য হচ্ছে, মানুষের মন মরে থাকলে আমরা দেখতে পাই না। দেখার জন্য চোখ খুলতে হবে। স্বজনদের মুখের দিকে তাকাতে হবে। বিষাদের ঘোরে কেউ ডুবে যাচ্ছে কিনা বুঝতে হবে। নিজেকে গুটিয়ে ফেলছে কিনা বুঝতে হবে। সামাজিকভাবে নিজেকে আড়াল করে ফেলছে কিনা, বুঝতে হবে। আগে গান গাইত, আগে বাইরে যেত, আগে বই পড়ত, হইচই করত, এখন কিছুই করে না-এই যে তার ব্যাপক পরিবর্তন, বুঝতে হবে। আমরা যদি বুঝতে পারি তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় আমরা বিষণ্ণ মানুষকে চিনতে পারব। আর বিষণ্ণতা ‍বুঝতে পারলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। তাকে সর্বোচ্চ মানসিক চিকিৎসার জন্য উদ্বুদ্ধ করব। এ কাজে সবচেয়ে বড়ো বাধা হচ্ছে কুসংস্কার, অন্ধত্ব, অজ্ঞতা-এসব নেতিবাচক অনুষঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

কারো মানসিক সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসার জন্য এগোতে হবে। লুকিয়ে রাখা যাবে না। লুকিয়ে রাখলে ধ্বংস অনিবার্য। এর বিকল্প নেই।

একজন মানুষকে কীভাবে সাহায্য করব?
বিষণ্ণ মানুষ যেন সাহায্য চাইতে পারে সেজন্য তাকে উদ্বুদ্ধ করব। ঘরে ঘরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাড়ায়-মহল্লায় কর্মক্ষেত্র এবং রাজনৈতিক পরিবেশে বিষণ্ণতা বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি ‍দূর করতে হবে বিষণ্ণতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কুসংস্কার। নতুন আলোয় জাগিয়ে তুলতে হবে জনগণকে। প্রচারণা চালাতে হবে।

প্রচারণার মূল বিষয় হওয়া উচিত বিষণ্ণতা নিয়ে কথা বলা। যতই আমরা কথা বলব, ততই আমাদের চোখের আড়ালে যে সুন্দর মনটা মরে যায়, তাকে ধরতে পারব। তাকে সহযোগিতা করতে পারব। এটাই হোক আমাদের মানবিক দায়িত্ব।

মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে
বর্তমান সরকার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আর তা হলো মানসিক স্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। আগামী পাঁচবছরে স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে অটিজম, ডিপ্রেশন, সুইসাইড প্রতিরোধ, বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। বিশেষায়িত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা-জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, মানসিক হাসপাতাল, পাবনা; সরকারি মেডিক্যাল কলেজসমূহ, আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ-সর্বক্ষেত্রে মানসিক সেবা খাতকে উন্নত করার প্রক্রিয়া চলছে।

কাউন্সিলিং সেবা উন্নত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিলিং এন্ড এডুকেশনাল সাইকোলজি, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, ক্লিনিক্যাল সোশ্যালওয়ার্ক, সবাই কিছু না কিছ ভুমিকা রাখছে।

আমরা বিশ্বাস করি সবার সম্মিলিত প্রয়াস মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে উন্নত করবে। আর তা হলে আমরা আত্মহত্যার মতো নির্মম ঘটনা মোকাবেলা করার শক্তি অর্জন করব।

একজন বিষণ্ণ মানুষের দিকে তাকালে আমরা শুধু তার মুখখানি দেখতে পাই। আমরা ভাবতে পারি না বিষাদ মাখা সেই হাসির আড়ালে কতটা কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে একজন মানুষ। যখন মানুষ বিষাদের ভেতর দিয়ে যায়, পুরোটা মন জুড়ে লুকিয়ে রাখে না-জানা কারণে সুতীব্র মনোবেদনা। জগতের সকল কিছর প্রতি তীব্র বিষাদ, সকল কাজের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলা, নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভাবতে শুরু করা, নিজের ভেতরটাকে শূন্য ভাবা, প্রচন্ড দুশ্চিন্তা, আশাহীন হয়ে যাওয়া, একাকী পথ চলা, সবার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া-এসব কিছুর মাঝেই একজন মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে। তাকে আবার ফেরত আনতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন যথাযথ জ্ঞান নেওয়া এবং তার পাশে দাঁড়ানো।

আমরা লক্ষ করি, বাংলাদেশ জার্নাল অব সাইকিয়াট্রির একটি সংখ্যায় প্রকাশিত মৌলিক রিপোর্ট থেকে জানা যায় আত্মহত্যাকারীদের ৬৫.০৪% মানসিক রোগে ভুগছিল। এদের মধ্যে ৭০% ছিল গুরুতর বিষণ্ণতার রোগী। পুরুষের তুলনায় নারীদের হার ছিল বেশি। সুতরাং এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে বিষণ্ণ রোগীদের মুক্তি দিতে হলে মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে। আত্মহত্যার পেছনে যে কুসংস্কার আছে, তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির পাশে দাঁড়াতে হবে আত্মহত্যার পরিকল্পনা পর্বেই। আত্মহত্যা করে ফেললে তার জন্য আহাজারি আর সমবেদনা জানানোর সুযোগ থাকে না।

কেউ আত্মহত্যা করলে তার স্বজনদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমরা লক্ষ করি একজন আত্মহত্যাকারীর জন্য ১৩৫ জন জীবন-যন্ত্রণা ভোগ করে এবং প্রতিবছর এর হার ১০৮ মিলিয়ন মানুষ যন্ত্রণা পেয়ে থাকে। এটি সমাজে বড়ো ধরনের বোঝা হিসেবে কাজ করে। আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হবে স্বজনদেরও সুরক্ষা করতে হবে।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

 

Previous articleইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডার: রাগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার রোগ
Next articleসেইরাত, এইরাত! সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. রাইসুল ইসলাম এর কবিতা
অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল
প্রাক্তন পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here