অ্যালকোহল অপব্যবহার কী?
যে বিশেষ অবস্থায় একজন এলোপাথাড়ি মদ্যপান করতে থাকে, তাকেই অ্যালকোহল অ্যাবিউস বা অপব্যবহার বলে ধরা হয়। সেই ব্যক্তি ওই বিশেষ অবস্থায় নিজের শারীরিক, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জেনেও বেরিয়ে আসতে পারে না। যে ব্যক্তি মদ্যপানের মাত্রা আয়ত্তে রাখতে পারে না, বিশেষত একবার শুরু করলে আর থামতেই পারে না, তাকেই অ্যালকোহলের শিকার বলা হয়।
হিসেব মতো ভারতে ৩০ শতাংশ পুরুষ ও ৫ শতাংশ মহিলা নিয়মিত মদ্যপান করে থাকে। অধিকাংশ কমবয়সি, যারা কৌতূহলবশত বা নানাবিধ চাপে পড়ে মদ্যপান শুরু করে, তারা পরবর্তীকালে এতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ১৯৮০-র দশকে ভারতে প্রথম অ্যালকোহলের স্বাদ গ্রহণের বয়স ছিল গড়ে ২৮ বছর। বর্তমানে গড় বয়স দাঁড়িয়েছে ১৭ বছর।
বিয়ার বাদে ওয়াইন ও সমতুল্য অ্যালকোহল সমৃদ্ধ পানীয় মূলত শহরাঞ্চলে চালু। এর বাইরে গ্রামাঞ্চলে তাড়ি, আরক বা দারু নামে প্রচলিত, দেশি মদও পাওয়া যায়। এগুলিতে ইথাইল অ্যালকোহল থাকে, যে রাসায়নিকটি সহজে মেজাজ পরিবর্তনে সক্ষম। একইসঙ্গে মানব শরীরে আরও নানাভাবে ক্রিয়া করে। প্রতিটি মদ্যজাতীয় পানীয়ে ইথাইল অ্যালকোহল বিভিন্ন মাত্রায় শতাংশের হিসাবে মেশানো হয়।
শরীরে অ্যালকোহল প্রবেশ করা মাত্রই রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। মাত্র একবার নিলেই যা শরীরে দু ঘন্টা ক্রিয়া করে। সচরাচর এর ফলে মানুষকে স্বচ্ছন্দ ও সুখী করে তোলে। ক্রমশ এর ক্রিয়া বাড়তে থাকলে গ্রাহক দ্বিধাগ্রস্ত ও আচ্ছন্ন হয়ে যায়। অ্যালকোহল মনের জোর বা প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে অসহযোগী করে তোলে, সর্বোপরি দৈহিক কামপ্রবণতা বাড়িয়ে দেয়, বিশেষ করে সঙ্গমের সময়।
অ্যালকোহলে আসক্তি মস্তিষ্ক ও শরীরের ক্ষেত্রে নিয়মিত বেড়ে ওঠা এক ধরনের অসুস্থতা, যা আক্রান্ত ব্যক্তির সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রেও বিশেষ প্রভাব ফেলে।
‘মদে চুর হওয়া’ বিষয়টি কী?
সাধারণত মানুষের শরীরে একমাত্রার একটি পানীয় পরিপাক হতে এক ঘন্টা সময় লাগে। যখন কোনও ব্যক্তি সেই ক্ষমতার থেকেও বেশি পান করে, তখন অ্যালকোহল বেশি মাত্রায় সারা শরীরে সঞ্চারিত হয়। ফলে মদ্যপ ব্যক্তি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, অসহযোগিতা প্রকাশ পায় এবং শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
অ্যালকোহল কীভাবে মানুষের শরীরে ক্রিয়া করে?
মস্তিষ্কের যে অংশ কথা বলা, স্বাভাবিক ক্রিয়াকর্ম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে ক্রিয়াশীল, অ্যালকোহল প্রধানত সেই অংশেই প্রভাব বিস্তার করে। যে ব্যক্তি শুধুমাত্র কোনও নির্দিষ্ট উপলক্ষে পান করে তার ক্ষেত্রেই ব্রেন সময়ের সঙ্গে মদের প্রভাব কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক ক্রিয়াশীল অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। বস্তুত, অ্যালকোহল আসক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সময়ের অভাবে মস্তিষ্ক সেই সক্রিয়তা রক্ষা করতে পারে না, যাতে স্বাভাবিকভাবে কাজ করা সম্ভব।
দীর্ঘদিন অ্যালকোহল ব্যবহারের ফলে যা হতে পারে –
অ্যালকোহল অ্যাডিকশন এর ফলে বিস্মৃতি, মানসিক অবসাদ, অল্পে বিরক্তি বা মেজাজ হারানো, হাইপারটেনশন, গর্ভপাত, ক্যানসারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি, ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ে, লিভারের ক্ষতি হয়, মস্তিষ্কের টিসু ক্ষয়, হার্টের পেশি দুর্বল হয়ে অ্যারিথমিয়া ও স্ট্রোকের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। হজমের সমস্যা, স্বাভাবিক কামক্রিয়ায় বাধা, বয়সের তুলনায় বৃদ্ধ লাগে, বুদ্ধিবৃত্তিগত ক্রিয়া কমে যায়।
উপরোক্ত জৈব পরিবর্তনের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অ্যালকোহলের ক্রিয়া যথেষ্ট ক্ষতিকর। ভারতে ঘরোয়া হিংসা এবং পথ দুর্ঘটনার বেশিরভাগই ঘটে থাকে মাত্রাছাড়া অ্যালকোহল গ্রহণের কারণে।
অ্যালকোহল অ্যাডিকশনের কারণ –
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-এর হিসেবমতো মদ্যপদের মধ্যে পান করার জন্য গুরুতর অজুহাত গড়ে ওঠে।
- যারা মদ্যপান করে না, তাঁদের তুলনায় একজন নিয়মিত মদ্যপায়ী তিন গুণ বেশি তাৎপর্যপূর্ণ শারীরিক সমস্যায় ভুগে থাকে।
- ভারতে প্রতি পাঁচজনের একজন অ্যালকোহল গ্রহণের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়।
- হাসপাতালে ভর্তি প্রতি পাঁচজনের একজন ট্রমাটিক ব্রেন ইনজুরির শিকার এবং দুই তৃতীয়াংশ অন্যান্য আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি অ্যালকোহল আসক্ত।
- অ্যালকোহল ব্যবহারকারী ব্যক্তিরা অন্যদের তুলনায় বেশি হিংসামূলক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষত তাদের সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে। হিংসার চরিত্র নানা প্রকার হয়, যেমন শারীরিক, কামবাসনা সংক্রান্ত, আবেগজনিত বা অর্থনৈতিক।
মাত্রাছাড়া মদ্যপান কী?
অনেকের ধারণা নিয়মিত মদ্যপান নানারকম শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে। লাগামছাড়া মদ্যপান স্মৃতিহ্রাস, টক্সিসিটি এবং অ্যালকোহলের বিষক্রিয়ার কারণ, যাতে মৃত্যুও হতে পারে।
পুরুষের ক্ষেত্রে পাঁচ ইউনিট অ্যালকোহল বা পাঁচটি ছোট গ্লাসের মাপে ওয়াইন একেবারে দুঘন্টার মধ্যে পান করাকে বিন্জ ড্রিঙ্কিং বলে, মেয়েদের ক্ষেত্রে মাত্রাটা চার। বিন্জ ড্রিঙ্কার বেহেড হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে দ্রুত পান করে থাকে। তারা সাধারণত আসক্ত বা অ্যালকোহল নির্ভর হয় না, অ্যালকোহল ছাড়াও স্বাভাবিক কাজকর্ম করে। বেহেড অবস্থায় প্রত্যেকটি মাত্রার সঙ্গে মদ্যপের শরীরে অ্যালকোহলের ক্রিয়া বেড়ে চলে।
অ্যালকোহলের মাত্রা বেড়ে গিয়ে শ্বাসরোধকারী অবস্থা সৃষ্টি করে। বিষয়টি আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে বমি হয়ে যায়। মাত্রাছাড়া মদ্যপান মদ্যপায়ীর মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে এলোমেলো করে দিয়ে অস্বাভাবিক কামতাড়িত বা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার করতে উৎসাহিত করে।
দীর্ঘদিনের বিন্জ ড্রিঙ্ককিং বা অতিরিক্ত মদ্যপান ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। ফলে উদ্বেগ, অবসাদ ও মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি হয়।
মদ্যাসক্তি চিহ্নিতকরণ –
বহু মানুষই সামাজিক অনুষ্ঠানে নিজেকে একটা বা দুটো পানীয়ের সীমায় বেঁধে রাখে। কখনই মদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে না। কিন্তু যারা আসক্ত তারা কোনও ভাবেই টের পায় না, নিজেরা অ্যালকোহলের উপর ঠিক কতটা নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে কিন্তু সতর্কীকরণ লক্ষণ থেকে যে কেউ বুঝতে পারবে, সে নিজে বা কোনও নিকটজনের আসক্তির মাত্রা কতটা। কোনও মাদকাসক্ত ব্যক্তি অবশ্যই টের পাবে, তার গ্রহণ ক্ষমতা ক্রমশ বাড়ছে। সদর্থে বলা যায়, যে ব্যক্তি দুটি মাত্রার পরই যথেষ্ট তুরীয় অবস্থায় পৌঁছয় তার ঠিক ওই অবস্থায় পৌঁছতে পাঁচ থেকে ছটি মাত্রার দরকার পড়ছে।
উইথড্র্য়াল সিম্পটম, বিশেষত শারীরিক লক্ষণ থেকে আসক্তির বাস্তব আস্থা টের পাওয়া যায়। আসক্ত ব্যক্তির মদ্যপান বন্ধ হলে নানা রকমের শারীরিক ও মানসিক আস্বস্তি চোখে পড়ে। যেমন অযথা ঘামতে থাকা, নার্ভাসনেস, হঠাৎ কেঁপে ওঠা, বমিভাব বা অস্বস্তি। এই লক্ষণগুলি নজরে আসামাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন।
অ্যালকোহল অ্যাডিকশন এর চিকিৎসা –
একাধিক পরীক্ষার সাহায্যে কোনও ব্যক্তি মদ্যাসক্ত কি না তা জানা যায়। কয়েকটা যে কেউ নিজে থেকে করতে পারে, বাকিগুলি কোনও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে করা উচিত। নিজেকে পরীক্ষা করার সহজতম পদ্ধতি কেজ (সিএজিই) টেস্ট। এটি চারটি প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে তৈরি।
১) কখনও কি মনে হয়েছে, মদ্যপানের মাত্রা কমানো দরকার?
২) যখন কেউ কোনও মদ্যপের সমালোচনা করে, তখন মদ্যপ ব্যক্তি কি উত্তেজিত বা অত্যন্ত বিরক্ত হয়?
৩) কখনও কি নিজের মদ্যপ্রীতি নিয়ে নিজেকে অপরাধী মনে হয় বা বিষয়টি খারাপ লাগে?
৪) সকালে ঘুম ভেঙে এক পেগ মদ বা অ্যালকোহল না খেলে কি নার্ভ চাঙ্গা হয় না বা আড়ষ্টতা কাটে না?
উপরের প্রশ্নগুলির দুটি বা তার বেশির উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয় তা হলে সেই মদ্যপ ব্যক্তিকে আসক্ত বলে চিহ্নিত করে পেশাদারের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
অডিট টেস্টের মাধ্যমেও অ্যালকোহলিক সমস্যার সমাধান হতে পারে। অ্যালকোহল অ্যাডিকশন কাটিয়ে ওঠার প্রথম শর্তই হল, আসক্তিকে একটা নির্দিষ্ট সমস্যা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া। এই বিষয়ে কোনও বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। ডাক্তার আসক্ত ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটি বিশদে বুঝে নিতে পারবেন। সেই সঙ্গে সমস্যার গভীরতা আন্দাজ করতেও সক্ষম হবেন। ডাক্তার মনে করলে মদ্যপের বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলতে পারেন। আসক্তির মাত্রার বিষয়ে এই সমস্তই তাকে সঠিক চিকিৎসার পরিকল্পনা করায় সহায়তা দেবে।
মদ্যাসক্তিত চিকিৎসায় মূলত দুটি লক্ষ্য থাকেঃ প্রথমত, আসক্ত ব্যক্তির জীবন যাপনে অ্যালকোহলের ব্যবহার বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত ওই মানুষটিকে বিশেষ সহায়তা দিয়ে পরবর্তী দিনগুলি অ্যালকোহল ছাড়া কাটাতে সাহায্য করা।
চিকিৎসা শুরু হয় ডিটক্সিফিকেশন পদ্ধতিতে। যার মেয়াদ এক সপ্তাহ বা তার বেশি হতে পারে। এক সময় রোগী অবশ্যই মদ্যপান বন্ধ রাখবে। ফলে উইড্রয়াল সিম্পটমের সম্ভাবনা থাকে। যে কারণে ওষুধ দেওয়া হয়। এই সময়ে আসক্ত ব্যক্তি শারীরিক দিক থেকে অ্যাডিকশন কাটিয়ে উঠতে থাকে। যখন রোগীকে ক্রমশ অ্যাডিকশনের চরিত্র ও ক্ষতিকর দিকগুলি সম্বন্ধে সচেতন করে তোলা হয়। সেই সঙ্গে সুস্থ হয়ে ওঠার বিষয়টিও বোঝানো যায়। সেই সময়ে কাউন্সেলর বা মনোচিকিৎসক রোগীর আবেগের বিষয়গুলি স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করেন, যেগুলি থেকে মদ্যাসক্তি গড়ে উঠেছিল। এইভাবেই চিকিৎসা চলে। রোগীকে আসক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে নেশার কুফল বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিতে হয়।
সম্মিলিত থেরাপির সাহায্যে রোগীদের কাছে নিজেদের অসুবিধাগুলি আলোচনা করে সারিয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়। কী ধরনের মানসিক অবস্থায় পড়ে তারা আসক্ত হয়েছিল তা আলোচনার মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতায় অ্যালকোহল বিরোধী লড়াইয়ের মানসিকতা গড়ে ওঠে এবং আগেকার ব্যবহার পরিবর্তনে একাধিক মানুষ সচেষ্ট হয়। এই পর্বের শেষে রোগী নতুন করে নেশার কবলে পড়ার লক্ষণগুলি নিজেই চিহ্নিত করতে পারে এবং অস্বাভাবিকতা কাটানোর ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে সচেতন হয়ে ওঠে, যা একটা শিক্ষা পর্ব। এতে রোগীর পরিবার ও বন্ধুরাও সমস্যাটির বিষয়ে যথেষ্ট শিক্ষা লাভ করে এবং গ্রুপ মিটিং-এর মাধ্যমে সাহায্যকারী হিসেবে নিজেদের ভূমিকা ও গুরুত্ব বুঝতে সক্ষম হয়।
চিকিৎসার তৃতীয় এবং চূড়ান্ত পর্বে রয়েছে রোগীকে স্বাভাবিক জীবন যাপনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য তার গতিবিধির বিষয়ে সজাগ থাকা। রোগীকেও অন্যান্য রোগীদের সহায়তার জন্য নিয়মিত গ্রুপ মিটিং-এ যোগ দেওয়াকে কর্তব্য হিসেবে জানতে হবে।