রাগে শরীরের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। একটি গল্পের মাধ্যমেই তুলে ধরা হলো। শুক্রবার দিনটা যেন বাজারেই অফিস রহমান সাহেবের। সপ্তাহে এই একটা দিনই ছুটি, তাই পুরো সপ্তাহের বাজারটা একসঙ্গেই করে রাখতে হয়। বেশি সদস্যের পরিবার হওয়ায় অল্প কিছু কিনেই চলে আসবেন সে উপায় নেই। তার ওপর আজকে মাসের প্রথম সপ্তাহ, তাই মাসকাবারী বাজারটা নিয়েই ফিরলেন রহমান সাহেব।
কিন্তু লিফটে উঠতে গিয়েই বিপত্তি। দারোয়ান জানাল, এত ওজন নিয়ে লিফটে ওঠা যাবে না। ভাগে ভাগে নিয়ে যাবেন বলাতেও নারাজি দারোয়ান। প্রথমে তেমন কিছু মনে না হলেও দারোয়ান যখন বলল, ফ্ল্যাট বাড়ি সমিতির সভাপতির আদেশ কোনো ভাড়াটিয়া বেশি ওজন নিয়ে উঠতে পারবে নাÑতখনই কেমন জানি অস্বস্তিকর অনুভূতি হতে থাকল রহমান সাহেবের মনে।
রহমান সাহেব বুঝতে পারলেন তার ভেতরে রাগ জন্ম নিচ্ছে। চেষ্টা করলেন তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে। কিন্তু দারোয়ান যখন কড়া ভঙ্গিতে সিড়ি দিয়ে উঠতে বলল, আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। হঠাৎ করেই যেন মাথায় রক্ত চড়ে গেল, ফর্সা মুখটা টকটকে লাল হয়ে গেল, দাঁতে দাঁতে কিড়মিড় শব্দ, হাত মষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল।
চিৎকার করে বকা দিতে চাইছিলেন তিনি, কিন্তু রাগে মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না তার। সারা শরীর রাগে থরথর করে কাপতে দেখে দারোয়ান ভয় পেয়ে গেল। ভাড়াটিয়াদের ওপর এরকম ফাপর দালালি সে একটু আধটু করেই এবং দেখে এসেছে ভাড়াটিয়াগুলো এতে ভয়ই পায়।
এই প্রথম দারোয়ান ভয় পেয়ে দুঃখ প্রকাশ করে রহমান সাহেবের ভাগে ভাগে নেয়ার প্রস্তাবটাকে সমর্থন জানাল। কিন্তু রহমান সাহেব শুধু দারোয়ানের ঠোঁট নাড়াই দেখছিলেন, কোনো কথা কানে ঢুকছিল না। হঠাৎই রহমানের সাহেবের চারপাশ অন্ধকার হয়ে এল, পড়ে গেলেন তিনি মেঝেতে।
চোখ খুলে রহমান সাহেব নিজেকে হাসপাতালের কেবিনে দেখতে পেলেন। পাশে বসা মেয়ে জানাল, পড়ে যাওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ডাক্তার বলেছেন ভয়ের কিছু নেই, টেস্ট রিপোর্ট স্বাভাবিক আসলে বিকালের দিকেই বাসায় যেতে পারবেন তিনি।
রহমান সাহেব ভাবতে লাগলেন কীভাবে কী হলো। ভাবতে ভাবতেই আবার দারোয়ানের ওপর রাগ ফিরে আসতে লাগল। এই বদমায়েশের জন্যই এই ঘটনা, আর মাঝখান থেকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে এতগুলা টাকা গচ্চা দেয়া। রাগটা ধীরে ধীরে বাড়ছে, রহমান সাহেবের বাধা দেয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও।
এমন সময়েই তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডা. আজগর সাহেব দেখা করতে এলেন। হালকা মেজাজের কথাবার্তা থেকে শুরু করে গভীর আলোচনা সবই চলে দুই বন্ধুতে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে রহমান সাহেব বললেন, কেন যে অকারণে রাগ করতে গেলাম বন্ধ, কী একটা সমস্যা হয়ে গেল!
দেখ রাগ হচ্ছে কী আসলে আমাদের পরিবেশে যদি কোনো অবাঞ্ছিত চাপ আসে তার একটা প্রতিক্রিয়া। ধর, তুমি মনে করলে যে কোনো একটা কিছু তোমার ক্ষতি করতে পারে, তখন তোমার মনে কেমন লাগবে?
আজগর সাহেব বললেন দুশ্চিন্তা হবে বা ভয় ভয় লাগবে। হ্যা, ঠিক তেমনই তুমি যখন কোনো চাপের মুখোমুখি হবে, যেমন ধরোÑকোনো একটা দ্বন্দ্ব, অবিচার, অপমান, বিশ্বাসভঙ্গ প্রভৃতি এবং এই চাপটাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে না বা মনে মনে ধরে নাও যে এটা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না; তখনই তোমার মধ্যে আগ্রাসনের জন্ম নিবে। আর রাগ হচ্ছে এই আগ্রাসনের একটা ধরন।
কিন্তু রাগ থেকে অজ্ঞান হয়ে যাব কেন? এর সাথে ব্রেনের সম্পর্ক কী? এই ধরনের চাপ আসলে মস্তিষ্কের একটা অংশকে, যাদের একত্রে বলে লিম্বিক সিস্টেম, সেখানে আলোড়ন তোলে। এমিগডালা নামক একটি অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে, যেটা শেষ পর্যন্ত হাইপোথ্যালামাসকে উত্তেজিত করে।
হাইপোথ্যালামাস সক্রিয় হলে সে শরীরের মধ্যে হয় যুদ্ধ করো নয় পালাও এই ধরনের একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে। মানে আমাদের সচেতনতা আর প্রতিক্রিয়াকে বাড়িয়ে তোলে। এটা করে আসলে এড্রেনালিন, কর্টিসল নামের হরমোন নিঃসরণ বাড়িয়ে দিয়ে, আর তাদের প্রভাবে হৃদস্পন্দন, শিরার গতি, শ্বাসের গতি বেড়ে যায়।
সারা শরীর থেকে রক্ত মস্তিষ্কের দিকে যায়, রক্তে গ্লোকোজের মাত্রা বাড়ে, মাংসপেশির টান বেড়ে গিয়ে পুরো শরীর একেবারে যুদ্ধংদেহী অবস্থানে চলে যায়। আবার সেরোটনিন নামক কেমিক্যাল কম থাকলেও এটা ঘটে। যেমন- বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তার সময়ে মানুষ খুব দ্রুত বিরক্ত হয়, রাগ করে।
এগুলো থেকেই কি ক্ষতি হয়? ধরো এগুলার জন্য শরীরের মাংসপেশি শক্ত হয়ে গেল, এখান থেকে তোমার মাথাব্যথা, অনিদ্রা এসব হতে পারে। ধরো, তোমার হৃদস্পন্দন অনেক বেড়ে গেল বা রক্তচাপ হঠাৎ করে তীব্র হয়ে গেল। শরীর তো এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তখন অজ্ঞান হয়ে যেতে পার।
এমনকি স্ট্রোক হতে পারে, হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। দেখা গেছে, যারা বেশি বেশি রাগ করে তাদের মধ্যে এইসব মস্তিষ্কের বা হৃদযন্ত্রের অসুখ বেশি হয়। এছাড়াও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমার কারণে বাড়তে পারে সর্দিকাশির আক্রমণ, অ্যাজমা, চর্মরোগ, বাত-ব্যথা প্রভতি।
কিন্তু কত ঘটনাই তো ঘটে, সবসময় তো রাগি না আমরা। তাহলে, এটা কীভাবে হয়? কারণ অগ্রমস্তিষ্ক অর্থাৎ প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স এমিগডালার এই প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। যদি অগ্রমস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই এমিগডালার প্রতিক্রিয়া দ্রুত ঘটে যায়, তখন রাগটা প্রকাশ পায়।
আহ, এমিগডালাটা না থাকলেই হয়ত আর রাগ হতো না। তাতে সমস্যাও আছে কিছু। একবার এক মহিলার মৃগী রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য করল কী এমিগডালা ফেলে দেয়া হলো। তার খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে আসলো বটে, কিন্তু দেখা গেল সে আর অন্যের রাগ করার বিষয়টা ধরতে পারে না।
হ্যা এটা তো সমস্যাই। আমার রাগ কমে যাবে, কিন্তু অন্যদের রাগ তখন বেড়ে যাবে। হা হা হা। মজার কথা কী জানো, বলা হয় রাগ আসলে মানুষের মনের এক ধরনের প্রাথমিক স্তরের বা আদিম প্রতিরক্ষা কৌশল। তাই, রাগ হওয়া দোষের না।
এটা আবার কী ধরনের কথা বললে? হ্যা। আসলেই রাগ হওয়া দোষের না, তবে সেটার প্রকাশভঙ্গি কেমন হবে সেটা ঠিক করতে হবে। সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। ধরো, মহাত্মা গান্ধীকে যদি রেলের কামরা থেকে নামিয়ে না দিত আর উনার অপমানিত বোধ না হতো, রাগ না হতো, তাহলে কি এত বড় আন্দোলন হতো? উনি কি মহাত্মা হতে পারতেন যদি এই রাগটাকে এভাবে একটা আন্দোলনে রূপ না দিতেন?
এভাবে খেয়াল করলে দেখবে, পথিবীতে যত অন্যায়ের প্রতিবাদ হয়েছে তা আসলে মানুষের রাগের কারণেই হয়েছে। তবে সেই রাগ নিয়ন্ত্রণে এনে সুনির্দিষ্ট প্রদ্ধতিতে এগুলেই তা পথিবীকে ধ্বংস না করে সুন্দর করে তোলে, সাম্য তৈরি করে।
রহমান সাহেব ফোড়ন কাটেন আমি তো ছোট মানুষ, দারোয়ানের সাথে রাগ করি। সেটা নিয়ন্ত্রণ করে এসব সভ্যতা, পথিবী, সাম্য বড় বড় বিষয়ের কী আসবে যাবে?
আজগর সাহেব উত্তর দেন আর কিছু না হোক, আবার হাসপাতালে ভর্তিটা তো অন্তত ঠেকাতে পারবে। বন্ধুর রসিকতায় রহমান সাহেব হেসে উঠলেন, রাগ ভুলে গেলেন মনের আনন্দে।
ডা. পঞ্চানন আচার্য্য
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ