কবির সাহেব আজ অফিসে অস্থির সময় পার করছেন। তাকে আজ দ্রুত হাতের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে হবে। মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে যাবেন তিনি। মনে ভয় ও সংশয়। কেন ও কিসের ভয় আর কেনই বা সংশয়? তার মেয়েটি অসুস্থ। রোগটি যে শারীরিক নয়, মানসিক, আর সেটাই তার দুশ্চিন্তার কারণ। লোক জানাজানি হবার ভয়, সেই সঙ্গে আদৌ রোগটি ভালো হবে কিনা সেই চিন্তায় তিনি পাগল প্রায়।
রোগের শুরুতে ধরেই নিয়েছিলেন, হয়ত জিন-ভূতের আছর। তাইতো হুজুরের পানি পড়া নিতে ছুটে গেছেন নানা জায়গায়। কাজ না হওয়ায় ছুটে গেছেন কবিরাজের কাছেও। কিন্তু ফল শূন্য। শেষ পর্যন্ত একজন নিকটাত্মীয়ের পরামর্শে মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
এতোদিন নীরবে আর গোপনে চলছিল ফকির আর কবিরাজি চিকিৎসা। কিন্তু এখন আর তাকে কোনো ভাবেই সামলানো যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত অনেকটা বাধ্য হয়েই মানসিক চিকিৎসকের ̄সরণাপন্ন হতে হচ্ছে। আগেও যেতে পারতেন কিন্তু যাননি। যদি পাড়া-প্রতিবেশী জেনে যায় তবে যে রক্ষা নেই! বাড়ির বাইরে বের হলেই শুনতে হবে নানা বিশেষণ। তাছাড়া তার যে আরও ছেলে-মেয়ে রয়েছে! তাদের বিয়ে দিতেও যে মুশকিলে পড়তে হবে। এতোসব ভাবতে গিয়ে আজ তাই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
এই চিত্র শুধু কবির সাহেবের ক্ষেত্রেই নয়, পুরো দেশের চিত্রই এমন। শিক্ষিত, অশিক্ষিত প্রায় সবারই একই অবস্থা। এ অবস্থ্যার জন্য কম বেশি আমরা সবাই দায়ী। আমাদের সমাজব্যবস্থা, সচেতনতার অভাব, সরকারি উদাসীনতা, এমনকি আমরা চিকিৎসকেরাও এর জন্য কম দায়ী নই।
এই বিংশ শতাব্দিতে বিজ্ঞানের উৎকর্সের যুগে এসে আজও আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় রয়ে গেছে ভ্রান্ত ধারণা। কেউ কেউ মনে করে এটা জিন-ভূতের আছর। কেউ বা মনে করে খারাপ বাতাসের ফল। আবার কেউ কেউ মনে করে মাথার স্ক্রু বোধ হয় ঢিলে হয়ে গেছে। তারা মনে করে এর চিকিৎসা করে কোনো লাভ নেই; এ রোগ ভালো হবার নয়।
কয়েকজন মানসিক চিকিৎসক, আর জনা কয়েক সাইকোলজিস্টের পদচারণাই শুধু দেখতে পাওয়া যায় মানসিক রোগের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু এ বিষয়ে দায় কি শুধু চিকিৎসকদের ? নাকি সবার অংশগ্রহণই পারে একজন মানসিক রোগীকে স্বাবাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। এ ক্ষেত্রে মিডিয়াও বড় ভূমিকা পালন করে।
অনেকেই মানসিক রোগীকে পাগল বলে থাকেন। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না তারা পাগল না। অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও মানসিক রোগীদের পাগল বলেন। এমনকি চিকিৎসকদের অনেকে মানসিক রোগের ডাক্তারকে ‘পাগলের ডাক্তার’ বলে থাকেন। শুধু তাই নয় মানসিক রোগের চিকিৎসক হতেও তারা খুব বেশি আগ্রহ দেখান না।
বর্তমানে মাত্র ৪ ভাগ চিকিৎসক মানসিক রোগে প্রশিক্ষণরত। দেশে বর্তমানে ০.৪ ভাগ মানসিক চিকিৎসক রয়েছেন অর্থাৎ প্রতি ১ মিলিয়ন লোকের জন্য মাত্র ১ জন মানসিক চিকিৎসক রয়েছেন! যেখানে উন্নত বিশ্ব যেমন-যুক্তরাষ্ট্রে মানসিক চিকিৎসক রয়েছেন ৫.৪ ভাগ।
মানসিক চিকিৎসার সরকারি পদক্ষেপ খুবই অপ্রতুল। সরকার যেখানে স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলছে, সেখানে মানসিক সেবার সরকারি ব্যায় ০.৫ ভাগেরও কম। অথচ দিন দিন মানসিক রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
বিশ্বে প্রায় ৪০ মিলিয়ন লোক মানসিক সমস্যায় ভোগে। যেখানে বাংলাদেশে ২০০৩-২০০৫ সালের তথ্যমতে দেখা যায় প্রাপ্তবয়স্ক রোগীর ১৬.০৫ ভাগ মানসিক রোগী। ২০১৫ এর ফেব্রুয়ারিতে আইসিডিডিআরবির এক প্রতিবেদনে দেখা যায় সারা বিশ্বে মানসিক রোগীর চাপ প্রায় ২৩ ভাগ। প্রাপ্ত বয়স্ক রোগীর ক্ষেত্রে রোগের প্রাদুর্ভাব ৬.৫-৩১ ভাগ, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যা ১৩.৪-২২.৯ ভাগ।
২০১২ সালের এনআইএইচএমআর এর তথ্যমতে মানসিক বহির্বিভাগে পুরুষ রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৮.৭ ভাগ, মহিলা রোগীর সংখ্যা যা ৩৫ ভাগ এবং বাচ্চা রোগীর সংখ্যা ৬.৩ ভাগ। এর মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকই হাসপাতালে ভর্তি হন।
যারা ভর্তিযোগ্য তাদের জন্য রয়েছে হাসপাতালে বেডের স্বল্পতা। বাংলাদেশে এক লাখ মানুষের জন্য বেডের সংখ্যা ০.৫৮। মানসিক রোগীদের জন্য নেই কোনো সুনির্দিষ্ট মেন্টাল অ্যাক্ট, নেই কোনো
মানসিক স্বাস্থ্য বীমা, এমনকি নেই কোনো হিউম্যান রাইটস্, রিভিউ বডি। যাদের কাজ হচ্ছে মানসিক রোগীদের সুযোগ সুবিধা দেখা।
বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনেকগুলোরই পর্যাপ্ত বেড নেই, নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক। কয়েকটিতে শুধু বহির্ভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বেশিরভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানসিক চিকিৎসকের কোনো পদও নেই। অতিথি শিক্ষক দিয়ে কাজ চালানো হয়।
যে হারে বাড়ছে মানসিক রোগী সে হারে বাড়ছে না সরকারি সুযোগ সুবিধা। একজন মানসিক রোগী একটি পরিবারে নিয়ে আসে অপরিসীম দুর্ভোগ। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন, সচেতনতা বৃদ্ধিতে মিডিয়ার ভূমিকা, সরকারি পদক্ষেপ সর্বোপরি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই দুর্ভোগ কমাতে।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।