মাদকাসক্তি কি একটি রোগ?
ক্রিয়া-বিক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিচারে মাদকদ্রব্য হচ্ছে রাসায়নিক পদার্থ। আর মস্তিষ্কও রসায়নের এক বিস্ময়কর কারখানা। এখানে চলে জীবনের সুশৃঙ্খল কর্মযজ্ঞ। মাদক যে-পথেই শরীরে ঢুকুক না কেন তা রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায় মস্তিষ্কে। ব্যাহত করে ব্রেনের স্বাভাবিক কাজ। দীর্ঘ ব্যবহারে কোষের গ্রাহকযন্ত্রের শারীরবৃৃত্তীয় কাজও বদলে যায়।
যেমন : ইয়াবা ব্যবহারে ‘মগজ’ শুকিয়ে সংকুচিত হয়ে যেতে পারে, পুরো মস্তিষ্ক আকারে ছোট হয়ে যেতে পারে। এমনকি জেনেটিক উপাদানসমূহ, মেসেঞ্জার ‘আরএনএ’-এর মধ্যে উত্তেজক মাদকের ‘উপজাত’-এর প্রতিলিপি বসে গিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে মাদকের ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে। এসব পরিবর্তনে ক্ষতির শিকার হয় দেহ-মন, আচরণ। এখানে মাদকদ্রব্য হচ্ছে একটি এজেন্ট (Agent) বা ঘটক। আর মাদকাসক্তি হচ্ছে মাদকদ্রব্যের ওপর দৈহিক ও মানসিক নির্ভরশীলতা। মাদকদ্রব্য ব্যবহারে ব্যক্তি তাৎক্ষণিক আনন্দ বা তৃপ্তি লাভ করে, ফুরফুরে ভাব তৈরি হয় তার মনে। এই মজাই শেষ নয়। ক্রমে তৃপ্তির আড়ালে ক্ষতির পাহাড় জেগে ওঠে। নেশাগ্রহণকারীর দেহ-মনের ক্ষতির পাশাপাশি সংকট তৈরি হয় সামাজিকতায়, আত্মিক ও মূল্যবোধে।
মাদক গ্রহণ থেকে বিরত থাকলেও দৈহিক যাতনা বাড়ে, কষ্ট বাড়ে তার। এ যাতনা দূর করতে পুনঃপুন মাদক নিতে বাধ্য হয়, আসক্ত হয়ে পড়ে সে। বারবার গ্রহণের ফলে আগের মাত্রা আর তৃপ্তি দিতে পারে না, মাত্রা বাড়াতে হয়, মাদক গ্রহণের সময়কালও বাড়াতে হয়। কিংবা অন্য মাদকদ্রব্যের দিকে ছুটতে হয়। ফলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিভিন্ন সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা মাদকসেবী হচ্ছে আশ্রয়দাতা। আর মাদকদ্রব্য হচ্ছে এজেন্ট। এসব দ্রব্য ব্যক্তির দেহমনে ভর করে, আশ্রয় নেয় এবং বিক্রিয়া ঘটায়, তৈরি করে আসক্তি।
মাদকাসক্তির ক্ষেত্রে এজেন্ট (মাদকদ্রব্য) ব্যক্তির দেহমনে ভর করে, আশ্রয় নেয় এবং বিক্রিয়া ঘটায়, তৈরি করে আসক্তি। চারপাশের সহায়ক পরিবেশ ব্যক্তিকে আসক্ত হওয়ার পথে ঠেলে দেয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে রোগতত্ত্বের মূল ফ্রেম Agent-Host I Environment-এর মিথস্ক্রিয়া ঘটছে আসক্তির ক্ষেত্রে। এ কারণে বলা যায়, মাদকাসক্তি একটি রোগ। কিন্তু সাধারণ মানুষের ধারণা ভিন্ন। অনেকে মনে করেন, মাদকাসক্তি একটি সামাজিক সমস্যা; কেউ কেউ মনে করেন এটি অপরাধ, শাস্তিই প্রধান চিকিৎসা। কেউ একধাপ এগিয়ে মনে করেন-এটি বদঅভ্যাস, ইচ্ছে করলে ছাড়তে পারে, নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে ধিক্কারই তাদের প্রাপ্য। না, এ ধারণা ঠিক নয়। এটি একটি রোগ। এ রোগের চিকিৎসায় বৈজ্ঞানিক পথ গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত।
কেন গ্রহণ করতে হবে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা?
কারণ দীর্ঘমেয়াদি মাদকের প্রভাবে ক্ষতির পাহাড় গেড়ে বসে ব্যক্তির দেহ-মনে, সার্বিক জীবনে, সামাজিকতায়, মূল্যবোধে। মাদকে একবার জড়িয়ে গেলে রেহাই পাওয়া কঠিন। এখন আমরা দেখব কী কী ক্ষতি হয়, ক্ষতির কারণে কীভাবে মাদকাসক্তজনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও কর্মজীবন ব্যাহত হয়, কীভাবে কর্মঘণ্টার অপচয় ঘটে, দেখব কীভাবে টিনএজ কিংবা তরুণদের শিক্ষাজীবন ছারখার হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, ঘুমের ওষুধ, পেথেডিন ইত্যাদি ব্যবহারের ক্ষতি রোগীর জীবনে বিরাট ধস নামিয়ে দেয়।এই ক্ষতির চারটি গ্রুপ করা যায় :
দৈহিক ক্ষতি
- চোখ : চোখের মণি সংকুচিত হয়ে যেতে পারে, দেখার ক্ষমতা লোপ পেতে পারে।
- ফুসফুস : শ্বাসযন্ত্রে নানা রোগের আক্রমণ ঘটতে পারে। যেমন-ফুসফুসে ক্যান্সার, যক্ষা, ব্রংকাইটিস ইত্যাদি রোগ হতে পারে। ক্ষীণ হয়ে যেতে পারে শ্বাসপ্রশ্বাস। ফুসফুসে পানিও জমতে পারে।
- হার্ট : বুকের ঢিবঢিব বা হৃৎস্পন্দন মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে বা কমে যেতে পারে। হৃৎপিন্ডের কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। হার্ট বড় হয়ে যেতে পারে, কার্ডিয়াক অ্যারেস্টও হতে পারে।
- রক্তকণিকা : রক্তকণিকার সমস্যার কারণে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতায় ধস নামতে পারে। যে-কোনো সহজ কারণে ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- লিভার : লিভারের সমস্যা যেমন-জন্ডিস, হেপাটাইটিস ‘বি’, সিরোসিস এমনকি ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে।
- পরিপাকতন্ত্র : পরিপাকতন্ত্রের সমস্যার মধ্যে খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া, হজমে সমস্যা, এসিডিটি, আলসার, কোষ্ঠকাঠিন্য এমনকি আমাশয়ভাব থাকতে পারে।
- প্রজননতন্ত্র এবং যৌনক্ষমতা : প্রাথমিকভাবে যৌন ইচ্ছে একটু বাড়তে পারে, কিন্তু পারফরমেন্স বা দক্ষতা বাড়ে না, পরবর্তী সময়ে ইচ্ছেও লোপ পেতে থাকে। বীর্যে কমে যেতে পারে শুক্রকীটের পরিমাণ, তৈরি হতে পারে বিকলাঙ্গ শুক্রকীট। ফলে সন্তান জন্মদানে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যেতে পরে, কিংবা বিকলাঙ্গ, প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ছাড়াও যৌন রোগ যেমন- সিফিলিস, মারাত্মক এইডসের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
- ত্বক : অপরিচ্ছন্নতার কারণে খোস-পাঁচড়া, চুলকানি, বিভিন্ন ছত্রাকজনিত রোগ হতে পারে। সুই ব্যবহারকারীদের ত্বকে ঘা, ফোঁড়া বা রক্তবাহী নালীতে প্রদাহ কিংবা ইনফেকশন হতে পারে।
মনের ক্ষতি
মাদকের প্রভাবে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয় মস্তিষ্কের ক্ষমতা। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানসিক প্রক্রিয়া যেমন : প্রত্যক্ষণ, আবেগ, চিন্তা, প্রেষণা, স্মরণশক্তি ইত্যাদি। আচরণে ফুটে ওঠে অস্বাভাবিকতা। ছাত্রছাত্রীরা অমনোযোগী হয়ে যেতে পারে, অমনোযোগিতার কারণে স্মৃতির ভিতও দুর্বল হয়ে যেতে পারে। মেজাজ চড়া থাকতে পারে, অস্থিরতায় ডুবে গিয়ে পড়াশোনা ও কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেলতে পারে। উদ্যমের অভাবে তারা অলসতায় কাবু হয়ে যেতে পারে। মনের প্রধান একটি স্তম্ভ আবেগ নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে উগ্র মেজাজের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ডিপ্রেশন কিংবা ম্যানিয়ার মতো মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে, অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার হতে পারে।
প্রত্যক্ষণ ও চিন্তায় জট তৈরি হওয়ার কারণে সিজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক রোগও দেখা দিতে পারে।
আসক্তদের আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়ে যায়, এমনকি ব্যক্তিত্বেরও বিপর্যয় ঘটে। তারা হিংস্র হয়ে যায়, পাষন্ড, নির্মম-নিষ্ঠুর হয়ে খুন করতে পারে আপন সন্তান ও স্ত্রীকে। এমনকি মা-বাবাকেও। পারিবারিক সহিংসতার একটা বড় কারণ মাদক। তারা সন্দেহপ্রবণ হয়ে যেতে পারে। সন্দেহের কারণে খুনোখুনি করতেও দ্বিধাবোধ করে না। সামাজিক ক্ষতি বিপর্যয় নেমে আসে নেশাখোরদের সামাজিক জীবনে। পারিবারিক শান্তি হারিয়ে যায়। মায়া-মমতা-ভালোবাসা পুড়ে যাওয়ার কারণে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, ছোটদের প্রতি আদর, কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। বিবাহিত জীবনের মূল অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
তবে এদের বাইরের ঝকমারি খোলস অনেক সময় বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে মোহগ্রস্ত করে। পুড়ে ছারখার করে দেয় প্রেমিক-প্রেমিকার জীবন। নেশাসক্তদের কারণে সামাজিক নিরাপত্তার বিপর্যয় ঘটে। এই নিরাপত্তাহীনতা সাধারণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার একটি বড় কারণ। আসক্তির কারণে রোগী বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, দাওয়াতে যায় না কিংবা ঘরে মেহমান এলে তার কোনো ভাবান্তর ঘটে না। সবাইকে এড়িয়ে চলে। তবে আসক্তদের সাহচর্যে ভালো থাকে সে। তাদের মাঝেই সময় কাটাতে উদগ্রীব থাকে। নতুন বন্ধুসার্কেল গড়ে তোলে। নেশাখোররা সহজে ঢুকে যায় অপরাধ জগতে। মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে, ক্রমে নিরপরাধ যুবসমাজকে বাগে এনে এরা দলে ভেড়ায়।
আত্মিক ক্ষতি
মাদকাসক্তের নৈতিক মূল্যবোধ সমূলে উৎপাটিত হয়ে যায়, একাকার হয়ে যায় ন্যায়-অন্যায় বোধ। অনবরত মিথ্যা বলে, অন্যায় আচরণের জন্যে অনুশোচনায় ভোগে না। তাদের মনে তীব্র হতাশা কাজ করে। ধর্মে বিশ্বাস থাকলেও হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারে না বলেই মাদকাসক্ত ব্যক্তির অন্তরে বিরাট শূন্যতা বিরাজ করে। আধ্যাত্মিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যায় তারা। মাদকাসক্তি শুরুর আগের মানুষ এবং পরের মানুষের মধ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়, যেন নিজের মধ্যে জেগে ওঠে অন্য ধরনের এক দানব। সহজ করে বলা যায় মাদকাসক্তের মস্তিষ্ক এক রাসায়নিক বোমায় পরিণত হয়। মানববোমা হয়ে তারা পরিবারে সমাজে ঘুরে বেড়ায়। এই বোমা বহনকারী দানব-মানুষ পারে না হেন অপরাধ নেই জগতে। এ কারণে মাদকাসক্তি চিকিৎসায় আত্মিক উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলার ব্যবস্থা নেয়া হয় বিশ্বব্যাপী।
কর্মক্ষেত্রে বিপর্যয়
চাকরিতে মনোযোগ দিতে পারে না, ঠিকমতো অফিসে যায় না মাদকসেবী। নানা অনিয়মের কারণে সে চাকরিচ্যুত হয়, অধিকাংশের কর্মজীবনই পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায়। চাকরিও পায় না, তাদের টানও থাকে না কর্মজীবনের প্রতি।
মানসিক রোগের শ্রেণিবিন্যাসে মাদকাসক্তি
উল্লিখিত কারণ ছাড়া আরো বহু কারণে ‘আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন’ কর্তৃক প্রণীত ‘ডায়াগনোস্টিক অ্যান্ড স্টাটিসটিক্যাল ম্যানুয়েল অব মেন্টাল ডিজঅর্ডারস’ (ডিএসএম-৫) ও ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ’ (আইসিডি-১০) রোগের শ্রেণিবিন্যাসদ্বয়ে মাদকাসক্তিকে মানসিক রোগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ড্রাগ অ্যাবিউজ (এনআইডিএ, ইউএসএ)-এর বিশেষজ্ঞ দল সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, মাদকাসক্তি হচ্ছে একটি Chronic Relapsing Brain Disease। জাতিসংঘের মহাসচিবও বলেছেন-‘এটি কোনো অপরাধ নয়, এটি রোগ, স্বাস্থ্যগত সমস্যা।’
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ১ম বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত।