অনেক কথা যাও যে ব’লে
কোনো কথা না বলি।
তোমার ভাষা বোঝার আশা
দিয়েছি জলাঞ্জলি।
যুগে যুগে কবি সাহিত্যিকরা নানাভাবে মানব মনের আবেগকে তাদের কবিতায়, গল্পে, সাহিত্যে ছন্দের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। আর এই মনের আবেগকে তুলে ধরার অন্যতম মাধ্যম হলো ‘ভাষা’। উপরে উদৃত রবি ঠাকুরের চয়নগুলো আমাদেরকে ঠিক তেমনই একটি ধারনা দিয়েছেন। তাহলে জানা যাক কথা, ভাষা, যোগাযোগ কি? একে অপরের সাথে সম্পৃক্ততা কি? এবং মানব জীবনের গুরুত্ব কতটুকু?
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব বা আশরাফুল মাখলুকাত। কারন, সামাজিকতা সম্পূর্ণ করার জন্য একমাত্র মানুষই পারে তার নেতিবাচক আবেগ গুলোকে সংযত রেখে ইতিবাচক আবেগ গুলোকে ভাষার মাধ্যমে দৈনন্দিন কর্মপ্রবাহে প্রকাশ করতে। আর যখনই সামাজিকতা সম্পূর্ণ করতে হয়, তখন যে কোন মানুষকেই আরেকজন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হয়। হতে পারে এই যোগাযোগ মানুষের সঙ্গে মানুষের, গোষ্ঠি থেকে গোষ্ঠির অথবা রাষ্ট্র সাথে রাষ্ট্রের কিংবা কখনো সারা বিশ্বের সঙ্গে।
যোগাযোগ সামাজিকতার একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহনকারী দুই অংশের মধ্যে প্রতিনিয়তই প্রতিবেশ বা পরিবেশ অনুযায়ী মনের আবেগ আদান প্রদান হয়ে থাকে। যার প্রধান মাধ্যমই হচ্ছে ভাষা। ভাষার নানা মাত্রিক রূপ পরিলক্ষিত হয়, যেমন- বাচনিক/কথা এবং অবাচনিক রূপ, এই দুটি রূপকে আমরা প্রতিবেশ বা পরিবেশ অনুযায়ী প্রয়োগ করে থাকি। তবে সাম্প্রতিক গবেষনার ফলাফলে ভাষাবিদরা মনে করেন, যোগাযোগকর্মে বাচনিকতার চেয়ে অবাচনিক রূপের প্রয়োগই বেশি হয়ে থাকে।
সুতরাং যখন কোন মানুষ সামাজিকতার সম্পন্ন করতে গিয়ে মনের আবেগ প্রকাশে বাচনিকতা/কথা এবং অবাচনিকতার প্রয়োগ প্রতিবেশ বা পরিবেশ অনুযায়ী করতে না পারে, তখনই তৈরী হয় যোগাযোগ বৈকল্য।
যেমন: যোগাযোগ বৈকল্যের ব্যাক্তিগত পর্যায়ে একটি উদাহরন দেওয়া যায়।
আমার এক রোগীনি এসে বলল, আমার স্বামী দীর্ঘদিন যাবত আমাকে এড়িয়ে চলছে এবং আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে, সে কি অন্য মেয়ের প্রতি আসক্ত কিনা? আমি আমার রুগীনিকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার স্বামী, আপনার সাথে কি রকম খারাপ ব্যবহার করছে? তখন তিনি বললেন- আমি যখন আমার স্বামীর সাথে কথা বলতে চাই, তখন বেশির ভাগ সময়ই সে ভ্র কুচকে থাকে, আমার দিকে তাকায় না, আমার হাতটা তার গায়ে বা কাধে রাখলে সরিয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘদিন যাবৎ এই অবস্থা চলছে। পরবর্তীতে দেখা গেছে আসলে দুজনেই দুজনকে ভালোবাসেন তৃতীয় পক্ষের কোন প্রভাব নেই। শুধুই মনের আবেগ প্রকাশে ভাষাগত অসঙ্গতি। স্বামী চাচ্ছেন স্ত্রীর সঙ্গ কিন্তু স্ত্রীর সাথে আবেগন মুহুর্তে তার অবাচনিক ভাষার বহিঃপ্রকাশ (যেমন- চোখে চোখে না তাকানো, ভ্রু কুচকানো, গা থেকে হাত সরিয়ে দেয়া) ছিলো নেতিবাচক, শুধু তাই নয় যখন তিনি তার স্ত্রীর সাথে বাচনিক উপায়ে যোগাযোগ করে তখন সুর এবং স্বরের ব্যবহার (যেমন: রেগে রেগে উত্তর দেয়া) ছিলো নেতিবাচক।
ফলশ্রুতিতে স্বামী এবং স্ত্রী দুজনের মধ্যেই যোগাযোগ ব্যহত হয়ে তৈরী হয়েছে স্বামীর সম্পর্কে স্ত্রীর নেতিবাচক ধারনা। সুতরাং যোগাযোগ স্থাপনে ভাষার প্রয়োগ এবং ব্যবহার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। হতে হবে প্রতিবেশ এবং পরিবেশ অনুযায়ী সামঞ্জস্যপূর্ন, পরিচ্ছন্ন, মার্জিত এবং অর্থবহ। আর যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে শুধু ব্যাক্তিগত পর্যায়ে নয় পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তৈরী হতে পারে যোগাযোগ বৈকল্য, যা আমাদের কারোই কাম্য নয়।
সুতরাং একজন চিকিৎসা ভাষাবিদ এবং মনরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি মনে করি প্রতিদিন আমাদের কথোপকথনে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপানে ভাষা ব্যবহার এবং প্রয়োগে আমাদের সচেতন হওয়াটা খুবই জরুরী।