আমাদের দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী অস্বাভাবিক আচরণের প্রতিকার বা প্রতিরোধ হিসেবে বিয়েকে মোক্ষম সমাধান হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ের বিবাহ পরবর্তী অস্বাভাবিক আচরণকে শ্বশুরবাড়ীর অশোভন আচরণের ফল হিসেবে দেখা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে, রোগীর পরিবার আসল তথ্য গোপন করে মানসিকভাবে অসুস্থ ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে দেন। তালাক বা ডিভোর্সের মাধ্যমে পরবর্তীতে পুরো পরিস্থিতি আরো জটিল রূপ ধারণ করে।
মজার কথা হলো, অস্বাভাবিকভাবে বিয়ের জন্য বায়না ধরাও মনোরোগের (ম্যানিয়া) একটি উপসর্গ। জটিল মানসিক রোগের কারণে এ ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ হতে পারে এমন তথ্য আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আদৌ জানা নেই। অনেক সময় ব্যক্তির অস্বাভাবিক আচরণ সময় বা প্রেক্ষাপট দিয়ে ব্যাখ্যা করা গেলেও রোগীর স্বজনেরা সেটা বিবেচনায় না নিয়ে মানসিক রোগী বলেও ভ্রম করেন। তখন তারা পানি পড়া, তেল মালিশ, ঝাঁটাপেটা ইত্যাদি স্থানীয় অপচিকিৎসার দ্বারস্থ হন। পরবর্তীতে দীর্ঘ ও ব্যর্থ চিকিৎসার পর মনোরোগবিদ বা মনোরোগবিদ্যা বিভাগের বর্হিবিভাগ বা অন্তর্বিভাগের শরণাপন্ন হন।
মানব জীবনে মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী যে যে ক্ষেত্র বা বিষয় রয়েছে, “বিয়ে” তন্মধ্যে অন্যতম। তবে বিয়ের কারণেই যে মানসিক রোগের সৃষ্টি হয় এমন কোনো প্রমাণ বইপত্রে নেই। মানসিক রোগ উদ্ভবের ক্ষেত্রে বিয়ে প্রভাবক মাত্র। অর্থাৎ আগে থেকেই যে ব্যক্তি মানসিক রোগের ঝুঁকিতে থাকেন, বিয়ে সেক্ষেত্রে রোগ ত্বরান্বিত করতে পারে মাত্র। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, কোনো ঝুঁকি না থাকা স্বত্ত্বেও ব্যক্তি বিয়ের পর মানসিক রোগাক্রান্ত হতে পারেন। অন্যদিকে ব্যক্তির অস্বাভাবিক বা অসংযত আচরণ যে নববিবাহিত স্ত্রী বা স্বামীর স্পর্শে ঠিক হয়ে যাবে এমন কোনো বিজ্ঞান নির্ভর তথ্য নেই।
শারীরিক রোগীদের সাধারণত আচরণগত কোনো সমস্যা দেখা যায় না। কিন্তু মনোরোগের বাহ্যিক প্রকাশই হলো মানুষের অস্বাভাবিক আচরণ। যা সচরাচর ঐ সমাজের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম দর্শন বা প্রচলিত কাঠামো দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আর আদিকাল হতে পৃথিবীতে অস্বাভাবিক আচরণ বা মানসিক রোগ সম্পর্কিত নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। তাই একজন ব্যক্তি তার স্বজন শারীরিক রোগাক্রান্ত বলতে যতটুকুন স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন মানসিক রোগাক্রান্ত বলতে ততটা স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন না। প্রতিটি মুহুর্তে অব্যক্ত এক অস্বস্তি বুকে চেপে কালাতিপাত করেন রোগীর আত্মীয় স্বজনেরা।
মানসিক রোগের সাথে বিয়ের সংশ্লিষ্টতা কি সে বিতর্কে না গিয়ে বরং সবার উচিত নিকটস্থ মানসিক স্বাস্থ্য কর্মীর (মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনস্তত্ত্ববিদ) পরামর্শ নেয়া। অবিবাহিত রোগীদের ক্ষেত্রে বিয়ের প্রাক্কালে দুই পক্ষের আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে পরবর্তিতে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস বা সংশয় থাকে না ও দু’পক্ষই রোগীর আরোগ্যের জন্যে এক সাথে কাজ করতে পারেন। রোগ লুকিয়ে আপাত দৃষ্টিতে বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলেও পরবর্তিতে সেই সচেতন চাতুর্য্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। আমাদের দেশে বিয়ের অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন সম্মানিত কাজী। মুসলিম ধর্মীয় রীতি অনুসারে পুরো বিষয়টির সার্বিক সম্পাদনা কাজী সাহেবের উপরই ন্যস্ত থাকে। প্রাসঙ্গিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্য বা রোগ সম্পর্কিত প্রাথমিক ধারণা থাকা তাই কাজীদের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক রোগীদের বিয়ে রোধ করা নয় বরং বিয়ের আগে বা পরে রোগ শুশ্রূষা যাতে আরো সমন্বিত হয়, সেই প্রয়াসেই কাজীরা দুপক্ষের মাঝখানে সেতু হয়ে কাজ করতে পারেন। বাল্য বিবাহ ও কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খুব অল্প বয়সে বিয়ের বোঝা অপরিপক্ক মনোজগতে রোগ উদ্ভবের ঝুঁকি বাড়ায়।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা আমাদের দেশে কেন্দ্রের তুলনায় প্রান্তে অত্যন্ত অপ্রতুল। সত্যি কথা বলতে শূন্যের কোঠায়। দেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তাই কমিউনিটি স্তরে একটি নির্দিষ্ট কাঠামো থাকা বাঞ্চনীয়। পাশ্চত্যের নানান বিজ্ঞ পরামর্শ নয় বরং এ অঞ্চলের বাস্তবতায় সাদামাটা কিন্তু কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া তাই সময়ের দাবী।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।