বার্ধক্য জীবনের শেষ পর্যায়ের স্বাভাবিক পালাবদল। সাধারণত চল্লিশোর্ধ্ব বয়স থেকে শরীরের ক্ষতিপূরণের ক্ষমতা কমতে থাকে। ধীরে ধীরে ক্ষতিপূরণের অভাবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে স্থায়ী পরিবর্তন চলে আসে। এ পরিবর্তনের নাম বার্ধক্য।
আমাদের দেশে প্রবীণদের বয়সসীমা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। তবে ৬০ বা তার ঊর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিকে সাধারণত প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। অবশ্য ৬০ বছর বয়সের আগেই বুড়িয়ে যান বেশিরভাগ মানুষ। এই বয়সের মানুষের কিছু রোগ রয়েছে, যা থেকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করতে গিয়ে অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং বিভিন্ন প্রকার মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। ৬০ বৎসর বয়সের ঊর্ধ্বে ১৫% মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বার্ধক্যজনিত অক্ষমতার কারণগুলোর মাঝে ৬.৬% মানসিক এবং স্নায়ুবিক কারণে হয়ে থাকে। ২০১৫-৫০ সালের মধ্যে ৬০ বৎসর এর বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা হবে দ্বিগুণ (অর্থাৎ, বর্তমানে আছে ১২%, তা বেড়ে হবে ২২%)।
বার্ধক্যে মানসিক রোগের কারণ
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সার্বিক কর্মক্ষমতা লোপ পেতে থাকে। চুলে পাক ধরে, দাঁত পড়ে, ত্বকে ভাঁজ পড়ে, হাড় ক্ষয় হতে থাকে, প্রজনন ক্ষমতা থাকে না বা কমতে থাকে। কর্মজীবন থেকে অবসরে যায়। সন্তানরা বড় হয়, তাদের নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়, অনেক সময় জীবিকা অর্জনের জন্য দূরে চলে যায় বা কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ে ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বৃদ্ধ হলে আত্মবিশ্বাস কমে যায়, একাকীত্বের অনুভূতি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি করে।
মধ্যবয়স থেকেই মানুষ জীবনের হিসাব নিকাশের খাতা খুলে বসে। কি পেলাম, কি পেলাম না এসব ভেবে ভেবে অস্থির থাকে। এতে করে মানসিক চাপ তৈরি হয়। বয়স বাড়লে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, বিভিন্ন প্রকার দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ ও হাড়ক্ষয়রোগ ইত্যাদি দেখা দেয়।
যেহেতু মন আর শরীর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তাই একটি খারাপ থাকলে অন্যটিও খারাপ থাকে। যেমন হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে বিষণ্ণতার হার শারীরিকভাবে সুস্থ ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি। আবার যাদের হৃদরোগ ও বিষণ্ণতা রোগ আছে তারা যদি বিষণ্ণতা রোগ এর চিকিৎসা না নেন, তাহলে তা হৃদরোগের পরিণতিকে খারাপের দিকে নিয়ে যাবে। দ্রুত নগরায়ন, ভৌগোলিক পরিবর্তন, শিল্পায়ন, সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্যের প্রভাব, যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গঠন ইত্যাদি বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বার্ধক্যজনিত মানসিক রোগের মাঝে বিষণ্ণতা রোগ, উদ্বেগজনিত রোগ, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগ, দেরিতে শুরু হওয়া সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার বা দ্বি-প্রান্তিক আবেগীয় রোগ, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বার্ধক্যে মানসিক রোগের সতর্কতামূলক লক্ষণ
টানা হতাশা, বিষণ্ণতায় ভোগা, ইতিবাচক আবেগ অনুভব না করা, অতিরিক্ত ঘুমানোর অথবা ঘুম না হওয়ার সমস্যা থাকা, আত্মঘাতী চিন্তা করা, ক্ষুধা, শক্তি স্তর এবং মেজাজে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, মনোযোগে সমস্যা হওয়া, অস্থির থাকা।
অতিরিক্ত চাপ বা উদ্বেগ অনুভূতি তৈরি হওয়া, স্বল্পমেয়াদি-সাম্প্রতিক স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া বা লোপ পাওয়া, রাগ, আন্দোলন বা আগ্রাসন বৃদ্ধি পাওয়া, অবাধ্যতামূলক আচরণ প্রবণতা বা করা, অস্বাভাবিক আচরণ বা চিন্তা করা।
স্থায়ী পাচক সমস্যা, শরীরের ব্যথা বা মাথাব্যথা যার সুনির্দিষ্ট শারীরিক রোগের কারণে হচ্ছে বলে প্রমাণ করা যায় না/ব্যাখ্যা করা যায় না- এমন লক্ষণ দেখা দেয়া।
বার্ধক্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে করণীয়
বার্ধক্যে পৌঁছানো মানুষদের সেবা-শুশ্রূষার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসকদের মানসম্মত প্রশিক্ষণ প্রদান। বয়সজনিত দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও শারীরিক রোগ, মাদকাসক্তি ইত্যাদির সুব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। বয়সবান্ধব সেবা এবং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। বয়স্কদের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। মানসিক ও শারীরিক রোগ দ্রুত শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা প্রদান অপরিহার্য। মনোসামাজিক সহায়তা, কাউন্সেলিং এবং ওষুধ এর সমন্বয়ে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে।
যেহেতু বার্ধক্যে ডিমেনশিয়া সম্পূর্ণ ভালো করার কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি, সেহেতু ডিমেনশিয়া রোগী এবং তাদের পরিচর্যাকারীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। বৃদ্ধদের নির্যাতন বন্ধে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা।
কমিউনিটিতে বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা। বয়স্কদের মাঝে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ শনাক্তকরণ এবং তার ব্যবস্থাপনা করা। বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবার সদ্ব্যবহার করা। কারণ, যদিও আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সীমিত ব্যবস্থাপনা রয়েছে, যতটুকু রয়েছে তার ও পুরোটা ব্যবহৃত হয় না অসচেতনতা, অজ্ঞতা আর কুসংস্কার এর কারণে।
বার্ধক্যে মানসিক স্বাস্থ্য এবং সার্বিক সুস্থতা ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা গুরুত্বপূর্ণ অন্যবয়সে। তাই, যদি কারও পরিবারের বয়স্ক সদস্যের মাঝে মানসিক রোগের উপসর্গ দেখা দেয়, তবে যত দ্রুত সম্ভব প্রাথমিক চিকিৎসক অথবা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত, রোগ গুরুতর হওয়ার আগেই সম্ভাব্য মানসিক রোগ নিরূপণ ও সুষ্ঠু চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করা উচিত।