পড়াশোনার মনোযোগ কেড়ে নেয় যে আসক্তি

দরজায় নক না করেই রনির রুমে ঢোকেন রোমানা জামান। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া রনি কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে চোখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে, মা, তোমাকে না বলেছি নক না করে রুমে ঢুকবে না! ছেলের উদ্ধত ভঙ্গি দেখে রুম থেকে বেরিয়ে যান রোমানা জামান। দরজা লাগিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কতক্ষণ। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। হতাশা জাগে নিজের মনে। বুঝতে পারেন, দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে রনি।

বাবার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। ছোট বোনকেও আদর করে না। ছোটখাটো বিষয়ে বকাঝকা করে। গায়ে হাতও তোলে। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকে কম্পিউটারের সামনে। অথবা স্মার্ট ফোন নিয়ে ডুবে থাকে। পড়াশোনার খবর রাখে না। খাওয়াদাওয়া করে না নিয়মমতো। গোসলও করতে চায় না। ইন্টারনেট ছাড়া কিছু বুঝতে চায় না। আনন্দ ইন্টারনেটে। সব ধরনের চাহিদা ইন্টারনেট ঘিরে। আগ্রহের পুরোটা দখল করে আছে ইন্টারনেট। সবার মধ্যে থেকেও আলাদা জগৎ তৈরি করে নিয়েছে সে।

ছেলের রুম থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন রোমানা জামান। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, রাত প্রায় তিনটে। কখন ঘুমাবে রনি? কখন উঠবে ঘুম থেকে? কখন যাবে স্কুলে? ভাবতে গিয়ে গুলিয়ে যায় মাথা। নিজের চোখের ঘুম চলে যায়। কানের মধ্যে শোঁ শোঁ আওয়াজ টের পেতে লাগলেন তিনি।

রনির মনোবিশ্লেষণ
কী ঘটেছে রনির? এত চিন্তিত কেন মা? বিশ্বজুড়ে বর্তমান প্রজন্মের টিনএজ ও তরুণদের মধ্যে ‘ইন্টারনেট অ্যাডিকশন’ ছড়িয়ে পড়ছে ব্যাপক ভাবে। বড়রাও এ আগ্রাসন থেকে মুক্ত নয়। ইনফরমেশন টেকনোলজির এ যুগে বিজ্ঞান দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বিশ্বের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো চলে আসছে আঙুলের ডগায়। চলে এসেছে নিজের রুমের কম্পিউটার স্ক্রিনে, মুঠোফোনে। এ বয়সী ছেলেমেয়েরা আনন্দ পাচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। চ্যাট করছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ইউটিউবে। এই আনন্দ দখল করে নিচ্ছে অন্তর্গত প্রেষণার প্ল্যাটফর্মটি। প্রেষণার মূল উপাদান হচ্ছে আগ্রহ, চাহিদা, উৎসাহ। প্রেষণা হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। নেটের প্রতি টানের অর্থ হচ্ছে রনির দৈনন্দিন জীবনের মূল চাহিদা কেন্দ্রীভূত হয়েছে ইন্টারনেটে। আনন্দ ঘিরে আছে ইন্টারনেট। সুতরাং প্রেষণার পুরোটা দখল করে আছে যুগান্তকারী ইন্টারনেট। রনি নবম শ্রেণির ছাত্র। একজন ছাত্রের প্রধান কাজ হচ্ছে পড়াশোনা। পড়াশোনার জন্য প্রধান শর্ত হচ্ছে মনোযোগী হওয়া। মনোযোগী হতে হলে বিষয়ের প্রতি হতে হবে আগ্রহী, উৎসাহী। চাহিদা হচ্ছে প্রতিদিনের স্কুলের পড়া শেখা। পরবর্তী দিনের ক্লাসের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। প্রতিটি মুহূর্তকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা। অনাগ্রহী মন কখনো চাহিদা পূরণের দিকে নজর দেয় না। অনুৎসাহী মন চাহিদা পূরণে নিজেকে টানে না।

রনির মন পড়ার টেবিলের দিকে যায় না। বইয়ের প্রতি আগ্রহ বোধ করে না। জোর করে পড়তে বসালেও সেই মনে রেজিস্ট্রেশন হয় না পড়াশোনা। ছাপ ফেলে না স্মৃতির পাতায়। এমনি অবস্থায় স্মরণশক্তি ভোঁতা হয়ে যেতে থাকে। পড়ার প্রতি আগ্রহ হারাতে থাকে চক্রবৃদ্ধি হারে। রনির বেলায়ও ঘটছে একই ঘটনা। ইন্টারনেটের টানে ছাত্রাবস্থার মূল তপস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে পরিবার থেকে। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসসহ প্রতিদিন এখন বিশ্বব্যাপী আলোচনা হচ্ছে মাদকাসক্তি বিষয়ে। মাদকাসক্তি মানে রাসায়নিক দ্রব্যের ওপর মস্তিষ্কের নির্ভরতা। অর্থাৎ মাদকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে মস্তিষ্ক। আসক্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক মাদক ছাড়া চলে না। মাদকই তার চাহিদা। মাদকই তার প্লেজার, আনন্দ। মাদকই দখল করে নেয় তার আগ্রহের কেন্দ্রটি। আসক্ত ব্যক্তির প্রেষণা চলে যায় মাদকের দখলে। বদলে দেয় মানুষকে। বদলে যায় মেজাজ। বদলে যায় আচরণ। বদলে গিয়ে গড়ে তোলে নতুন জগৎ। এ জগৎ কেবলই ধ্বংসের, কেবলই বিপর্যয়ের। এ বিপর্যয়ের ঢেউ আঘাত হানে দেহ-মনে, সামাজিক জীবনে ঢেলে দেয় বিষ। মাদকের মতো আসক্তি তৈরি করছে ইন্টারনেটও। এই আসক্তির শিকার হয়েছে রনি। এই আসক্তির নামকরণ করা হচ্ছে ‘ইন্টারনেট আসক্তি’। রনির ইন্টারনেট আসক্তি মায়ের মনে তুলেছে দুশ্চিন্তার ঝড়। অর্থাৎ কেবল নিজেকে আক্রান্ত করেনি রনি, একই সঙ্গে আক্রান্ত করেছে পারিবারিক পরিবেশ। ছেলেমেয়ে ঠিকমতো পড়াশোনা করে না- এর চেয়ে বড় দুশ্চিন্তা পরিবারের জন্য আর কিছু হতে পারে না। বকাবকি করেন অভিভাবক। কড়াকড়ি আরোপ করেন মা। ফলে সন্তান যায় আরো বিগড়ে।

রনির মতো শিক্ষার্থীর করণীয় কী?
রনিকে বুঝতে হবে, মা-বাবা উদার। ইন্টারনেট বা মুঠোফোন ব্যবহার নিয়ে তাদের মধ্যে গোঁড়ামি নেই। পড়াশোনার পাশাপাশি বিনোদনের ব্যবস্থা করেছেন। কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছেন। মডার্নাইজেশনের জন্য বর্তমান যুগে ইন্টারনেটের বিকল্প নেই। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে রনির। ইন্টারনেটের সুফলটা কি নিয়ন্ত্রিত খাতে ব্যবহার করছে সে? নাকি অপব্যবহার করছে? অপব্যবহার থেকে আসছে আসক্তি? আসছে ধ্বংস। অথচ ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে সমৃদ্ধ হতে পারে তার মনোজগৎ। সমৃদ্ধ হতে পারে জ্ঞানভান্ডার। বিজ্ঞানের সুফলটা গ্রহণ করতে হবে। কুফলের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। দূরে থাকতে হবে কুফল থেকে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে কেবল কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকা হবে আত্মঘাতী কাজ। পড়াশোনাই হোক রনির মতো শিক্ষার্থীর আগ্রহ, চাহিদা ও উৎসাহের মূল লক্ষ্য। প্যারালালভাবে বিনোদনের উপকরণ কিংবা খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পারে সে। তবে মূল স্রোতের টানেই এগিয়ে যেতে হবে তাকে।

মুঠোফোনের অপব্যবহার কি ক্ষতি করছে পড়াশোনার মনোযোগ?
প্রশ্নটিও সাম্প্রতিক সময়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছে বিশেষজ্ঞদের বুক। তরুণ প্রজন্ম রাত জেগে ‘ফ্রি টক টাইমে’ কথা বলে। ঘন্টার পর ঘন্টা অনলাইনে গেমসে বুঁদ হয়ে থাকে।রাত হচ্ছে ঘুমানোর সময়। পরিমিত ঘুম না হলে পরবর্তী দিনে ঝিমাবে শিক্ষার্থী। স্কুলে যাওয়ার প্রতি আগ্রহের ঘাটতি তৈরি হবে। মস্তিষ্কের প্লেজার সেন্টার উদ্দীপ্ত হবে কথা বলার জন্য। কথা বলার নেশায় পেয়ে যেতে পারে তরুণদের মন। পড়াশোনার যে মন তা আর আলোকিত হতে চাইবে না। আনন্দ পাবে না স্যারের লেকচারে কিংবা বই পড়ায়। মনোযোগ থাকবে না বইয়ের পাতায়। ফলে স্মৃতিশক্তি খারাপ হবে। বুদ্ধিবৃত্তিতে ধস নামবে। পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হবে। জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি হবে।

তবে কি বিজ্ঞান মুঠোফোন ব্যবহারের বিরুদ্ধে?
না। পরিমিতিবোধ থাকতে হবে সব ক্ষেত্রে। রাত জেগে কথা বলা অনুমোদন করে না বিজ্ঞান। যথাসময়ে বিছানায় যাওয়ার আগে মুঠোফোন বন্ধ রাখতে হবে। এটাই অনুমোদন করে বিজ্ঞান। ঘুমানোর সময় ঘুমাতে হবে শান্তিতে। মুঠোফোন অন থাকলে অচেতনে মস্তিষ্কও খোলা থাকবে। অন্তর্গত চাহিদা গোপনে অপেক্ষা করবে প্রিয়জনের কল পাওয়ার। আকাঙ্ক্ষার গোপন ঘরে জ্বলে থাকবে বাতি। এ অবস্থায় মস্তিষ্কের শারীরবৃত্তীয় কাজ ব্যাহত হয়। এই মস্তিষ্ক পড়াশোনায় মনোযোগ স্থির রাখতে পারে না। নিজের অজান্তেই নিজেকে টেনে নিয়ে যাবে পেছনের দিকে। সাফল্যের বদলে ব্যর্থতা আসবে পরীক্ষার ফলাফলে।

মা-বাবা কী করবেন?
ইন্টারনেট অ্যাডিকশন কিংবা মুঠোফোনের অপব্যবহারের সঙ্গে সন্তান জড়িয়ে গেলে হার্ডলাইনে না গিয়ে ঘনিষ্ঠ হতে হবে সন্তানের সঙ্গে। সুবিধামতো সময়ে খোলামেলা আলাপ করতে হবে। অপব্যবহারের কুফল সামনে তুলে ধরতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসার জন্য সাহায্য নিতে হবে বিশেষজ্ঞের। কাউন্সেলিংয়ের সুবিধা নিতে হবে।

রনির মতো শিক্ষার্থীদের করণীয় কী?
ইন্টারনেট কিংবা মুঠোফোন ব্যবহারের কুফল বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। নিজের সচেতনতাই পারে বিজ্ঞানের সুফল গ্রহণ করতে। আসক্তিতে ডোবার আগে খুঁজতে হবে বিকল্প বিনোদনের উপায়। আসক্তিতে জড়িয়ে গেলে বাবা-মার সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করতে হবে। সাহায্য নিতে হবে। প্রয়োজনে গ্রহণ করতে হবে মনোচিকিৎসাসেবা। মনে রাখতে হবে, ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর।’ ইন্টারনেট কিংবা মুঠোফোন ব্যবহার শুরুর আগে সতর্ক থাকাটাই বড়ো দায়িত্ব। ইন্টারনেট ও মুঠোফোন ব্যবহারের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে। আরো মনে রাখতে হবে, মনস্তত্ত্বের দাবি হচ্ছে, ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রিত যথাযথ ব্যবহার, অপব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করে বিজ্ঞান।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন ক্রয়ের বিশেষ অফার

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleপুরুষের চেয়ে নারীরাই দুশ্চিন্তা বেশি করেঃ গবেষণা
Next articleনিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবতে শিখুন
অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল
প্রাক্তন পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here