ডা. পঞ্চানন আচার্য্য
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ।
ঘটনা—১
আদিবা হঠাৎ করেই খাবার খাওয়ার পরপরই বমি করছে। শুরুতে তেমন গুরুত্ব না দিলেও যখন সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, তখন স্কুল শিক্ষক বাবা—মা একটু চিন্তায় পড়লেন। পাশেই চিকিৎসককে দেখালেন, ওষুধ খেলো। দুয়েকদিন কমলেও আবার শুরু হলো আগের মতো। এবার ভাবছেন কী করবেন? পরামর্শ দেওয়া প্রতিবেশি, সহকর্মী, বা আত্মীয় স্বজনদের মধ্য থেকে কেউ বললেন জাদুটোনা কাটাতে, কেউ বললেন কারো মুখ পড়েছে সেটা কাটাতে, কেউ বললেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে, কেউ বা বিদেশে নিয়ে যেতে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে প্রথম সমস্যা কোন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ দেখাবেন? পরামর্শ আসল — মেডিসিন, গ্যাস্ট্রোলিভার, হরমোনের, গাইনী এমনকি নাক—কান—গলার। তার ওপর আছে কোন ডাক্তার ভালো? এসবের মধ্যেই অনেক ঝাফুঁক হলো, জ্বিনের আছর তাড়ানো হলো, মুখপড়া দোষ কাটানো হলো, বিভিন্ন বিষয়ের কয়েকজন বিশেষজ্ঞও দেখানো হলো। কিন্তু কিছুতেই উন্নতি হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন ওর কোনো রোগ নেই— এগুলো মানসিক, এবং দুয়েকজন মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞকে দেখাতেও বললেন। কিন্তু, আদিবার বাবা—মা বুঝে পান না এখানে মানসিক সমস্যার কী হলো? আদিবা তো এমন না যে এসব ইচ্ছে করে করছে, অথবা পাগলের মত উল্টাপাল্টা কোনো আচরণ করছে। এদিকে, আদিবা ভয়ে খাবার খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে।
ঘটনা—২
সম্প্রতি একটা গবেষণার ফলাফলে দেখা গেলো, অনলাইন জরিপে অংশ নেওয়া দুই শতাধিক চিকিৎসকের মধ্যে মাত্র ১২% জানেন যে, সব আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বিষণ্ণতা রোগ নাও থাকতে পারে। অর্থাৎ, আত্মহত্যা করলে তাঁর মধ্যে বিষণ্ণতা থাকতেই হবে এমন কোনো বিষয় নেই। অন্য কোনো মানসিক রোগ বা সমস্যাতেও একজন মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে।
ঘটনা—৩
বান্ধবীদের সাথে আড্ডা চলছে। কথায় কথায় সোহানা বলল এক বিড়ম্বনার কথা। সে তার এক ছোটবোনকে আত্মবিশ্বাসহীনতা আর নেতিবাচক চিন্তাভাবনার জন্য ভাবলো যে একটু কাউন্সেলিং করাবে। এর ওর কাছ থেকে খবর নিয়ে শহরে বেশ নামডাক আছে এমন একজন কাউন্সেলরের কাছে গেলো। সুন্দর অফিস, বসার জায়গা এবং অন্যান্য বিষয়াদি দেখে শুরুতে বেশ ভালোই লাগল। টাকার পরিমাণ একটু বেশী হলেও একপ্রকার জোর করে সে তার বোনকে কাউন্সেলিং করাচ্ছিল। কিন্তু কয়েক সেশন যাওয়ার পরে সে কৌতুহলবশত একদিন জিজ্ঞেস করল বোনকে, ওখানে কী করে বা কী বলে? বোন বলল উনাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না এখন আর। শুরুতে সে তার সমস্যাগুলো বলে বিপদে পড়েছে। উনি অনেক সমালোচনা করেন, তার ভুলগুলোর জন্য বিরক্ত হয়ে বলেন যে এমন ভুল কেউ করে নাকি, ভালো ভালো উপদেশ দেন, আর চেষ্টা করলে পারবে— কিন্তু অলস দেখে কিছু করছে না, বাবা—মার টাকা নষ্ট করছে এগুলো বলে। সেজন্য আসলে যেতে ইচ্ছে করে না। সোহানা জোর করে দেখে বাধ্য হয়ে যায়, উলটা আত্মবিশ্বাস কমিয়ে আসে, নিজেকে আরো দোষী মনে হয়। এসব শুনে সোহানা সাইকোলজিতে পড়ছে এমন এক বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করলে সে জানালো যে কাউন্সেলিং মানে তো বিচার—শালিস বা বকাঝকা করা বা উপদেশ দেয়া না। পরে ওই কাউন্সেলর এর নাম বললে তার বান্ধবী জানালো যে, উনি আসলে কোনো সাইকোথেরাপিস্টই না। কোনো একজনের কাছে ছয় মাসের মতো থেকে নাকি কাউন্সেলিং শিখেছে এবং তা দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছে। এসব শুনে রিমা জানালো তার খালাতো বোনের একইরকম আরেক অভিজ্ঞতার কথা। তার খালাতো বোনের বাচ্চার অটিজম আছে। বাসার পাশেই একটা অটিজম সেন্টার আছে দেখে বাচ্চাকে নিয়ে ওখানে ভর্তি করায়। সুন্দর অফিস, অনেক ঠাটবাট। মোটা অংকের টাকা খরচ হিসেবে দিলেও সেন্টারে যিনি থেরাপি দিতে আসেন, তাঁর সাথে আলাপ—আলোচনা দূরে থাক, কথাই বলা যায় না। এমনই ব্যস্ত আর রাগ—রাগ ভাব। এমনই অবস্থা ওই সেন্টারে যাওয়া থেকে আসা পর্যন্ত একটা মানসিক চাপ বা ভয়ে কাটত তার। কিন্তু যেই উন্নতির জন্য এত কিছু সহ্য করা সেটার দেখা মিলল না একটুও। উল্টো বাচ্চার আরো একা থাকা এবং জিদ করার প্রবণতা বেড়ে গেলো। পরে খেঁাজখবর নিয়ে জানা গেলো, যেনতেনভাবে কোনো ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান থেকে নামমাত্র একটা সার্টিফিকেট নিয়ে অটিজম এর বিশেষজ্ঞ থেরাপিস্ট সেজে বসার কাহিনী। সবশুনে নাদিয়া বলল, এরা তো অনেক ভালো। আমার এক চাচাকে মদের নেশা ছাড়ানোর জন্য শুরুতে যেই রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছিল, সেটার প্রতিষ্ঠাতা এবং সব কিছু পরিচালনা করা লোকটা নিজেই একজন মাদকাসক্ত ছিলো। তার জ্ঞানের পরিধি একটা রিহ্যাব সেন্টারে নিজে ভর্তি থাকাকালীন অভিজ্ঞতা।
মানসিক স্বাস্থ্য বা রোগ সম্পর্কিত বিষয়ে যাঁদের সংশ্লিষ্টতা আছে উপরের বিষয়গুলো নিয়ে কমবেশী সবারই ধারণা আছে। বলা চলে এটাই বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে জনসাধারণের, এমনকি চিকিৎসকদের মধ্যেও ধারণা। সর্বোপরি আছে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসার নামে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ ধাঁচের চিকিৎসা প্রদান। প্রশ্ন হচ্ছে এই অবস্থার পিছনে কারণটা কি? উত্তরে বেশ কিছু কারণ আসতে পারে। তবে, প্রধান কারণ মানসিক স্বাস্থ্য, মানসিক রোগ কিংবা মানসিক রোগের বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে সার্বজনীন অজ্ঞতা। আর এই অজ্ঞতার কারণ কি? উত্তর— প্রাতিষ্ঠানিক মানসিক স্বাস্থ্যশিক্ষার অভাব।
বিষয়টা কী? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি বিদ্যালয় বা এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো একটা নির্ধারিত বিষয়ে শিক্ষা প্রদান। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটাকে, শিক্ষাপ্রদানের নির্ধারিত বিষয়বস্তুকে এবং তাঁদের শিক্ষাপ্রদান পদ্ধতিকে একাধারে হতে হবে বিজ্ঞানসম্মত, এবং কোন একটা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অধীনে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। এভাবে প্রাপ্ত শিক্ষা হবে যথাযথ এবং চিন্তাজগতের বিকাশে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো যখন এসব মেনে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া হবে তখন সেটাকেই বলা চলে প্রাতিষ্ঠানিক মানসিক স্বাস্থ্যশিক্ষা। আমাদের দেশে যেটার অস্তিত্ব নাই বললেই চলে।
আমাদের দেশে বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে শারীরিক স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য যতটুকু আছে, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সেরকম কোনো তথ্য নেই। যতটুকু আছে সেটাও দায়সারা। ধরা যাক, কৈশোরকালীন সময়ের শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে যতটুকু উল্লেখ আছে, একই সময়ে ঘটা মানসিক অস্থিরতা বা পরিবর্তন সম্পর্কে সেরকম কিছুই বলা নেই। শারীরিক শিক্ষা নামক একটা আলাদা বিষয় থাকলেও, শারীরিক ব্যায়ামের আয়োজন থাকলেও মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা নামক কোনো বিষয় দূরে থাক মানসিক ব্যায়াম যেমন রিলাক্সেশন এক্সারসাইজ নিয়ে কিছুই বলা বা করানো হয় না। উপরন্তু, যারা বলবেন বা জানাবেন তাঁরা নিজেরাও তো এই বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত নন। কখনো জানতে পারলেও বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেন তার চেয়েও কম। ফলে, বিদ্যালয় পর্যায়ে এসব সম্পর্কে জানা হয় না কারোও। আর একারণেই দেখা যায় ক্লাসে প্রথম হতে না পেরেও কেউ কেউ আত্মহত্যা করে ফেলছে। অথবা সর্দিজ্বরের জন্য ছুটি পেলেও বিষণ্ণতা রোগের জন্য কোনো ছুটি নেই।
এরপর উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় নির্ধারিত পাঠ্যবিষয়টি। সেখানের পাঠ্যক্রমে বা পরিবেশে স্বাস্থ্য বিষয়টাই উপেক্ষিত। এক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য, মানসিক বিকাশ, মানসিক দক্ষতা অর্জন এগুলো কারো নজরেই আসে না, কেউ খেয়ালই রাখেন না। তাই হয়তো পিএইচডি করা বিদগ্ধ মানুষ পাওয়া যাচ্ছে; অথচ তাঁরা জীবনের অল্প উত্থান—পতনে ভেঙ্গে পড়ছেন অথবা প্রতিকূল পরিবেশে মানিয়ে নিয়ে নিজের কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারছেন না। বুঝতে পারছেন না কবে অন্যের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা, কখন নিবেন, কোথা থেকে নিবেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের মেডিক্যাল কলেজের পাঠ্যক্রমেও মনোরোগবিদ্যা বিষয়টা গুরুত্বহীন। অনেক তর্ক—বিতর্কের পর কিছুটা উন্নতি হলেও চিকিৎসকদের মনের মধ্যে এ বিষয় নিয়ে অনাগ্রহ বা তাচ্ছিল্যের ভাবটিও প্রকট। ফলে, চিকিৎসক হয়ে গেলেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রাথমিক ধারণাও অনেকের নেই। তাই নিজের বা রোগীদের প্রয়োজনে সঠিক পরামর্শ দেয়া বা অন্য কোথাও সমাধানের জন্য পাঠানোর সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন না। এমনকি নিজেরা যে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, সে বিষয়ের রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাঁদের মানসিক অবস্থাটাও অঁাচ করতে পারেন না। এতে করে বিশ্বমানের চিকিৎসা দিয়েও রোগীদের মানসিক পরিতৃপ্তি বা আস্থা অর্জন করতে পারেন না।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ব্যক্তিরা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটি সুষম ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসাব্যবস্থা তৈরির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন না, কীভাবে কী করতে হয় তা আন্দাজ করতে পারেন না। বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপ নিয়ে বরং অনেক ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে অনেক ভুঁইফেঁাড় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশিষ্ট সেবাদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। পেশাগত দক্ষতা, দায়বদ্ধতা বা উদ্দীপনা না থাকা এসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি শুধু অর্থ উপার্জনের একটা মাধ্যম হিসেবে এসব কাজ করে বরং জনগণের মনে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার প্রতি অনাগ্রহ বা ভুল ধারণার বিস্তার ঘটিয়ে চলছে।
এখন প্রয়োজন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করা। সহজ একটি মাধ্যম হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সকল স্তরে মানসিক স্বাস্থ্যকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা। বিশেষায়িত শিক্ষার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রায়োগিক অংশে মানসিক স্বাস্থ্য বা দক্ষতার বিষয়কে গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে মনোরোগবিদ্যাকে উন্নত দেশের মতো করেই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে প্রথম বর্ষ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠার প্রতিটি ধাপে। এভাবে যখন জনগণের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য, মানসিক সমস্যা বা মানসিক চিকিৎসা সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা গড়ে উঠবে— তখনই উপরের উদাহরণগুলোর পুনরাবৃত্তি আর হবে না।