মনের দিক থেকে কেমন আছেন আমাদের দেশের প্রবীণরা- স্পষ্ট কোনো চিত্র আমাদের জানা নেই। আমার কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। তাঁদের দেখে বুঝতে পারি তাঁরা ভালো নেই। তাঁদের অবস্থান পরিবারের মাঝে নড়বড়ে। মনোসামাজিক সমস্যা নিয়ে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে এলে আমাদের দৃষ্টিতে তাঁরা কাউন্সিলিং বা সাইকোথেরাপি নেয়ার জন্য তেমন ভালো ‘ক্লায়েন্ট’ নন। কাউন্সিলিং সেশনে তাঁদের নিয়ে বসলেও থেরাপিস্টের মনে এক ধরনের নেগেটিভ ‘কাউন্টার ট্রান্সফারেন্স’ সৃষ্টি হয় প্রবীণদের ব্যাপারে। নেগেটিভ কাউন্টার ট্রান্সফারেন্স হলো রোগীর প্রতি থেরাপিস্টের মনে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হওয়া।
মনের মাঝে প্রশ্ন আসে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাঁদের জীবনের শেষ অধ্যায় কোথায় কাটান? কোথায় কাটানো উচিত? সন্তানহীনরা কোথায় কাটাবেন? পুত্র বা কন্যা সন্তানের পিতা-মাতা কোথায় কাটাবেন? নিজ বাড়িতে নাকি বৃদ্ধনিবাসে? নিজ বাড়িতে থেকে তাঁরা কি তাঁদের জীবনের সব অধ্যায় নিজেদের মতো করে স্বাধীনভাবে কাটাতে পারেন না? সত্যি কি সম্ভব জীবনের পড়ন্ত বেলায় স্বাধীনভাবে জীবন পরিচালনা করা? শরীরের কলকব্জা তো সব ঠিকভাবে চলছে না। শক্তিও নেই আগের মতো। অর্থ-বিত্তের জোগানও কমে গেছে আগের চেয়ে। পরিবারের অনেক সদস্য এখন আর এক বাড়িতে থাকেন না। মনটাও কেন যেন হাহাকার করে সবকিছু ফুরিয়ে আসার বেদনায়।
কিন্তু না, এভাবে তো জীবন-চাকার এই পর্যায়ে পরোক্ষ সদস্য হয়ে বেঁচে থাকা চলবে না। প্রবীণদের হয়ে উঠতে হবে আগের চেয়ে আত্মপ্রত্যয়ী। তাহলেই তো নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারবেন তাঁরা। যে সময় হাতে আছে সে সময়টাকে করে তুলতে হবে মহামূল্যবান, করে তুলতে হবে অত্যন্ত আনন্দময়। প্রবীণ মনের খোঁজ করতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে স্মৃতির পাতা হাতড়ে যাই। হ্যাঁ, বেশ কিছু প্রবীণের কথা মনে করতে পারি।
এক প্রবীণ নারী। শিক্ষিত, সুন্দরী, স্মার্ট, অভিজাত ঘরের মেয়ে। ১৯৭৪ সালে বিয়ে হয়েছে। ভালো ঘরে। এক মাস স্বামী ভালো ব্যবহার করেছেন। এরপর থেকে শুরু হয় স্বামীর দুর্ব্যবহার, যা আজ অব্দি চলছে। পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে সংসার ছেড়ে যাননি। এক ছেলে, এক মেয়ের মধ্যে ছেলেটি আমেরিকায় থাকে। মেয়েটি এক মেয়ে নিয়ে তালাকপ্রাপ্ত। বাবার বাড়িতে এসে ঠাঁই নিয়েছে। স্বামী অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। মেয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। এর সঙ্গে স্বামী জুড়ে দিয়েছে ‘চরিত্রহীনা’ তকমা। কারণ অনেক দিন লম্পট স্বামীর সঙ্গে বিছানা শেয়ার করেননি তিনি। এত বছর পর মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে আসার কারণ হলো, আগের রাতে মেয়ে তাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। কারণ, উচ্ছৃঙ্খল মেয়ে নাতনিকে বেধড়ক পিটিয়েছে আর তিনি প্রতিবাদ করেছেন। স্বামী ক্লাবে ক্লাবে সময় কাটিয়ে ব্যবসা, টাকা দুই-ই হারিয়ে তাঁকে চাপ দিচ্ছে তাঁর বাসা স্বামীর নামে লিখে দেয়ার জন্য। আমার কাছে এসেছেন তিনি কী করবেন এই পরামর্শের জন্য। নাতনিকে নিয়ে উদ্বেগ ফুটে উঠেছে তাঁর চোখে-মুখে- আজ তো তিনি বাসায় থাকতে পারবেন না। রাত হলেই মেয়ে হাওয়া হয়ে যায়। আর নাতনিটা তাঁকে আঁকড়ে ধরে ঘুমায়। আজ তো তা হবে না!
তাঁর মনোসামাজিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নিকটজনের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে বলি। আর তাঁকে তাঁর মানসিক সমস্যার জন্য ব্যবস্থাপত্র দিই। অভিজাত প্রবীণ ভদ্রমহিলা চেম্বার ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও ঘটনার রেশ কাটাতে পারলাম না অনেকক্ষণ। কেমন আছেন আমাদের মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত প্রবীণরা?
মধ্যবিত্ত এক প্রবীণ নারী এসেছেন সারা শরীরে জ্বালাপোড়া নিয়ে। বিশ বছর ধরে ভুগছেন। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন। এই প্রথম মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে এসেছেন। দুই ছেলে ঝগড়াঝাঁটি করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। ছোট ছেলেটি সঙ্গে আছে। সেও ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে। শ্বশুরবাড়িতে থাকা বিবাহিত ছোট মেয়েটি সময় বের করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছে। স্বামীর দোকানের সাতজন কর্মচারীকে তিনবেলা খাবার রান্ন করে খাওয়াতে হয় রোগীকে। বাজারও তাকেই করতে হয়। একঘেয়ে জীবন তাঁর। তিনি কোনো বেতন পান না এ কাজের জন্য। তিনি যে ‘রোজগেরে গিন্নি’ তাও তিনি জানেন না। পরিবারের কেউ ভাবেনও না যে তিনি রোজগার করছেন। নিম্নবিত্ত এক প্রবীণ নারী, যার স্বামী নেই। অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ী। দুই ছেলে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। আমাকে দেখান। কিছুটা উন্নতি হওয়ার পর একদিন তিনি রোগী হয়ে আমার কাছে উপস্থিত। বললেন, সাত বছর ধরে মাথা ও শরীরের নানা উপসর্গে ভুগছেন। দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে খান। খুব আশা নিয়ে আমার কাছে এসেছেন। যদি ছেলেদের মতো তিনিও সুস্থ হন এই আশায়। এ রকম প্রবীণদের ইতিকথা আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে।
বর্তমানে আমাদের প্রবীণরা মানসিকভাবে কেমন আছেন বা তাঁদের কেমন থাকা উচিত তাই নিয়ে কি আমাদের পরিবার, সমাজ, মিডিয়া বা রাষ্ট্র ভাবছে? যাঁরা একদিন যে গৃহের কর্তা-কর্ত্রী ছিলেন, তাঁরা বৃদ্ধ হতে হতে সে স্থানটি হারিয়ে ফেলেছেন। বেঁচে থাকছেন কোনোমতে। এ যেন বেঁচে থাকার কারণে বেঁচে থাকা। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মনোজগৎ নিয়ে গবেষণার সংখ্যা অতি নগণ্য। হাতে গোনা। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৮ জন ষাটোর্ধ্ব মানুষ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছেন।
তথ্য-উপাত্ত আমার হাতে তেমন না থাকলেও আমি সবাইকে আহ্বান জানাই প্রবীণ বয়সে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই নিজের জীবনের যতি চিহ্ন দিয়ে দেবেন না। আপনাদের অনেক কাজ। অভিজ্ঞতায় ঠাসা আপনি। সেই অভিজ্ঞতাগুলো চারপাশে ছড়িয়ে দিন। সমাজকে আবর্জনামুক্ত করতে পারেন আপনারাই। জীবনের সব অধ্যায় হোক কর্তব্য আর সৌন্দর্যে ভরা। শুধু বদলে নিন কাজের ধরন। পরিবারের পরোক্ষ সদস্য নয়, সক্রিয় সদস্য হয়ে বেঁচে থাকুন। কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছে হয়:
বৃদ্ধদেরও আছে কাজ
ওরা কি কেবল ঝিমিয়ে পড়িবে
সেবিবে জায়নামাজ?
যৌবন নহে তো পূর্ণ ছবি
যার জয়গান গেয়েছে কবি
রয়েছে এতে মদ-মত্ততা, রয়েছে মিশে কালিমা
জীবন-রবির অস্ত ছবি
এঁকে দাও হে বুড়ো কবি
চলিতে পথ ভুলিয়া যাও, বুড়ো বয়সের জড়িমা।
সবশেষে প্রবীণরা, আমাকে ক্ষমা করুন। আপনাদের মানসিকভাবে উদ্যমী করে তোলার সুনির্দিষ্ট পথ আমি বাতলে দিতে পারিনি। এ লেখা হয়তো আমায় প্রেরণা জোগাবে আপনাদের জন্য কিছু করার।