চলতে গিয়ে দু’ ধরনের মানুষের দেখা আমরা প্রতিদিনই পাই। একদলে থাকেন অপেক্ষাকৃত চুপচাপ মানুষ, যারা প্রকৃতিগত বা স্বাভাবগতভাবেই একটু নীরব। যারা কিছু একটা ঘটার জন্য সব সময় অপেক্ষা করে থাকেন। অন্যদলে থাকেন এমন মানুষজন, যারা স্বভাবগত ভাবেই ক্রিয়াশীল বা একটিভ। যাদেরকে আমরা কর্মঠ বলে জানি এবং দেখে থাকি। যারা সব সময় কিছু একটা ঘটিয়ে দেখানোর বা ঘটানোর তাড়না নিয়ে দাপিয়ে বেড়ান। একটু বুদ্ধি খাটালেই এখন বোঝা যাবে কাদের বা কোন দলের মানুষের মানসিক চাপ বেশী থাকবে। তাই বলা যায়, কিছু মানুষের জন্য মানসিক চাপ থাকাটা সহজাত। চাপ নিয়ে চলতেই যারা অভ্যস্ত ও ভালোবাসেন। মোদ্দাকথা হলো, মানসিক চাপ চিন্তার বিষয় নয় বরং বিষয় হলো, এর সাথে সহযোগী হয়ে চলা ও চলতে পারা।
মানসিক চাপ নিত্যদিনের একটি বিষয়। মানুষের অতি সাধারণ ও স্বাভাবিক একটি অনুভূতি। মানসিক চাপ থাকাটা ক্ষতিকর বা খারাপ কিছু নয়। বরং কখনো উপকারী। কেউ যদি কোনো কাজ করতে গিয়ে সামান্য পরিমাণেও চাপ অনুভব না করেন, তবে সে কাজের ফলাফল কি হতে পারে, নিজেই ভেবে দেখুন! তাই চাপ থাকবে বা থাকতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কতটুকু থাকবে? কখন থাকবে আর কখন থাকবে না! কিংবা অতিরিক্ত চাপকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে? অন্যদিকে, অতিরিক্ত বা অনিয়ন্ত্রিত মানসিক চাপ কী করে বা করতে পারে সেটাও জানতে হবে এবং মনে রাখতে হবে।
বেঁচে থাকার জন্যই হোক কিংবা জীবনেকে সুন্দর করে সাজানোর প্রয়োজনেই হোক, মানুষ প্রতিনিয়তই কাজের ভিতর থাকে বা থাকতে হয়। মানুষকে বিভিন্ন রকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। সেই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে গিয়ে মানুষের মনে, বিভিন্ন রকম চিন্তা আসে। সেটা কাজটির শুরুর দিকেই হোক বা শেষ করার পরেই হোক। সেসব চিন্তা মানুষকে কখনো উদ্দীপিত করে, তৃপ্তি দেয়, আনন্দ দেয়, সাহসী করে তোলে কিংবা দুঃখ-কষ্ট দেয়। কখনো মনে ভয়ও ঢুকিয়ে দিতে পারে। আসলে সেই সব চ্যালেঞ্জই তখন মানসিক চাপের তৈরী করে। আর সেই চাপ, এমনকি তখন, মানসিক রোগের কারণ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। নির্ভর করে সেই নির্দিষ্ট কাজটিতে মানুষটির দখল বা নিয়ন্ত্রণ কতটুকু, তার উপর। যদি কাজটি করতে গিয়ে কাঙ্খিত ফল আসে, তবে আনন্দ হয়। আর যদি অনাকাঙ্খিত হয়, তবে দুঃখ বা কষ্ট।
কখন চাপ অনুভূত হয়?
অনাকাঙ্খিত বা অনিশ্চিত যে কোনো কাজ বা ঘটনা বা বিষয়ই মানুষের মনের মধ্যে চাপ তৈরি করে। অন্যভাবে বলা যায়, যে কাজটির ফলাফল পূর্ব নির্ধারিত নয়, এমন কোন কাজ করতে গিয়েই মানুষ সাধারণত মানসিক চাপ বা অতিরিক্ত চাপের সম্মুখীন হন। ব্যাপারটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করা চলে যে, ধরুন আপনি আগে থেকেই জানেন, আপনি কোন একটা কাজ করতে পারবেন না। তবে সেখানে আপনার মন খারাপ হতে পারে কিন্তু চাপে থাকবেন না বা কম থাকবে। কিন্তু যদি আগে থেকে না জানা থাকে তবেই সেখানে আপনি অতিরিক্ত চাপ অনুভব করতে পারেন। তাই বলা যায় যে, অনিশ্চয়তাই মানসিক চাপের প্রধান কারণ। যে কাজ সাধারণত মানুষকে আনন্দ দেয় সে কাজ করতে গিয়ে সচারাচর মানুষ কোনো চাপ অনুভব করে না। অপছন্দনীয় কাজ মানুষকে চাপে ফেলে সত্যি, বরং তার থেকে বেশি তৈরী করে বিরক্তি।
ব্যক্তি ও বয়সের উপর প্রভাব
মানসিক চাপ যেকোনো বয়সেই হতে পারে। এমন কোনো কথা নেই যে বাচ্চাদের বা বয়স্ক মানুষের হবে না। কখনো আবার সেটা Mental Stress Disorder বা মানসিক রোগও তৈরি করতে পারে। উল্টোদিকে, একেবারে কোনো রকমের চাপ নেই, পৃথিবীর সব কিছুর ব্যাপারে উদাসীন, সেটিও তখন কিন্তু ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে, যে বিষয়টি এখানে মনে রাখার প্রয়োজন তাহলো, প্রত্যেকটি মানুষেরই চাপ (Mental Stress) নেবার একটা নির্দিষ্ট ক্ষমতা আছে। এটা সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। এমনকি সব কাজের বা ঘটনার ক্ষেত্রেও মানুষের চাপ নেবার ক্ষমতা সমান নয়।
মানসিক চাপ শরীর বা মনে যেসব পরিবর্তন
বিষয়গুলো নির্ভর করে মানুষটির বয়স, অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিত্বের ধরন, অভ্যস্ততা এমন অনেক কিছুর উপর। মানসিক চাপের কারণে নির্দিষ্ট কাজের ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ার পাশাপাশি, মন খারাপ লাগা, অস্থির লাগা, ভয় লাগা, বিরক্ত লাগা, মনে না থাকা, মনোযোগ দিতে না পারা, কান্না আসা, ভুলে যাওয়া, মেজাজ খারাপ থাকা, ক্ষেপে যাওয়া, মৃত্যু চিন্তা, মৃত্যু ভয়, কাজের অনীহা, চিন্তায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে অনেক কিছুই হতে পারে। অন্যদিকে ঘুমের সমস্যা, বুক ধড়ফড় করা, পেটের সমস্যা, চোখের ঝাপসা দেখা, হাত-পা ঠাণ্ডা বা গরম লাগা, হাত-পা বা শরীর কাঁপা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, দম বন্ধ ভাব লাগা, যৌন সমস্যা, মাথাব্যথা, মাথাধরা, মাথাঘুরানো থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছুই হতে পারে এই মানসিক চাপের জন্য। এমন অনেক অনুভূতিকে বর্ণনা করার জন্য দুটি শব্দ আমরা প্রায়ই শুনে থাকি-‘হার্ট দুর্বল’ বা ‘স্নায়ু দুর্বল’। মূলত এ দুটি শব্দই মানসিক চাপ বা চাপের প্রভাবকেই প্রকাশ করে। এসব শব্দ ব্যবহার না করে মানসিক দুর্বলতা বা মানসিক চাপ শব্দগুলো ব্যবহার করাই উচিত।
মানসিক চাপ উপকারী, তবে রাখতে হবে নিয়ন্ত্রণে
প্রভাব ক্ষতিকর বা উপকারী দুটোই হতে পারে। যখন চাপের উপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না তখনই তা ক্ষতিকর হয়ে পড়ে। নিয়ন্ত্রণ থাকলে সেটা উপকারই করে থাকে, সন্দেহ নেই। অর্থাৎ অতিরিক্ত চাপ বা কম চাপ যা একজন মানুষের স্বাভাবিক কাজ করার ক্ষমতা নষ্ট করে; কম মনোযোগী হতে সাহায্য করে, তখন সেটা ক্ষতিকর। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় চাপ কিন্তু মানুষের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিই করে।