কিছু দ্বন্দ্ব আছে যেগুলো চিরন্তন। এই দ্বন্দ্বগুলোর শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। একেক ক্ষেত্রে একেক উপায়ে হয়তো এই দ্বন্দ্বগুলো থামতে বাধ্য হয় কিন্তু তারপরও এর রং, রূপ বরাবরই একই রকম থাকে। তেমনই এক দ্বন্দ্বের নাম শাশুড়ি-বউ এর দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের কথা শুরু করা যাবে কিন্তু শেষ করা যাবে না। কত শত বউয়ের চোখের পানি ঝড়েছে, কত শত শাশুড়ির মান মর্যাদা আহত হয়েছে- কে তার হিসেব রাখে? সংসারে বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব কখনও রূপ নিয়েছে ক্ষমতায়ন নিয়ে, কখনও বা ছেলেকে নিয়ে- ছেলের কাছে কে বড় মা নাকি স্ত্রী? কখনও বা অর্থের শক্তি নিয়ে আবার কখনও বা নিজেদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। তবে একটা সময় শাশুড়ি বউরের উপর শক্তিমান থাকেন, পরবর্তীতে আবার বউ শক্তিমান হয়ে উঠে।
এই দ্বন্দ্বটির প্রায় সমকক্ষ রূপ খুঁজে পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবন গুলোর মাঝে। সিনিয়র আপুরা জুনিয়রদের সাথে যে প্রক্রিয়ায় আচার ব্যবহার করে অথবা বিভিন্ন অত্যাচার চাপিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়াটি চালু করে, জুনিয়রা একটা সময় সিনিয়র হয়ে তার জুনিয়রদের উপর একই প্রক্রিয়া চালু রাখে। অফিসে জুনিয়র কর্মকর্তা সিনিয়রদের কাছ থেকে যে আচরণটি পায় সেটি সে আবার সময় মতো অর্থাৎ নিজে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ার পর নিম্নপদস্থদের সাথে প্রতিফলন ঘটায়।
আজ এ সকল আচরণগুলোর শুধু নেতিবাচক দিক নিয়ে চিন্তা করা যাক। কেন একজন অত্যাচারিত ব্যক্তি কষ্ট পাওয়ার পর নিজেকে অত্যাচারী না হয়ে উঠার প্রতিজ্ঞা করার পরও একটা সময় ঠিকই সে অত্যাচারী অথবা প্রভাব বিস্তারকারী হয়ে উঠেন?
খুব গভীর ভাবে চিন্তা করলে আপনারা নিজেরাও খুঁজে বের করতে পারবেন এর সূত্র। অভিজ্ঞতা হচ্ছে এমন একটি পাঠ্য পুস্তক যা প্রতিটি মানুষের নিজস্ব এবং একান্ত ভাবে রচিত হয়। এই অভিজ্ঞতার বইটির প্রতিটি পাতায় যা কিছু লেখা হয় তা আমাদের মনের অর্থাৎ মস্তিষ্কের গভীরে জমা হয়। যখন আমাদের অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যায় এমন কোনো পরিস্থিতির সন্মুখীন আমরা হই তখন আমাদের আচরণগুলো নির্ধারিত হয় অভিজ্ঞতার চরিত্র থেকে। যেমন, আমি যা দেখেছি তেমনটি আমি শিখেছি, ঠিক তেমনই হয়ে যাচ্ছে আমার আচরণ। যা হয়তো আমি চাই! যার পুরোটাই একটি শিক্ষণ প্রক্রিয়া। যেমন, আমারা ছোট বেলায় ‘মা’ কে যে প্রক্রিয়ার সংসার পরিচালনা করতে দেখেছি তা সঠিক বা বেঠিক যাই হোক না কেন নিজের সংসার হওয়ার পর এই মায়ের নীতিগুলোই আমাদের সংসার পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
তবে এখানে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যদি কোনো অভিজ্ঞতা নেতিবাচক হয়ে থাকে এবং আমাদের মনের তা মেনে নিতে কষ্ট হয়, তবে তা এক ধরনের ট্রমা বা মানসিক আঘাত রূপে মনের অভিজ্ঞতার পাতায় জমা হয়ে থাকে। দেখা যায় এই আঘাতের কারণেই গভীর কষ্ট এবং প্রতিশোধ প্রবণতার জন্ম নেয়। যখন জীবনে একই ধরনের পরিস্থিতি এসে হাজির হয় তখন ব্যক্তির অজান্তেই তাঁর ভেতরের প্রতিশোধ প্রবণ মন কার্যকরী হয়ে উঠে। যে কারণে অত্যাচারিত বাড়ির বউ তাঁর ছেলের বউয়ের প্রতিও অত্যাচারী হয়ে উঠেন, হলের সিনিয়র মেয়েটি তার জুনিয়রের প্রতি প্রভাব বিস্তারকারী আচরণ করতে শুরু করে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যখন তারা অত্যাচারীর (শাশুড়ি বা সিনিয়র) দ্বারা অত্যাচার সহ্য করছিল তখন নিজেদের কাছে তারা বারবার প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে তারা নিজেরা কখনও অত্যাচারী হবে না। অর্থাৎ “আমার শাশুড়ি আমার সাথে যে ব্যবহার করেছে আমি আমার ছেলের বউয়ের সাথে সে ব্যবহার কখনই করবো না। কেননা এর কষ্ট কি তা আমি জানি।” অথবা “আমি আমার রুমের জুনিয়র হিসেবে সিনিয়রদের থেকে যে কষ্টগুলো পেয়েছি সেগুলো আমার জুনিয়রদের সাথে আমি কখনই করবো না। আমি তাঁদের প্রিয় একজন সিনিয়র আপু হবো।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারে এমন সংখ্যা খুবই কম হয়।
কারা পারে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে আর কারা পারেনা সেটা একটু তলিয়ে দেখা যাক। সাধারণত যারা খুব সচেতন মানসিকতার, গোছানো ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি সামাল দিতে দক্ষ, তারা হয়তো প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারে। তাদের মনের ভেতরের শক্তি অনেক বেশী। তারা যেমন নিজের মূল্যবোধ বজায় রাখতে জানেন তেমনি অন্যকে মূল্যায়ন করা বা বিবেচনা করা অথবা ক্ষমা করার শক্তিও রাখেন। অন্যদিকে যারা তার কষ্টকর অভিজ্ঞতার কারণে আহত মন নিয়ে চলতে থাকে, বুদ্ধিমত্তার পরিপক্কতার অভাব থাকে এবং সামাজিক দক্ষতাগুলো পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে না তারাই শেষ পর্যন্ত প্রতিজ্ঞা ধরে রাখতে পারে না। তাদের মধ্যেই দেখা যায় ছেলের বউয়ের সামনে নিজের মাঝে জেগে উঠতে থাকে তাঁরই নিজের অতীত শাশুড়ি। তাদের মধ্যেই আবার ফিরে আসে সেই অত্যাচারী সিনিয়র আপু।
যদি এই আহত মন নিয়ে সমাজ, সংসার অথবা কর্মস্থল চালানোর চেষ্টা করা হয় তবে ফলাফল এমনটিই হবে। অর্থাৎ অতীতের সেই একই সুর বারবার পুনরাবৃত্তি হবে। এমনকি দিন দিন এর ফলাফল আরো খারাপের দিকেও যেতে পারে। তাই এই আহত মনকে যথা সময়ে যদি সুস্থতার দিকে নেয়া যায় তবেই সমাধান সম্ভব। অতএব, সময়মতো ক্ষতগুলো সারিয়ে নিতে সাহায্য নিন।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।