কীভাবে বাড়াবেন বুদ্ধিমত্তা

মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে কিছু কৌশল বের করেছেন, যা বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জন্য সহায়ক। তা হলো-

ব্যায়াম
ব্যায়াম শুধু যে ওজন কমায় তা নয়, ব্যায়াম মস্তিস্কের স্নায়ুগুলোকে সক্রিয় রাখে, মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল নিশ্চিত করে এবং প্রাণবন্ত রাখে। প্রতিদিন নিয়ম করে ব্যায়াম করুন। এতে বেশ ভালো হয়ে উঠবে আই কিউ। ব্যায়ামের মাধ্যমে ব্রেন সেলগুলো আরো বিকশিত ও শক্তিশালী হয় এবং আন্তঃযোগাযোগ বাড়ে ও মস্তিষ্ককে ড্যামেজ হওয়া থেকে প্রতিহত করে। কারণ ব্যায়ামের সময় প্রোটিন বের হয় মস্তিস্কের সেল থেকে, যা নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর নামে পরিচিত। এ মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য গঠনে সাহায্য করে এবং ব্রেনকে রক্ষা করে। এছাড়া ব্যায়ামের সময় নার্ভ প্রটেকটিং কম্পাউন্ড বের হয় ব্রেনকে রক্ষা করে। Hippocampus নামক ব্রেনের একটি জায়গা আছে, যা ব্যায়ামের সময় আকারে বড় হয়ে যায়। এর ফলেAlzheimer’s Disease প্রতিহত করতে সাহায্য করে। এই রোগ হলে মানুষ স্মৃতি ভুলে যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন দৌড়ানো, জগিং করার মতো কার্ডিওভাস্কুলার এক্সারসাইজ করলে আই কিউ বাড়ে। তাই ব্যায়াম শুধু শরীরকেই নয় বরং মস্তিষ্ককেও সুস্থ রাখে ও রোগ প্রতিরোধ করে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন।

পুষ্টিকর খাবার
বুদ্ধিমান হতে গেলে দরকার মস্তিষ্কের পুষ্টি। তাই বুদ্ধি বাড়াতে দরকার পুষ্টিকর খাবার। সঠিক হেলদি ডায়েট আপনার মস্তিষ্কের পুষ্টি। তাই বুদ্ধি বাড়াতে পুষ্টিকর হেলথ ড্রিংকেই আটকে থাকলে চলবে না। দরকার অন্য সব পুষ্টিকর খাবার। যেমন:

তৈলাক্ত মাছ ও মাছের তেল : স্যামন, ম্যাকরেল, সারডিন, কডের মতো সামুিদ্রক মাছে আছে প্রচুর ফ্যাটি অ্যাসিড। এই ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কে, চোখ ও স্নায়ুতন্ত্র গঠনে ভূমিকা রাখে।

পাতাওয়ালা সবজি: সবুজ রঙের পাতাওয়ালা সবজি শরীরের পাশাপাশি মস্তিষ্ককেও পুষ্ট করে। প্রতিদিন সবুজ পাতাওয়ালা সবজি খেলে স্মৃতি বিলুিপ্তর মতো ঘটনা ঘটবে না। বিশেষ করে পালং শাক, ব্রকোলি খাওয়া খুব উপকারী। কারণ এতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফলিট, বিটা-ক্যারোটিন ও ভিটামিন-সি।

ডিম : সুসাস্থ্যের জন্য সপ্তাহে ছয়টি ডিম খাওয়া খুব জরুরি। প্রতিদিন খাবার প্লেটে একটি করে সেদ্ধ ডিম রাখা জরুরি। তবে শুধু ডিমের সাদা অংশ খেলেই হবে না। খেতে হবে ডিমের কসুুমও। এর মধ্যে থাকে আয়রন। এই উপাদান লোহিত রক্ত কণিকা তৈরি করে যা মস্তিষ্ককে অক্সিজেন সরবরাহ করতে সাহায্য করে। এছাড়া ভিটামিন বি-১২ ও আয়োডিন স্মৃতিশক্তি জোরদার করে। তাই নিজেকে সজাগ ও মনোযোগী করে তলুতে চাইলে রোজ পাতে একটি করে ডিম রাখনু।

গ্রিন টি: মস্তিষ্কের প্রায় ৭০ শতাংশ জুড়ে পানি থাকে। এই পানি ব্রেনকে আর্দ্র রাখে বলেই ব্রেন এত নিখুঁত কাজ করে। তাই যখনই ক্লান্ত লাগবে, এক কাপ গ্রিন টি পান করে নিন। নিমেষে চনমনে হয়ে উঠবেন। সেই সঙ্গে স্মৃতি শক্তির উন্নতি ঘটবে। নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে এর মধ্যে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট বয়সকালে ডিমেনশিয়া না হওয়া থেকে রক্ষা করবে।

ডার্ক চকোলেট: ওবেসিটির ভয়ে যারা চকোলেট খাওয়া একপ্রকার ছেড়ে দিয়েছেন, তাদের জন্য রইল সখুবর। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ডার্ক চকোলেট ব্রেনের জন্য খুব উপকারী। এর ফ্ল্যাবনয়েড উপাদান কগনিটিভ স্কিলের উন্নতি ঘটায়। এছাড়া মস্কিষ্কে নিউরোন তৈরি করে, যা নতনু বিষয় মনে রাখতে সাহায্য করে। এমনকি মস্কিষ্কে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতেও সাহায্য করে ডার্ক চকোলেট।

ভাত রুটি: আমাদের মস্তিষ্ক গ্লুকোজ নির্ভরশীল। বলা যায়, এটি ব্রেনের খাবার। আমাদের মস্তিস্ক ঘণ্টায় ৫ গ্রাম গ্লুকোজ খায় কিন্তু জমা রাখতে পারে না। এই গ্লুকোজ রক্তের মাধমে মস্তিষ্কে প্রতিনিয়ত যায়। শরীরের গ্লুকোজের ওপর ব্রেনের ক্ষমতা নির্ভর করে। এজন্য শস্যদানা টাইপ খাবার খাওয়া উচিত। যেমনভাত, রুটি। যদিও কার্বোহাইড্রেটের উৎস। এগুলো কনভার্ট হয়ে গ্লুকোজ তৈরি করে। চিনি জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত নয়। কেননা বেশি চিনি খেলে তা শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণে তারতম্য ঘটায়, যা শরীরে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে।

ফল: কমলা ও ভিটামিন সি সমদ্ধৃ ফল খেতে হবে নিয়মিত। এতে মস্তিষ্কেও উন্নয়ন হয়। কলাতে থাকে প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম ও ভিটামিন বি-২। এটি নার্ভ ইমপালস ট্রান্সমিশনে খুব সাহায্য করে। এছাড়া নিউরোট্রান্সমিটার GABA তৈরিতে সাহায্য কওে, যা ব্রেন ঠান্ডা রাখে।

কলিজা: মস্তিষ্কের জন্য ২০% অক্সিজেন দরকার হয়। এই অক্সিজেন হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে আটকে রক্তের মাধ্যমে মস্কিষ্কে যায়। আর এই হিমোগ্লোবিনের জন্য দরকার হয় আয়রন, যা কলিজাতে খুব থাকে। তাই গরুর কলিজা খান। এতে অনেক ভিটামিন বিশেষ করে ভিটামিন বি থাকে প্রচুর।

সামুদ্রিক খাবার: এতে ভিটামিন, প্রোটিন লাইনিস, ম্যাংগানিজ কপার, লিথিয়াম, জিংক ও আয়োডিন থাকে, যা আমাদের মস্তিষ্কের জন্য ভালো। ছোটবেলায় আয়োডিনের অভাবের কারণে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়ে থাকে অনেকে।

বেশি বেশি বই পড়ুন: মস্তিষ্ককে সচল রাখার ক্ষেত্রে বই পড়ার বিকল্প নেই। যত পড়বেন ততই ব্রেন কার্যক্ষম হবে। বেশি বেশি বই পড়ুন। বুদ্ধিতে ধার দিতে বই পড়ার বিকল্প নেই। মনে রাখবেন বই পড়লে সময় নষ্ট হয় না বরং বুদ্ধির বিকাশের পাশাপাশি দ্রুত পড়া ও বোঝার অভ্যাস গড়ে উঠবে।

পাজল দেখুন
পাজল, ক্রসওয়ার্ড, দাবা, সডুকু, মেমোরি গেমস, বিভিন্ন ভিডিও গেম ইত্যাদি খেলুন। এ ধরনের খেলা মস্কিষ্কের শক্তি বৃদ্ধিতে দারুণ ভূমিকা রাখে।

ভালো ঘুম
পরিমিত ঘুম বুদ্ধি বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত সহায়ক। ছোট ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি আরো গুরুত্বপর্ণূ কারণ ছোট বয়সটাই তাদের মস্তিষ্ক গঠনের সময়। এজন্য বাচ্চাদের ঘুম অনেক জরুরি। সময়মতো ঘুম ও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলে সারাদিন শারীরিক বা মানসিক কোনো ক্লান্তি থাকে না, তাই মাথা ভালো কাজ করে। রাতে নিয়ম করে আগেভাগেই ঘুমাতে যাবেন এবং সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠবেন। কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা  ‍ঘুমানো চাই। মস্তিষ্কের সক্রিয়তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভালো ঘুমের কোনো বিকল্প নেই।

মেডিটেশন করুন
মেডিটেশন করলে চিন্তা ও চাপ কমে। মনোযোগ বাড়ে। ব্রেনের কার্যক্ষমতা বাড়ে। প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ মিনিট মেডিটেশন করুন। চোখ বন্ধ করে লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে মনকে একীভূত করার চেষ্টা করুন। এজন্য মেডিটেশন ক্যাসেট বা বই পড়ে উপায়গুলো রপ্ত করুন। বুদ্ধিমান মানুেষর সংস্পর্শে থাকুন। অবসর পেলে বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটান, গান শুনুন বা রান্না করুন। প্রয়োজনে অনেক সময় খোলা আকাশের নিচে কাটান। মাঝে মাঝে মনকে কল্পনার জগতে নিন।

যেসব কাজ করা উচিত নয়:

  • ধমূপান ছাড়তে হবে, কারণ তা ব্রেন সেলের ক্ষতি করে আইকিউকে ভোঁতা করে দেয়।
  • কেউ সমালোচনা করলে ভেঙে না পড়ে ইতিবাচকভাবে নেওয়া।
  • অযথা টিভি বা কম্পিউটারের সামনে সময় নষ্ট না করা।
  • মোবাইল ফোন সবসময় চালু না রাখা।
  • সর্বদা যন্ত্রনির্ভর না হওয়া।
  • প্রয়োজন ছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেটে সময় ব্যয় না করা।
  • নিজের মতামতের সঙ্গে অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া।
  • আবেগ বা বিশ্বাসকে প্রাধান্য না দিয়ে যুক্তির গুরুত্ব দেওয়া।
  • জটিল ও কুটিল চিন্তা থেকে সব সময় নিজেকে বাইরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।

বুদ্ধিমত্তাকে একজন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ৯ ভাগে ভাগ করেছেন। একজন মানুেষর এই ৯ ধরনের বুিদ্ধমত্তার সবক’টিরই কিছু না কিছু পরিমাণে রয়েছে। নিচে ৯টি বুিদ্ধমত্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলো।

  • নেচারালিস্ট বা প্রকৃিত সংক্রান্ত বুদ্ধিমত্তা। 
  • সংগীত সংক্রান্ত বুদ্ধিমত্তা।
  • যুক্তি-গাণিতিক বুদ্ধিমত্তা।
  • আধ্যাত্মিক বুিদ্ধমত্তা।
  • ইন্টারপার্সোনাল বা অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক সংক্রান্ত বুদ্ধিমত্তা।
  • ইন্টারপার্সোনাল বা নিজের সঙ্গে সম্পর্ক সংক্রান্ত বুদ্ধিমত্তা।
  • ভাষা অর্থাৎ মনের ভাব সুচারুরূপে ব্যক্ত করার ক্ষমতা সংক্রান্ত বুদ্দিমত্তা।
  • স্থান বা বস্তু সম্পর্কিত বুদ্ধিমত্তা। যেমন- ছবি আঁকা।
  • শরীর সংক্রান্ত বুদ্ধিমত্তা।

এই নয় ধরনের বুদ্ধিমত্তা আছে বলেই মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। তো বুদ্ধিমত্তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে জীবনকে উন্নত করার চেষ্টা করি।
সূত্রঃ লেখাটি মনের খবর মাসিক  ম্যাগাজিন  এর ১ম বর্ষ , ১০ম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

Previous articleনিঃসঙ্গতার কারণ হতে পারে ‘সোশাল মিডিয়া’
Next articleসময় দিন, মা-বাবা বাঁচবেন বেশীদিন
প্রফেসর ডা. নাহিদ মাহজাবিন মোরশেদ
চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট। অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here