কর্পোরেট সাইকোলজিতে টেলিসাইকিয়াট্রি

0
19
কর্পোরেট সাইকোলজিতে টেলিসাইকিয়াট্রি

দেবদুলাল রায়
রেসিডেন্ট, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

পৃথিবী প্রতিদিন বদলাচ্ছে। বদলে যাওয়া পৃথিবীর সাথে খাপ খাওয়াতে বদলাতে হচ্ছে আমাদেরও। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে একের পর এক প্রযুক্তি। যা আমাদের জীবনকে করে তুলছে সহজ, আরামদায়ক ও গতিময়। যে সেবা পেতে একটা সময় দিনের পর দিন দারুণ উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে। সে সেবা এখন আমাদের আঙ্গুলের ছোঁয়ায় আমাদের দোরগোড়ায় এসে হাজির হচ্ছে নিমেষেই। প্রয়োজন শুধু যথাযথ তথ্য যুক্ত থাকা এবং যথাযথ স্থানে ক্লিক করা।

প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের জীবনের গতি যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে ব্যস্ততা। অস্তিত্বের লড়াইয়ে সবাইকে উদয়াস্ত ছুটতে হচ্ছে। যারা প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না এগিয়ে যাবার দৌড়ে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে পারছে না, তারা হারিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে। সফলতার রক্তিম সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য তাদের হচ্ছে না। ফলশ্রæতিতে সবার সামনে থেকেও তারা যেন নেই হয়ে যাচ্ছে। তাই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে মানুষ ছুটছে। সফল হওয়ার মন্ত্র মনের ভেতরে রোপণ করে অনবরত ছুটছে।

কিন্তু এই ছুটে চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এর পদে পদে বাধা, বিপত্তি, হতাশা। যুদ্ধ জয় করতে করতে নিজের ভেতরটাও যে ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে তা ভাবার অবকাশটুকুও মানুষ পায় না। যখন একটু ফুরসৎ করে চিন্তা করার সুযোগ পায় তখন দেখে জীবনযুদ্ধের দৌড়ে এগিয়ে চলেছে বটে। কিন্তু মনকে জেঁকে বসেছে উদ্বিগ্নতা, বিষণœতা, হতাশা। যথাযথ যতেœর অভাবে পরিবারের কোনো সদস্য এই উদ্বিগ্নতা, বিষণœতা নিয়ে রীতিমতো ভুগছে। কিন্তু নিজের বা পরিবারের সদস্যদের এই অসুস্থতার যথাযথ চিকিৎসা নেবার ফুরসৎ হয়ে উঠছে না ঠিকমতো।

ব্যস্ততা, দৌড়ঝাঁপ আর সময়াভাবের পাশাপাশি সমধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনোরোগের ব্যাপারে স্টিগমা। মনের অসুখকে এই একবিংশ শতাব্দীতেও কেউ কেউ বায়বীয় মনে করে থাকেন এবং মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করলে পারিপার্শ্বিক অনেকে সেই ব্যক্তিকে পাগল বলে থাকেন। এই বিপত্তি এড়াতে অনেক ভোগান্তি সত্তে¡ও মানুষ মনোরোগের চিকিৎসা এড়িয়ে চলে। এই অবস্থায় আশার বাতিঘর হতে পারে টেলিসাইকিয়াট্রি। এই পদ্ধতিতে ঘরে বসে সহজেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া সম্ভব এবং তা যথাযথভাবেই ফলপ্রসূ।Magazine site ads

যেহেতু মনোরোগের ক্ষেত্রে সরাসরি শারীরিক পরীক্ষার গুরুত্ব অনেকাংশেই কম এবং রোগ নির্ণয় মূলত রোগী এবং অভিভাবকের সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক, তাই নিজ ঘরে বসে অন্তর্জালের সাহায্যে সহজেই বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে বিশেষজ্ঞ সেবা গ্রহণ করা যেতে পারে। গুরুতর মানসিক রোগীদের অনেকেই সন্দেহপ্রবণ হন। তারা অপরিচিত জায়গায় চললে ভীত স্বন্ত্রস্ত বোধ করেন। কখনো কখনো ভীতি থেকে আসে উগ্রতা বা উন্মত্ততা।

কমফোর্ট জোনের বাইরে জোরপূর্বক চিকিৎসা করাতে গেলে রোগীর উন্মত্ত আচরণেরও আশঙ্কা থাকে, যা অভিভাবকদের বিব্রত পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে। বিড়ম্বনার এই তিক্ত অনুভ‚তি পরবর্তিতে চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে কখনো কখনো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অথচ মনোরোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসার সাথে যথাযথভাবে সংযুক্ত থাকা সুস্থতার একটি পূর্বশর্ত। এক্ষেত্রেও টেলিসাইকিয়াট্রি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। রোগী নিজের কমফোর্ট জোনে থেকে টেলিসাইকিয়াট্রির মাধ্যমে নিয়মিত ফলোআপ করতে পারে অনায়াসে।

বর্তমান যুগ অর্থনীতি আর প্রযুক্তির। প্রযুক্তির অগ্রসরতা মানুষের জীবনে এনে দিচ্ছে অভাবনীয় অনায়াস। এর সাথে তাল মিলিয়ে চলছে অর্থের প্রবাহ। একটা সময় ছিল যখন বিভিন্ন রাষ্ট্র সমরাস্ত্র বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। যার যত সমরাস্ত্র সে তত শক্তিশালী রাষ্ট্র। কিন্তু অধুনা রাষ্ট্রসমূহ সে ধারণা থেকে সরে এসেছে। এখন যে রাষ্ট্র তথ্য প্রযুক্তিতে উন্নত এবং যার অর্থনীতির ভিত মজবুত সেই এখন মোড়লের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। রাষ্ট্রের অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সমূহের দ্বারা। তাই আধুনিক বিশ্বে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে চলে বিস্তর লড়াই। একে অপরকে ছাপিয়ে যাবার লড়াই। টিকে থাকার লড়াই। লড়াই মানেই শঙ্কা, উদ্বিগ্নতা আর স্নায়ুচাপ। যে স্নায়ুচাপ কর্পোরেট প্রধান অনুভব করেন, ক্ষেত্রবিশেষে তার কয়েকগুণ ছড়িয়ে দেন অধঃস্তনদের মাঝে। এগিয়ে যাবার লড়াইয়ে দিন দিন বাড়তে থাকে লক্ষ্যমাত্রা, বাড়তে থাকে কাজের চাপ। এই বর্ধিত চাপের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নতুন কিছু করার আগ্রহ বা উন্মাদনা হ্রাস পায়। কমে যায় উৎপাদনশীলতা। কর্পোরেট জগৎ যেহেতু লড়াইয়ের জগৎ তাই উপর্যুক্ত ব্যক্তিকে ঠেলে সামনে এগিয়ে যায় আরেকজন। ব্যক্তিটি হয়ত কর্মচ্যুত হয়। কিন্তু যথাযথ পরামর্শ বা চিকিৎসা নিলে ব্যক্তিকে হয়ত এভাবে হারিয়ে যেতে হতো না। সময়ের অভাব কিংবা স্টিগমাকে পাশ কাটিয়ে টেলিসাইকিয়াট্রি রক্ষা করতে পারতো একটি সম্ভাবনাময় সম্পদ।

আবার লড়াই মানেই সর্বদা জয়ী হওয়া নয়। লড়াইয়ে জয়ের স্বাদ যেমন আছে, তেমনি আছে পরাজয়ের তিক্ততা। এই তিক্ত স্বাদ পেয়ে কেউ কেউ মুখ থুবড়ে পড়ে। কেউ কেউ মোটিভেশনের খোঁজে হাতুড়ে মোটিভেশন স্পিকারের বাণী শুনে আরো বেশি হতাশায় নিমজ্জিত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে টেলিসাইকিয়াট্রি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। অফিসের কার্যক্রমকে বিঘিœত না করে টেলিসাইকিয়াট্রির মাধ্যমে আয়োজন করা যেতে পারে সেমিনার কিংবা ওয়ার্কশপ। এতে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অপরিহার্য যতটুকু করা সম্ভব।

প্রযুক্তি নির্ভর এই পৃথিবীতে টেলিসাইকিয়াট্রি এক অমিত সম্ভাবনার নাম। যা হয়ত আমাদের অজান্তেই বন্ধ জানালা খুলে,মায়ার কুজ্ঝটিকা সরিয়ে এনে দিবে কাক্সিক্ষত সূর্যালোক।

Previous articleসোশ্যাল মিডিয়া নেশাদ্রব্য সাপ্লাইকে সহজ করছে
Next articleবাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস এর গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here